কবি তোফাজ্জল হোসেন : জনারণ্যে মিশে পাওয়া অনন্য-স্বজন

কবি তোফাজ্জল হোসেন : জনারণ্যে মিশে পাওয়া অনন্য-স্বজন

মোনায়েম সরকার: নাতিদীর্ঘ আকৃতির কিন্তু বড় মাপের, উদার মানুষ ছিলেন কবি তোফাজ্জল হোসেন। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা-আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত থেকে অনন্য-গৌরবের অধিকারী হন। ১৯৫৩ সালে কবি-সংকলক হাসান হাফিজুর রহমান ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শিরোনামের যে ঐতিহাসিক সংকলনগ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন সেই সংকলন গ্রন্থে যে দুটি গীতিকবিতা গৃহীত হয়েছিল তার প্রথমটি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর। দ্বিতীয়টি লিখেছিলেন কবি তোফাজ্জল হোসেন। যার প্রথম পঙ্ক্তি- ‘রক্ত শপথে আমরা আজিকে তোমারে স্মরণ করি, একুশে ফেব্রুয়ারী’। মাত্র সতেরো বছর বয়সের যে প্রদীপ্ত তরুণকে কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্মানের শিরোপা প্রদান করেছেন তিনিই পরবর্তীতে হয়ে উঠেছেন নিপীড়িত মানুষের নির্ভীক ভাষ্যকার।

তোফাজ্জল হোসেন একই সঙ্গে ভাষা-সংগ্রামী ও কবি। তাঁর এই দ্বৈতসত্তার জন্য অনায়সেই তিনি ‘ভাষা সৈনিক’ উপাধিতে বিভূষিত হওয়ার যোগ্য। কবি তোফাজ্জল হোসেন শুধু ভাষার জন্যই সংগ্রাম করেননি, তিনি বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামেও অগ্রগামী ছিলেন। একজন প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে তোফাজ্জল হোসেনের কৃতিত্ব বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিন ভুলবে না।

কবি তোফাজ্জল হোসেন ১৯৩৫ সালের ৯ অক্টোবর কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। আমিও জন্মসূত্রে কুমিল্লার সন্তান। তোফাজ্জল ভাই আমার চেয়ে দশ বছরের বড় হলেও আমরা দুজন বন্ধুর মতো মিশেছি। একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই-সংগ্রামে শামিল হয়েছি। কোনোদিন কোনো কারণে তোফাজ্জল ভাইয়ের মলিন মুখ দেখিনি। কবি তোফাজ্জল হোসেন একজন সদালাপী, পরোপকারী মানুষ ছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ন্যাপের জনসংযোগ কর্মী হিসেবে বহুবার বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেছি, তাঁর যেকোনো নির্দেশ পালন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন প্রয়োজনে যত বারই আমি সচিবালয়ে গিয়েছি, ততবারই তোফাজ্জল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছি। আলাপ করেছি, ঋদ্ধ হয়েছি। তিনি মাঝে মাঝে গোপন খবরও দিতেন।  চাকরি জীবনে তিনি শীর্ষ পদ অলংকৃত করেছেন বটে, তবে বঞ্চিতও কম হননি। রাষ্ট্র যেমন তাকে বঞ্চিত করেছে, তেমনি প্রবঞ্চনা করেছে সুযোগসন্ধানী সহকর্মীরা। নানাভাবে বঞ্চিত হয়েও তিনি কোনোদিন অভিমান করেননি। সরে যাননি রাজপথ থেকে। পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও সাংস্কৃতিক আলোন্দনসহ নানামুখী কর্মকা- তিনি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন। তিনি মুকুল ফৌজ, আজাদ স্পোটিং ক্লাব, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, শিশু কল্যাণ পরিষদ, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি, সাংবাদিক ইউনিয়ন, জাতীয় প্রেস ক্লাব, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট প্রভৃতি সংগঠনে এবং ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড, জুরী বোর্ড ও স্ক্রিপ্ট কমিটির সাবেক সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

কবি তোফাজ্জল হোসেনের সুযোগ্য সন্তান, স্নেহভাজন কবি তারিক সুজাত আমাকে অনুরোধ করেছে তোফাজ্জল ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে। তোফাজ্জল ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গেলে সামান্য কথায় তা ধারণ করা সম্ভব নয়। প্রায় পঁচতাল্লিশ বছরের বন্ধুত্ব কি সামান্য কথায় প্রকাশ করা সম্ভব? তোফাজ্জল হোসেনকে নিয়ে নিশ্চয়ই আরো অনেকে স্মৃতিচারণ করবেন। আমি সেপথে না গিয়ে কবি তোফাজ্জল হোসেনের কবিতা নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই। তাতে তাঁর স্মৃতি ও কর্ম দুই বিষয়েই কথা বলা হবে।

