কবি-সংগঠক রবিউল হোসাইন : কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি

কবি-সংগঠক রবিউল হোসাইন : কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি

মোনায়েম সরকার: রবিউল হোসাইন স্থপতি ছিলেন। স্থপতি হিসেবে তিনি যথেষ্ট সুনামও কুড়িয়েছিলেন। তার স্থাপত্য-সৌকর্য নিয়ে আলোচনা করার যোগ্য আমি নই। সে প্রসঙ্গে আমি কোনো কথা বলতেও চাই না। আমি বলতে চাই, কবি-সংগঠক রবিউল হোসাইনের কথা। কবি রবিউল হোসাইন আর আমাদের মাঝে নেই এ কথা ভাবতেই মনটা কেমন বিষণœ হয়ে ওঠে। কতদিনের কত স্মৃতি আছে তার সাথে আমার, সেসব স্মৃতি থেকে দুই-একটি স্মৃতিচারণ করার জন্যই আজ এই লেখার অবতারণা।

কবি রবিউল হোসাইন একজন সদালাপী মানুষ ছিলেন। তাকে প্রথম দেখি স্থপতি মাযহারুল ইসলামের ‘বাস্তুকলাবিদে’। এই বাস্তুকলাবিদেই তখনকার দিনের স্থপতিদের হাতেখড়ি হতো। বিখ্যাত স্থপতি আলমগীর কবিরও এই বাস্তকলাবিদেই ছিলেন। রবিউল আমার সমবয়েসী হলেও আমাদের সম্পর্কের মধ্যে একটা শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মানের বিষয় সবসময়ই ছিল। তাকে আমি ভালোবাসতাম, তিনিও আমাকে ভালোবাসতেন। আমাদের ভালোবাসায় একটা অন্যরকম গভীরতা ছিল।

১৯৮৫ সালের ঘটনা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে ঐতিহাসিক স্থানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই স্থানটিকে চিহ্নিত করার জন্য আমি একটি পাথরের ফলকে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ লিখে স্থাপন করি। আমার এই কাজে সেদিন যারা সহযোগিতা করেন তাদের মধ্যে স্থপতি মাযহারুল ইসলাম ও কবি রবিউল হোসাইন অন্যতম।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার সঙ্গে রবিউল হোসাইন একাত্ম ছিলেন। যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় সে সময়ের কিছু ঘটনা আমি অবগত ছিলাম। রবিউল হোসাইন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একজন ট্রাস্টি ছিলেন এবং তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে।

বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের প্রস্তাব শেখ হাসিনা কর্তৃক গৃহীত হওয়ার পরে এই জাদুঘরের নকশা কেমন হবে এটা নিয়ে স্থপতি মাযহারুল ইসলাম ও স্থপতি রবিউল হোসাইন বলেন, জাতীয়ভাবে কম্পিটিশন করে স্থপতিদের কাছ থেকে আমরা নকশা আহ্বান করবো এবং যে তিনজন বিজয়ী হবেন তাদের আমরা পুরস্কৃত করবো।’ শেখ হাসিনা প্রথম প্রথম এ প্রস্তাবে রাজি হননি। পরে অবশ্য রবিউল হোসাইন ও অন্যান্যদের আন্তরিকতায় অভিভূত হয়ে তিনি এ প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন, গ্লাস টাওয়ার ও ভূ-গর্ভস্থ জাদুঘরসহ যে বিশাল পরিকল্পনা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গৃহীত হয় সেই পরিকল্পনা বিএনপি এলে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়। গ্লাস টাওয়ারের পরিবর্তে ইট দিয়ে টাওয়ার করার নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আমি এসব কিছুই জানতাম না। রবিউল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওই কমপ্লেক্স বাস্তবায়ন কমিটিতে ছিলেন। রবিউল এসে একদিন বললেন, ‘মোনায়েম ভাই, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপনাদের পরিকল্পনা বানচাল করে যেনতেনভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনের কাজ করা হবে।’ এ কথা শুনে আমি প্রতিবাদ করে কাগজে কলাম লিখলাম। যেভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কমপ্লেক্স পরিকল্পনা করা হয়েছে সেভাবে না করলে জাতি তা মেনে নিবে না। বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাজ বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পুনরায় সে কাজ শুরু করে এবং গ্লাস টাওয়ার নির্মিত হয়। আমাদের গ্লাস টাওয়ারই পৃথিবীর সর্বোচ্চ গ্লাস টাওয়ার। তবে এখনো কিছু কাজ অসমাপ্ত আছে। যা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কবি রবিউল হোসাইনের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। কবিতা পরিষদ গঠনের শুরু থেকেই রবিউল হোসাইন জড়িত ছিলেন এবং তিনি দীর্ঘদিন কবি পরিষদের পক্ষে কাজ করে গেছেন। যেহেতু তিনি স্থপতি ছিলেন, তাকে অনেক মানুষই চিনতো-জানতো। তিনি কখনো স্পন্সরের জন্য কারো কাছে হাত পাতলে কেউ তাকে খালি হাতে ফিরাতেন না। নিজ যোগ্যতায় তিনি কবিতা পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

