আকাঙ্ক্ষার ও অবহেলার পহেলা বৈশাখ

আকাঙ্ক্ষার ও অবহেলার পহেলা বৈশাখ

সৈয়দ জাহিদ হাসান: বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ। বৈশাখের সঙ্গে বিশাখা নক্ষত্রের রয়েছে নিবিড় যোগ। সাতাশ নক্ষত্রের মধ্যে বিশাখা এমন একটি নক্ষত্র যে নক্ষত্রের প্রভাবে জাতক নানারকম ক্রিয়ানুষ্ঠানে অনুরক্ত হয়। শাস্ত্রে মোটামুটি এমনটাই বলা হয়েছে। বৈশাখ শুধু নানারকম আনন্দ অনুষ্ঠানেরই মাস নয়, এ মাসের অন্য তাৎপর্যও আছে। এ মাসে আমরা আশায় বুক বাঁধতে শিখি ও বুক বাঁধি। এক প্রচ- প্রতিবাদের নাম বৈশাখ। বৈশাখ তার তপ্তনিঃশ্বাসের দাবানলে পৃথিবীকে ব্যাধিমুক্ত রাখে। জরা, গ্লানি, পাপ, অনাচার, অবিচার, দুঃশাসন, ইতরপনা, সবই শুদ্ধ হয় বৈশাখের তপনতাপে। বৈশাখ পুরাতন স্মৃতিকে নবায়ন করে। পুরাতন সুরকে রূপান্তরিত করে নতুন সুরে। ক্রন্দন বৈশাখের ভাষা নয়, বজ্রের হুংকারই বৈশাখের বদনধ্বনি। বৈশাখ জীর্ণতাকে ধ্বংস করে নবযৌবনসঞ্চারী। বৈশাখ সাহস ও শক্তিদাতা। আমরা যারা ভীরু ও শক্তিহীনÑ তাদের জন্যে বৈশাখ আগমন করে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবার দারুণ এক শিক্ষা-বার্তা নিয়ে।

বৈশাখ মাসের অপরাহ্ণে যে প্রবল ঝড় আসে তার নাম কালবৈশাখী। কালবৈশাখী যা কিছু নড়বড়ে থাকে, এলোমেলো থাকে, সেগুলো ভেঙেচুরে নতুনরূপে পৃথিবীকে সাজায়। প্রকৃতিকে সুন্দর রাখার দায়ভার সাধারণত মানুষের উপরই বর্তায়। মানুষই যেহেতু প্রকৃতির সম্পদ সর্বাধিক ব্যবহারকারী তাই প্রকৃতির রক্ষণাবেক্ষণ দায়িত্ব মানুষ না নিলে এটা শুধু কর্তব্যে অবহেলা বললেই হবে না, এটা হবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রবলপাপ। মানুষ তখন পৃথিবীর আবর্জনা মুক্ত করতে অপরাগ হয় তখন প্রকৃতিই সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।

আগে গ্রামের মানুষকে দেখতাম কালবৈশাখী আসার আগেই তারা ঘরবাড়ি মেরামত করে রাখতো। নড়বড়ে ঘরে কেউ লাগাতো বাঁশের পেলা, কেউবা কঞ্চি দিয়ে মাটির সঙ্গে ঘরের চাল বেঁধে রাখতো। এগুলোতে শুধু যে গ্রামীণ মানুষের সাবধানতাই প্রকাশ পেতো তা নয়, কুটিরশিল্প হিসেবেও এগুলো দৃষ্টিশোভনীয় ছিল। কালবৈশাখী আসার আগেই যারা কালবৈশাখী মোকাবিলা করার মনোবল তৈরি করে রাখে, তারাই মূলত বাঙালি। ঋতুভেদে বাঙালির নিত্যদিনে কি পরিমাণ তারতম্য ঘটে নাগরিক জীবনে সেসব মোটেই অনুভব করা যাবে না, এগুলো বুঝতে হলে গ্রামে যেতে হবে, মিশতে হবে গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে।

