সৈয়দ জাহিদ হাসান: বাংলাদেশের তিন দিকেই বিশালাকার ভারতভূমি। ভারত বাংলাদেশের দরদি প্রতিবেশী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অনেক বীর সৈনিক বাংলাদেশের পক্ষে লড়াই করেছেন, অনেকেই শহিদ হয়েছেন বাংলার মাটিতে। সেই সূত্রে বলতেই হয়, ভারতভূমি ও বঙ্গভূমি রক্তের বন্ধনে বাঁধা। আমরা অতীত ইতিহাসের জন্য ভারতের কাছে ঋণ স্বীকার করছি। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আসামে বৈধ নাগরিকদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। ওই তালিকা দেখে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অবশ্য আতঙ্কিত হওয়ার পেছনে যৌক্তিক কারণও আছে। আসামের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ২৯ লাখ। ২০১৭ সালের বর্ষশেষের মধ্যরাতে আসাম রাজ্য তরি বৈধ নাগরিকদের যে পঞ্জীকরণ করেছে তাতে ১ কোটি ৩৯ লাখ মানুষের নাম নেই। প্রায় দেড় কোটি মানুষের নাম বাদ পড়ায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে আসামের বাঙালি নাগরিকসহ ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ভারতীয় সংসদের নি¤œকক্ষ লোকসভায় বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে। ৩ জানুয়ারি ২০১৮ সালে কংগ্রেস পার্টির নির্বাচিত সদস্য সুস্মিতা দেব ও গৌরব গগৈ বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানান। ৪ জানুয়ারি তৃণমূল দলের সাংসদ সৌগত রায় লোকসভায় বিষয়টি উত্থাপন করেন। সৌগত রায়ের সমর্থনে কংগ্রেস ও বাম সদস্যরাও প্রতিবাদে সোচ্চার হন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বিক্ষোভকারীদের আশ্বস্ত করে বলেছেন চূড়ান্ত তালিকা থেকে কারো নামই বাদ যাবে না। যদি চূড়ান্ত তালিকা থেকে কারো নামই বাদ না যায় তাহলে ১ কোটি ৩৯ লাখ মানুষকে আতঙ্কিত করার কি মানে আছে? একটি রাজ্যের গণজরিপে ১ কোটি ৩৯ লাখ মানুষ বাদ পড়া মোটেই তামাশার বিষয় নয়। এর পেছনে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য আছে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। এদিকে ‘ইকোনমিক টাইমস’ এর খবরে বলা হয়, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি অভিযোগ করেছে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হতে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ভোট ব্যাংক হিসেবে পেতে চান। তাই তিনি ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনের (এনআরসি) নবায়ন চান না। কে কি চান, না চান সেটা তাদের ব্যাপার। মূল কথা হলো, এই মুহূর্তে পঞ্জীকরণ থেকে যাদের নাম বাদ পড়েছে, তাদের ঘুম হারাম হয়েছে গেছে। তারা এখন দারুণ অনিরাপদ বোধ করছেন আসামে। বিষয়টি এখন এতটাই নাজুক আকার ধারণ করেছে যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যাওয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বহুবার আসাম রাজ্য বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। এবারও বাঙালির রক্তে আসাম রাঙানোর চেষ্টা করা হলে আসামের বাঙালিরা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। বাংলাদেশও তাদের নৈতিকভাবে সমর্থন দিবে। আসাম রাজ্যে শুধু অসমিয়ারাই নয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে বাস করছে। অসমিয়াদের সঙ্গে বৃহৎ বাঙালি গোষ্ঠী ছাড়াও ডিমাসা-কার্বি-মিশিং-আহোম-মৈতৈ-মনিপুরি-বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি-মারা প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস। এদের বিতাড়ন করে ‘আসাম শুধু অসমিয়ার’ করা হবে হঠকারি সিদ্ধান্ত। বারবার