একবার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় রবিউলের। সেই যাত্রায় বেঁচে ফেরেন তিনি। জীবনের অনেক অভ্যাসই তখন তিনি স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়েছিলেন। বেশ ভালোই ছিলেন সেই থেকে। হঠাৎ তাকে মৃত্যু এসে না ফেরার দেশে নিয়ে যাবে এটা ভাবতেই পারিনি।

কবি রবিউল হোসাইনের মরদেহ দেখতে তার বাসভবনে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইচ্ছে করলে প্রধানমন্ত্রী শুধু একটি শোকবাণী প্রেরণ করেই তার দায়িত্ব শেষ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে সশরীরে কবি রবিউলের বাসভবনে যান এবং রবিউলের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। কবি রবিউলের গৃহে প্রধানমন্ত্রীর আগমনই প্রমাণ করে দেশ-জাতির কল্যাণে রবিউল হোসাইন কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।

কবির কখনো মৃত্যু হয় না। কবি হয়তো শারীরিকভাবে আমাদের মধ্য থেকে অনুপস্থিত হতে পারেন কিন্তু তার মননশীল অস্তিত্ব দেশ-জাতি সর্বক্ষণ অনুভব করে। অজাতশত্রু রবিউল হোসাইনের উপস্থিতিও জাতি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে। যখনি আমাদের দেশে অন্ধকার নেমে এসেছে তখনি কবি সংগঠক রবিউল হোসাইন সমমনা মানুষের সঙ্গে হাত ধরে রাজপথে দাঁড়িয়ে গেছেন। বুক ফুলিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। ইচ্ছে করলে তিনি শুধু কবিতা লিখেই অন্যায়ের বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করতে পারতেন, কিন্তু তিনি শুধু লেখনীর মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সমাজের একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে তিনি তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন।

আমার সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে একটি সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। জন্মদিন উদ্যাপন কমিটি রবিউল হোসাইনের কাছে একটি লেখা চাইলে রবিউল অত্যন্ত আবেগঘন একটি কবিতা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে লিখে জন্মদিন উদ্যাপন কমিটিকে দেন। সেসময় অনেকেই লেখা দিচ্ছি-দিবো বলে কালক্ষেপণ করলেও রবিউল হোসাইন কোনো কালক্ষেপণ করেননি। তার আন্তরিকতায় সবার মতো আমিও ভীষণ মুগ্ধ। বর্তমান সময়ে কথার লোকের অভাব না থাকলেও কাজের লোকের খুবই অভাব। রবিউল কাজ-পাগল মানুষ ছিলেন। একবার কোনো কাজে হাত দিলে তিনি তা শেষ না করে ক্ষান্ত হতেন না। যারা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন এ কথা তারা সকলেই স্বীকার করবেন।

একজন প্রগতিশীল মানুষ সবসময়ই অসাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হন। এ প্রসঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কথা মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি লেখায় পড়েছিলামÑ ‘আমি হিন্দু’, ‘আমি মুসলমান’, এ কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল, কিন্তু ‘আমি মানুষ’ এ কথা কাহাকেও বলতে শুনি না, যারা মানুষ নয়, তারা হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, তাদের দিয়ে জগতের কোনো লাভ নেই।’ রবীন্দ্রনাথের এ কথা কবি রবিউল হোসাইন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। রবিউল সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। মানুষের উপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। তার কবিতা পড়লে এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। 

আজ রবিউল আমাদের মাঝে নেই। তাঁর অসংখ্য সুপাঠ্য কবিতা আমাদের মাঝে আছে। আছে তার নান্দনিক স্থাপনাশৈলী। যতদিন তার এই অসামান্য কর্মগুলো মানুষের মাঝে থাকবে, মানুষ তাকে ততদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।  অকাল-প্রয়াত কবি-সংগঠক রবিউল হোসাইনের বিদেহী আত্মার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। 

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট

২৮ নভেম্বর, ২০১৯

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.