লোক-সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করে গ্রাম। নগর ও নগরবাসী লোক-সংস্কৃতির সমঝদার মাত্র। আগের দিনে পহেলা বৈশাখ এলেই ঘর দুয়ার ধুয়ে মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতাম। পোশাক-আশাক ধুয়ে চৈত্রের শেষ রোদে শুকিয়ে পহেলা বৈশাখে ছুট দিতাম পল্লীবেড়া গ্রামের যতীন শিকদারের কালী-খোলায় কিংবা নয়ানগরের সেন মশাইয়ের বাড়ির আড়ংয়ে। যাত্রা-নাটক-সার্কাস নিয়ে তখন খুব একটা মাথা-ঘামাতাম না বেশি টাকা খরচ হতো বলে। অল্পদামি হরেক রঙের খাবার, মাটির তৈরি খেলনার দিকেই মনোযোগ দিতাম বেশি। এখানকার গ্রামে মাসব্যাপী বৈশাখী আড়ং তো দূরের কথা, একদিনের আড়ং উৎসবও যে কত ঝামেলার ব্যাপার তা আয়োজন না করলে বলে বোঝানো যাবে না। এই ঝামেলার প্রথম কারণ স্থানীয় প্রশাসন, দ্বিতীয় কারণ অসুস্থ রাজনৈতিক প্রভাব।

বাংলা নববর্ষের সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগসূত্র ঐতিহাসিক সত্য। নববর্ষে মানুষের সঙ্গে মানুষের শুধু মানবিক ও সামাজিক সম্পর্কই নতুনমাত্রা পায় তা নয়, অর্থনৈতিক সম্পর্কও ভীষণ জোরদার হয়। নববর্ষের হালখাতা কৃষিপ্রধান বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব। আগে নববর্ষে খাজনা আদায় হলেও এখন খাজনা আদায়ের দৃশ্য বিরল। তবে পাওনা টাকা আদায় করার জন্য ব্যবসায়ীরা তাদের আড়তে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার যে আয়োজন করে, সেই উৎসবের মূল্যও একেবারে কম নয়। পুণ্যাহের অভিজ্ঞতা যাদের নেই, তারা ব্যবসায়ীদের হালখাতার অনুষ্ঠান দেখে কিছুটা হলেও পুণ্যাহের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন। দুটো অনুষ্ঠানের পার্থক্য শুধু রঙে আর ঢঙে, কিন্তু উদ্দেশ্য একই, ‘অর্থসংগ্রহ

পৃথিবীর দেশে দেশে নববর্ষকে কেন্দ্র করে যেসব অনুষ্ঠান হয়, নিঃসন্দেহে সেগুলো নান্দনিক এবং নানা কারণে গুরুত্ববাহী। নববর্ষ এলে মনের অজান্তেই মানুষ আশাবাদী হয়। মহাকালের হিসাবে নববর্ষের ধারণার হয়তো কোনো মূল্যই নেই, তবু আশা-নিরাশার দোলায় দোদুল্যমান মানুষ নববর্ষে আশা নিয়ে বাঁচতে শিখে। নতুন শক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে ভগ্নশ্রী ভবিষ্যতের দিকে।  