কবি তোফাজ্জল হোসেন ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতাচর্চার কাল সুদীর্ঘ হলেও সৃষ্টিসম্ভার তেমন বিশাল ও বিপুল নয়। তিনটি পূর্ণাঙ্গ কাব্য- ‘হৃদয় রক্তরাগে’, ‘একুশ ভুবনময়’, ‘নতুন যুগের ভোরে’, কিছু অগ্রন্থিত কবিতা ও কিছু উর্দু-রুশ অনুবাদ কবিতা- এই হলো তাঁর সৃষ্টির পরিধি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রায় তিন শতাধিক কবিতা (গানসহ) তিনি রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই তিনশ’ কবিতাই তিন হাজার কবিতার সমান আলো ছড়িয়েছে বাংলার জমিনে। বিচিত্র বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবি তোফাজ্জল হোসেন। ১৯৫২ সালের প্রেক্ষাপটে যেমন তিনি একুশের কবিতা ও গান রচনা করেছেন, তেমনিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছেন কবিতার পঙ্ক্তিকে অস্ত্র বানিয়ে।

মানবিক বোধের কবি তোফাজ্জল হোসেনের কবিতায় বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। অন্তত আমি লক্ষ্য করি। স্বভাষা ও স্বদেশপ্রেম তোফাজ্জল হোসেনের কবিতার প্রধান সুর- এ কথা নিঃসন্দেহে উত্থাপন করা যায়। দেশপ্রেমের সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত থাকে, যেমন- প্রকৃত-সমাজ-বিজ্ঞান-দর্শন-জীবন। দেশপ্রেমের পূর্বশর্ত আত্ম-উৎসর্গের মনোবৃত্তি। দেশের প্রয়োজনে যে-কবি জীবন উৎসর্গ করার সাহস করেন না, তাঁর পক্ষে দেশপ্রেমিক কবি হওয়া সম্ভব নয়। কবি তোফাজ্জল হোসেন বাংলাদেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম- উনিশ শ’ বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলন, উনিশ শ’ একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও উনিশ শ’ নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে স্লোগান ধরেছেন। মৃত্যুর ভয় কখনোই তাঁকে বিচলিত করেনি। কেননা স্বাধীনচেতা এই কবি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন-

            “স্বাধীনতা এক রক্ত গোলাপ ফুল

            বিশ্বে কিছুই নয় তার সমতুল॥”

উদ্ধৃত পঙ্্ক্তিদ্বয়ের ‘রক্তগোলাপ’ শব্দটির প্রতি দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায় তাঁর প্রকৃত মনোভাব দেশের প্রতি বুক ভরা ভালোবাসা ছিল কবি তোফাজ্জল হোসেনের। তাঁর ‘একুশ ভুবনময়’ গীতিকবিতা গ্রন্থের একটি গীতিকবিতায় তিনি বলেছেনÑ

            “একটি দেশের ভালোবাসা মোর হৃদয়-পরতে মাখা

            একটি দেশের মানচিত্রই আমার হৃদয়ে আঁকা।

            এ দেশ আমার বিশ্বভূবন

                        সোনার বাংলাদেশ

            রক্ত কণায় সদা জাগ্রত

                        মূর্ত অনিঃশেষ।”

উপরিউক্ত ছয় ছত্রে মাতৃমাটির প্রতি যে নিবিড় মমত্ব ব্যক্ত হয়েছে- তা বর্ণনাতীত। দেশাত্মবোধক কবিতায় কবি তোফাজ্জল হোসেন যেসব চিক্রকল্প ব্যবহার করেছেন তা আবেগে মাখানো, আদরে জড়ানো। একটি সুন্দর দেশ আকাক্সক্ষা করে কবি যেসব শব্দসৌরলোক সৃষ্টি করেছেন কবিতাপাঠক তা দেখে চমকিত হতে বাধ্য। কবি তোফাজ্জল হোসেনের কবিতার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো ‘প্রতিবাদ’। তিনি পরাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, শোষণ-নির্যাতন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে।

কবি তোফাজ্জল হোসেনের সম-সাময়িক অনেক কবির কবিতায়ই দেশপ্রেম-প্রতিবাদ-সংহতির আহ্বান লক্ষ্য করা যায়। এমন কি ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের বহু কবিই ওই সব লক্ষণাক্রান্ত। তারপরেও তোফাজ্জল হোসেনের কবিতা কবিতাপ্রেমীদের আকর্ষণ করে, তপ্ত মনে তৃপ্তি এনে দেয়। এ কথা ঠিক যে, তোফাজ্জল হোসেনের কবিতার আঙ্গিকে ও বিষয়ে কোনো নতুনত্ব নেই, কিন্তু উপস্থাপনায় ও কাব্যকলায় তাঁর পারদর্শিতা প্রশ্নাতীত।

আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠতম কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ‘অসমাপ্ত আলোচনা’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ লেখেন ১৩৬০ বঙ্গাব্দে। পরে এটি ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধগ্রন্থে সর্বশেষ প্রবন্ধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ‘অসমাপ্ত আলোচনা’ প্রবন্ধের এক জায়গায় জীবনানন্দ দাশ বলেছেন- ‘পুরোনা পদ্ধতিতে কবিতা লিখলেই সেটা নিরর্থক হয় না।’ কথাটা কার কাছে কেমন লাগে জানি না, আমি এই বাক্যে সহমত পোষণ করি। কবি তোফাজ্জল হোসেন পুরাতন পদ্ধতিতে কবিতাচর্চা করেই সিদ্ধি লাভ করেছেন।

আধুনিক কবিতার একটি প্রধান প্রবণতার নাম ‘সংক্ষেপণ’। খ-তায় বিশ্বাস করে বলেই হয়তো আধুনিক যুগে ‘খ- কবিতা’ বেশি দেখা যায়। দীর্ঘ কবিতা, শ্লেষধর্মী কবিতা- এ যুগের মনোরঞ্জনে ব্যর্থ। তোফাজ্জল হোসেন বেশ কিছু দীর্ঘ কবিতা লেখেছেন, যেগুলোর গঠন শৈলী আঁটোসাঁটো এবং অলঙ্কারসমৃদ্ধ। ‘নতুন যুগের ভোরে’ কাব্যগ্রন্থে বেশ কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা আছে। এগুলো পাঠ করলে সহজেই কৈশোরে ফিরে যাওয়া যায়, ফিরে পাওয়া যায় কৈশোরের নিরাবিল সারল্য। বাংলার বাউলেরা সহজ প্রেমের যে-বাণী প্রচার করেন, ‘নতুন যুগের ভোরে’ গ্রন্থে সেই সহজ প্রেমের ভাব ও মাধুরী অনুভব করা যায়।

আমি কবিতার সমালোচক নই, পাঠক মাত্র। কবি তোফাজ্জল ভাইয়ের কবিতার সমালোচনা আমার পক্ষে করা অসম্ভব। বিদ্যায়-জ্ঞানে-বয়সে-অভিজ্ঞতায় তিনি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন। তাঁর কবিতার একজন মুগ্ধপাঠক হিসেবে আমি আমার অনুভূতি ব্যক্ত করলাম মাত্র। হয়তো অগ্রজ কবি জীবিত থাকলেও আমি তাঁর সামনে এভাবেই আমার কথা তুলে ধরতাম। তোফাজ্জল হোসেন শুধু কবি ছিলেন না তিনি একজন চিন্তাশীল সুলেখক ও অনুবাদক ছিলেন। সাংবাদিক পেশায় দীর্ঘকাল যুক্ত থেকে জীবনকে অনেক কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি। তাঁর অন্যান্য মূল্যবান গ্রন্থের মধ্যে আছে- (১) জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ও আগামী পৃথিবী, (২) শিশু : বিশ্ব ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট, (৩) বিপন্ন পৃথিবী বিপন্ন জনপদ, (৪) কাশ্মীর : ইতিহাস কথা জয়, ও (৫) জাতিসংঘ। এসব গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করলে লেখা দীর্ঘ হবে, অন্য কোথাও এসব নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রাখি।

আমরা আজকাল কবিতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এটা খুবই অশুভ লক্ষণ। অতিবিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস যখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে তখন মানুষের মনে এক ধরনের বিকার লক্ষ্য করা যায়। আমরা এখন বিকারগ্রস্ত-মহামারীর যুগে বসবাস করে মানবিকবোধ হারাতে বসেছ। আমাদের এখন জরুরি দরকার কবি তোফাজ্জল হোসেনের মতো ত্যাগী কবি পুরুষদের লেখা পাঠ করা। আমাদের মনে রাখা দরকার- যারা আলোর বাহক তারাই কেবল আলো দিতে পারে।

তোফাজ্জল ভাই একজন সার্থক পিতা ছিলেন। তার পারিবারিক পরিম-ল কবিতা-সঙ্গীত-শিল্পকলার নান্দনিকতা দিয়ে সাজানো। তাঁর পুত্র তারিক সুজাত বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি। পুত্রবধু নাজনীন হক মিমি লেখক, দুই নাতি তামিম সুজাত ও আইদিদ হোসেন কবিতা লেখে। অর্থাৎ, তাঁর স্বজন-পরিজনদের মানসগঠনেও তোফাজ্জল ভাইয়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কবি তোফাজ্জল হোসেন আমার পরমাত্মীয় ছিলেন, তিনি ছিলেন জনারণ্যে মিশে পাওয়া অনন্য-স্বজন। আমার স্মৃতিতে তিনি ও তাঁর বেশ কিছু কবিতা অমর হয়ে থাকবে।

০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.