আসাম রাজ্যে অসমিয়াদের হাতে বাঙালি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী প্রাণ হারিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ১৯৪৮ সালে গুয়াহাটি শহরের দাঙ্গার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ১৯৬০ সালের গণহত্যার কথা। ১৯৮৩ সালে যে বীভৎস গণহত্যা সংঘটিত হয় নেলি ও গোহপুরে তাও ইতিহাস ভুলে যায়নি। এমনিতেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সামাল দিতে গিয়ে বাংলাদেশ হিমসিম খাচ্ছে। ১ কোটি ৩৯ লাখ কথিত অবৈধ আসামি বাঙালি যদি তাড়া খেয়ে আবার বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন অবস্থা কি ভয়াবহ হবে তা চিন্তা করতেও গা শিউরে উঠে। এই মুহূর্তে আসাম রাজ্য সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সুবিবেচনাপ্রসূত হস্তক্ষেপ ভীষণ জরুরি। এর ব্যত্যয় ঘটলেই লক্ষ জীবন বলি হবে। রক্ত বইয়ে যাবে পাহাড় ও সমতলে। সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে ভারত বাংলাদেশ ও বাঙালিকে ইচ্ছাকৃতভাবে কষ্ট দিতে চাচ্ছে। বাঙালির পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে চাইছে। তিস্তা নদীর পানি নিয়ে যে-নাটক করছে ভারত সরকার সে-নাটক দেখে বাংলার মানুষ বিস্মিত হয়েছে। বার্মার আরাকানরাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী যে নির্যাতন সেখানেও আছে ভারতের পরোক্ষ মদদ। সাম্প্রতিককালে আসাম রাজ্যে বাংলাদেশি বিদ্বেষী যে খসড়াপঞ্জি তৈরি করেছে তাতে দেখা গেছে ১৫০ বছর ধরে যারা আসামে বসবাস করছে তাদেরকেও অবৈধ বাংলাদেশি বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাদের পাসপোর্ট, প্যানকার্ডসহ সব সরকারি নথিপত্র পরীক্ষার নামে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করে ভারত বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। উল্টো বাংলাদেশ অর্জন করেছি ‘মাদার অফ হিউম্যানিটি’ খেতাব। রোহিঙ্গা বিতাড়ন খেলায় হেরে ভারত এখন আসাম নিয়ে খেলতে শুরু করেছে। আসামের প্রায় দেড় কোটি মানুষকে জোরপূর্বক অবৈধ বানিয়ে বাংলাদেশে ঢোকানোর পাঁয়তারা করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন ও শান্তি ভারতের মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে নিয়ে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অনেক খেলেছে। এবার তার মনে রাখা দরকার বাংলাদেশও ভারতকে নিয়ে খেলার সক্ষমতা অর্জন করেছে। ভারতবাবু নিজেকে দাদা ভাবা বন্ধ করুন। আপনি আয়তনে ও শক্তিতে বড় বলে বাংলাদেশ আপনার শোষণ ও অনাচার কিছুতেই মেনে নিবে না। সাম্প্রদায়িকতা উসকে না দিয়ে সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করুন। সীমালঙ্ঘন করবেন না। নিরীহ কিন্তু বিদ্রোহী বাঙালিদের সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলবেন না। দেড় কোটি বাঙালিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মারতে চাইলে আপনাকেও কোনোভাবে বাঁচতে দেওয়া হবে না। টুকরো টুকরো করে দেওয়া হবে অখ- ভারতভূমি। ভাগীরথী আর গঙ্গার বুকে জলপ্রবাহ নয়, বয়ে যাবে নজিরবিহীন রক্তপ্রবাহ। লেখক : কবি ও কথাশিল্পী। Loading… সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। আরও পড়ুন শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা একুশে ফেব্রুয়ারি : মহত্তর ত্যাগের নবতর সংকল্প সাক্ষাৎকারে ডাঃ কাজী রুমানা শারমিন রুমি শারাপোভা আবার…. Loading… অনুভূতি জানানঃ Facebook fan page Leave a Reply Cancel ReplyYour email address will not be published.