আজ থেকে তিন বছর আগে অর্থাৎ ১৪২২ সনে আমাদের গ্রামের বাজারে হারুন ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসে প্রবীণ সুশীল চন্দ্র বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘বল তো প্রফেসর এবার বৈশাখে কার কি পরিণাম হবে। আচমকা অমন প্রশ্ন শুনে ভড়কে যাওয়াই স্বাভাবিক। আর তাছাড়া আমার কোনো ধারণাই ছিল না ভিন্ন ভিন্ন মাসে কারো কারো ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে। সুশীল বিশ্বাস গড় গড় করে বলে গেলেন, ‘অশ্বিণী, ভরণী, কৃত্তিকা নক্ষত্রে জাত ব্যক্তিদের ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ লাভ ছাড়াও পাওনা টাকা আদায় হবে। রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা নক্ষত্রে জাত ব্যক্তিদের প্রেম ভেঙে যাবে, বিনিয়োগকৃত অর্থ ডুবে যাবে। পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা নক্ষত্রে জাত ব্যক্তিদের বাণিজ্যিক সফর লাভদায়ক ছাড়াও বিদেশ গমনের স্বপ্ন পূরণ হবে। মঘা, পূর্বফাল্গুনী, উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্রে জাত ব্যক্তিদের মামলা-মোকদ্দমার রায় বিপক্ষে যাওয়ায় সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে পড়বে। হস্তা, চিত্রা, স্বাতি নক্ষত্রে জাত ব্যক্তিদের মন গোপনপ্রেম ও অনুচিত কাজ কারবারের প্রতি আকৃষ্ট হবে। বিশাখা, অনুরাধা, জ্যৈষ্ঠা নক্ষত্রে জাত ব্যক্তিদের গৃহে নতুন আসবাবপত্র ও বস্ত্রালংকার আসতে পারে। মূলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে জাত ব্যক্তিরা মূল্যবান জিনিসপত্র-অর্থ সম্পদ হারিয়ে চোখে সরষের ফুল দেখবেন। শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা নক্ষত্রে জাত ব্যক্তিদের জীবনে বিষাদের ছায়া দেখা দেবে।এরপর তিনি বললেন, আমার কথায় বিশ্বাস না হলে পঞ্জিকা দেখ গিয়ে পঞ্জিকায় তা-ই লেখা আছে। আমি তৎক্ষণাৎ একটি লোকনাথ পকেট পঞ্জিকা (পৃষ্ঠা-৩৫) যোগাড় করে দেখলাম, সুশীল বিশ্বাস যা যা বললেন ঠিক তা-ই লেখা আছে। তিনি বললেন, ‘প্রফেসর তোমরা নতুন জ্ঞানে-জ্ঞানী। বিশ্ব এখন তোমাদের হাতের মুঠোয় এ কথা অবশ্যই মানি। কিন্তু স্বীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির দিকে মনোযোগ না দিয়ে কেন তোমাদের এই অর্থহীন ভ্রান্তিবিলাস? দেশ ও দেশের সংস্কৃতির দিকে মন দাও, তাহলে বিশ্বও তোমার দিকে মনোযোগী হবে।আসলেও তাই। আমাদের পহেলা বৈশাখ শুধু নববর্ষেরই প্রথম দিন নয়, এটি আমাদের নবজীবনের প্রেরণাদাতা। পৃথিবীতে যতগুলো বর্ষপঞ্জি আছে, সেগুলোর মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিচারে বাংলা বর্ষপঞ্জি নানা কারণেই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।

আজ দুঃখ হয়, যখন দেখি রাষ্ট্রযন্ত্র নিরাপত্তার অজুহাতে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ও বাঙালি জীবনে এর গুরুত্বকে অস্বীকারের চেষ্টা করে। সরকার অতি সম্প্রতি সরকারি কর্মচারীদের জন্য বৈশাখী ভাতার প্রচলন করেছেন বটে কিন্তু বৈশাখের আনন্দ থেকে মানুষকে বঞ্চিতও কম করছেন না। পহেলা বৈশাখে বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রাণ ফিরে পায়, মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় নতুন প্রেরণা। সেই দিনই যদি বিকেল পাঁচটার পরে মানুষকে গৃহবন্দি করা হয়, তাহলে এরচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আর কি হতে পারে। এ আমরা কেমন দেশে বাস করছি, যে দেশে নববর্ষ উদ্যাপনের আনন্দ উপভোগ করা যায় না? পরিবার-পরিজন নিয়ে করা যায় না বৈকালিক বিনোদন? বৈশাখ আমাদের বিদ্রোহী হয়ে বাঁচতে শেখায়, বিকলাঙ্গ হয়ে গৃহসুখ ভোগ করতে শেখায় না। আমরা পরিপূর্ণ আনন্দে অবগাহন করতে চাই, খ-িত সুখে আটখানা হতে চাই না। বৈশাখ আমাদের জাতীয় জীবনে অবশ্যই আকাক্সক্ষার, কিন্তু আজকের দিনে সেই আকাক্সক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৌলবাদ-আক্রান্ত অবহেলা। মৌলবাদের ছোবল ও প্রশাসনের অক্ষমতা থেকে পহেলা বৈশাখকে আজ মুক্ত করতে হবে। ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে বৈশাখের অনাবিল আনন্দ। কালবৈশাখীর দিনে বাঙালিরা ঘরে বসে কখনো কাল কাটায়নি, ভবিষ্যতেও কাটাবে না। বাঙালি উদার ও অসাম্প্রদায়িক। পহেলা বৈশাখের আনন্দ-উৎসবও বন্ধনহীন ও অসাম্প্রদায়িক ভাবগাম্ভীর্যে পালিত হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

-লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.