ইতিহাসের নিরিখে বাংলাদেশ কার হাতে নিরাপদ?

ইতিহাসের নিরিখে বাংলাদেশ কার হাতে নিরাপদ?

মোনায়েম সরকার: বাংলাদেশের শত্রুরা আবার জেগে উঠেছে। নানামুখি ষড়যন্ত্র করে স্বাধীন, সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে আবার অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে উঠে পড়ে লেগেছে চিহ্নিত শত্রুরা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধারা যখন রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছিলেন, তখন এদেশের একদল লোক, স্বাধীনতাবিরোধী হয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী এসব সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক ছিল মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলাম ও নেজামে ইসলামের মতো কট্টর মৌলবাদী দলসমূহ। তারা সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে। শুধু সহযোগিতাই নয়, তারা ধর্ষণ, খুন, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেছিল দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি-ঘরে। সেই শত্রুরা আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে নিঃস্ব, রিক্ত করার গোপন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনোই এদেশের মঙ্গল চায় না, তারা চায় না বাংলাদেশ ও বাঙালি মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে বাঁচুক। তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানি-মৌলবাদী ভাবধারায় নিয়ে যেতে চায়, লুন্ঠন আর দুর্নীতি করে এদেশকে বানাতে চায় তলাবিহীন ঝুড়ি। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার অদম্য বাংলাদেশ যখনই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছে, তখনি ওই সব অন্ধকারের জীবেরা, দেশদ্রোহী শত্রুরা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে পিছপা হয়নি। এখনো তারা চায় না বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।


বাংলাদেশের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ তেইশ বছর লড়াই-সংগ্রাম করে পরাধীন বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন। তিনি চেয়েছিলেন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ হবে একটি স্বনির্ভর, উন্নত দেশ। মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত, শ্মশান বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করে তিনি যখন উন্নয়নের পথে দীপ্তপায়ে হাঁটছিলেন ঠিক তখনি দেশদ্রোহী ঘাতকের দল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে বাংলাদেশের গতিপথ বদলে দেয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর দীর্ঘ একুশ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে রাখে বাংলাদেশবিরোধী চক্র। এই একুশ বছর যে দুটি দল বাংলাদেশকে পরিচালনা করে তারা হলো বিএনপি ও জাতীয় পার্টি।


ক্যান্টনমেন্টের উর্দিপরা সেনাসদস্য মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নাটকীয়ভাবে এদেশের প্রেসিডেন্ট হন। তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিএনপি সৃষ্টি করেন। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার মিশনে নামেন। নির্বিচারে ফাঁসি, গুম ও খুনের মাধ্যমে তিনি হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও নিরপরাধ সেনা অফিসার হত্যা করেন। দেশের উন্নয়নের চেয়ে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। তার সেই লক্ষ্য পূরণ হওয়ার আগেই তিনি চট্টগ্রামে নির্মমভাবে খুন হন। জিয়াউর রহমান খুন হওয়ার পর আরেক সেনাসদস্য এইচ এম এরশাদ প্রেসিডেন্ট হয়ে দীর্ঘকাল বাংলাদেশকে পদানত করে রাখেন এবং ১৯৭২ সালের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত করার সব নীলনকশা বাস্তবায়ন করেন। এরশাদের শাসনামলে দুর্নীতি, খুন বাংলাদেশের নৈমিত্তিক বিষয়ে হয়ে দাঁড়ায়। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি তার সময়ে নতুনভাবে জেগে ওঠে। মদ্যপ ও নারী লিপ্সু এরশাদ নিজে ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ধার্মিকের ভান করে এদেশের মানুষকে দীর্ঘ দশ বছর বোকা বানিয়ে রেখেছিলেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। এরশাদের আমলে বাংলাদেশের কি উন্নয়ন হয়েছে ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে। স্বৈরাচার, নরঘাতক এরশাদ গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলে মৌলবাদীদের সঙ্গে আঁতাত করে জিয়াপতœী খালেদা জিয়া চিহ্নিত রাজাকারদের নিয়ে আবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।


খালেদা জিয়া দৃশ্যত প্রধানমন্ত্রী হলেও তার দুই কুলাঙ্গার পুত্র, তারেক আর কোকো পর্দার আড়ালে থেকে রাষ্ট্রের কলকাঠি নাড়তে থাকেন। তারেক ও কোকো দুর্নীতিতে সুদক্ষ ছিলেন। একদল দুর্বৃত্তলোক সারাক্ষণ তাদের সঙ্গে মাছির মতো লেগে থাকতো। হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবনের মতো অপরাধজগৎ নির্মাণ করে তারা সেখানে বাংলাদেশবিরোধী অপরাধে লিপ্ত থাকতো। কিভাবে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা যাবে, কিভাবে কাজ না করে দেশের মানুষকে ফাঁকি দিয়ে দুর্নীতি করা যাবে, কাকে কখন হত্যা করতে হবেÑ এসব ছিল হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবন ও তৎকালীন গণভবনের রুটিন ওয়ার্ক। সে সময় বাংলাদেশের চেহারা কেমন ছিল তা আজ বোঝা যাবে না, কেননা সেই জীর্ণশীর্ণ বাংলাদেশ এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।


বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মপর ভুলে যায়। ভুলে যায় শত্রুর শত্রুতা, অতীতের নির্মম, নিদারুণ স্মৃতি। বিস্মৃত-পরায়ণ জাতি হিসেবে বাঙালির অপবাদ নতুন কিছু নয়, কিন্তু যে জাতি প্রতিশোধ নিতে জানে না, যারা ঠিকমতো চিনতে পারে না শত্রু-মিত্রের তফাৎ, তারা প্রকৃতপক্ষেই মহান জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উচুঁ করে বাঁচতে পারে? বিগত দিনের বাংলাদেশে তিনটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশকে শাসন করেছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। এদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল আরো কিছু ছোট ছোট দল। এসব ছোট দলের কথা বাদ দিয়ে উপরিউক্ত তিনটি বড় দলের তুলনামূলক আলোচনা করলে বোঝা যাবে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ কার হাতে নিরাপদ। বাংলাদেশকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়া দল ‘আওয়ামী লীগ’। আওয়ামী লীগই যেহেতু সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে পাকিস্তানিদের কবল থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিল, তাই আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা আগে যারা করেছিলেন, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। এখনো যারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেন, তারাও বাংলাদেশের উন্নয়ন চান না। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করতে চাই।


১৯৭৫ সালের পর দীর্ঘ একুশ বছর বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যেসব উন্নয়ন করেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে তারচেয়ে কয়েক হাজার গুন বেশি উন্নয়নের সাফল্য দেখিয়েছে। প্রমত্ত পদ্মানদীর বুকে বিশ্বের এগারোতম দীর্ঘ সেতু নির্মাণের সাফল্য কার? জননেত্রী শেখ হাসিনার। বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশ কখনো ভাবতেই পারেনি মহাকাশে তাদের একটি নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকবে, সেটাও সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কারণে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সামান্য কাজ নয়, বাংলাদেশের জন্য এটাও অকল্পনীয় ছিল। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তিনি। শত শত আশ্রয়ন প্রকল্প, গভীর সমুদ্রে বন্দর স্থাপন, দুর্গম পাহাড়ে যোগাযোগের সুব্যবস্থা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, শিক্ষা ভাতার মতো সেবামূলক কার্যক্রম কার শাসনামলে সম্ভব হয়েছে? বাংলাদেশের অফিস-আদালতে ফাইল আটকিয়ে ঘুষ গ্রহণ নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু ‘ডিজিটাল’ পদ্ধতি চালু হওয়ার পরে ঘুষ ছাড়াই সবকিছু ঘরে বসেই করা সম্ভব হচ্ছে। এই অবদান কার? জননেত্রী শেখ হাসিনার তথা আওয়ামী লীগের। এই সত্যকে অস্বীকার করে মিথ্যাকে যারা আলিঙ্গন করতে চায়, তারাই দেশ-জাতির শত্রু।


করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির পূর্ববর্তী বাংলাদেশের সার্বিক সূচক পরীক্ষা করে দেখা যায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক উপরে ছিল। করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে দারুণ ধ্বস নামে। ইউরোপ-আমেরিকা নিজেরাই যেখানে জীবনযাত্রার ব্যয়ভার মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, যখন-তখন তাদের প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীগণ পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন, সেই পরিস্থিতিতে এখনো বাংলাদেশ কার নেতৃত্বে সুস্থ-সবল আছে?


আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই এদেশের মানুষ খেয়েপরে ভালো আছে। বিশ্বের সবদেশ যখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় চুপসে গেছে সেখানে আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ কী করতে পারে? যদি এমন হতো যে বিশ্বের সব দেশ এগিয়ে গেছে, আমরাই শুধু পিছিয়ে আছি তাহলে না হয় বর্তমান সরকারের উপর দোষ দেওয়া যেতো। কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্বের উন্নত-উন্নয়নশীল সবদেশই দারুণ সংকটের মুখে আছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কী করণীয় আছে সেই পরামর্শ না দিয়ে যারা জনবান্ধব, উন্নয়নশীল সরকারকে উৎখাত করতে চায়, তারা দেশদ্রোহী ছাড়া আর কী?


বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ। এদেশের মাটি, পানি, জলবায়ু, কর্মঠ মানুষকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বিশ্বের বুকে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলই যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে এদেশের নিরন্ন, নিপীড়িত মানুষ খেয়েপরে ভালো থাকে, দেশ উন্নত হয়, এটা পরীক্ষিত সত্য। আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারো হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ নয়। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী লীগকেই সমর্থন দেওয়া প্রয়োজন। আশা করি এদেশের দেশপ্রেমিক মানুষ দেশ-জাতির সংকট মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যোগ্য নেতৃত্বদানকারীকেই বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় বহাল রাখবে। এ ক্ষেত্রে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই বলেই এদেশের মানুষ বিশ্বাস করে।


-মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.