মাদকের থাবা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে দেশকে? সামনের দিনগুলোতে আরও যে কতো ভয়াবহ, নৃশংস ঘটনাবলী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য তা কে বলতে পারে।
সম্প্রতি কিশোরী মেয়ে ঐশী কর্তৃক তার বাবা-মা খুন হবার নৃশংস ঘটনার প্রেক্ষিতে আবার বেশ জোড়ে-সোরেই উঠে এসেছে মাদক প্রসঙ্গ। মাদকের ভয়াবহ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে সর্বত্র। গরম চায়ের কাপে টিভি চ্যানেলগুলোতে ফুঁসে উঠছে টকে-শো। পত্র-পত্রিকায় চলছে গরম ভাষণ-বিবৃতি, বক্তব্য।
জানি সেসব শুধুই নিজেদের আত্মপ্রচারে প্যাচালের জন্যই প্যাচাল। বড় কথা হচ্ছে, কন্যা কর্তৃক পিতা-মাতা হত্যাকান্ডের এ ঘটনা প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে সাধারণ মানুষকে। বিবেক হয়েছে স্তম্ভিত। সমগ্র জাতি হতবিহ্বল! আর তাই তাদের কন্ঠে আবারো সেই একই প্রশ্ন, ‘মাদকের ভয়াবহ থাবা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’
এমন না যে এ সমস্যাটা রাতারাতি গজালো। এটা অনেক পুরোনো সমস্যা তো বটেই; পাশাপাশি গোড়া থেকেই ভয়াবহ! বিবেকী মানুষ সেই থেকেই আতঙ্কিত। সোচ্চার। কিন্তু বিবেক বিবর্জিত স্বার্থান্বেষী মানুষ এবং প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় এ সমস্যা দিন দিন ফুলে-ফেঁপে বেড়েছে। খোদ বিগত সরকারগুলোরও এ নিয়ে তেমন একটা মাথাব্যাথা ছিলো বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়নি, বা হচ্ছে না।
আসলেই এ নিয়ে দেশে কি ভাবার কেউ আছে? আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের রাজনীতি নিয়ে কামড়া-কামড়ির বাইরে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু দেশে আছে বলেও মনে হয় না। অপরদিকে কিইবা দায়িত্ব পালন করছে সমাজপতিরা?
আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার নিজ গৃহেইবা কী করে ঢুকে যায় মাদকদ্রব্য? কি করেই বা তার সন্তান মাদকের শিকার হন? আর যদি এই হয় চিত্র তবে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারীদের প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থাই বা পাবে কীরে! যারা নিজেদের ঘরকেই অপরাধমুক্ত রাখতে পারেন না, নিজ সন্তানদেরই অপরাধের করাল গ্রাস থেকে দূরে রাখতে চরম ব্যর্থ, এমনকি নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিজেই নিশ্চিত করতে পারেন না; তারা তারা কী করে অন্যের জীবনের নিরাপত্তা দেবে? কী করে জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? প্রশ্নগুলো স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়।
অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, পুলিশের এই কর্মকর্তা স্ত্রীসহ নিজে নিজ সন্তানের হাতে খুন হয়ে একটি নিরেট সত্যকেই জাতির সামনে তুলে ধরলেন, আর তা হলো, আমাদের আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই কতোটা শৃংখলাহীন!
একজন পুলিশ অফিসারের যেখানে মাদকদ্রব্য এবং মাদকাসক্তদের প্রতিহত করাটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব; সেখানে তার ঘরেই যদি মাদকের বিস্তৃতি ঘটে, তার সন্তানই যদি মাদকের হাতে বলি হয়, এবং তিনি নিজেই যদি মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে খুন হন তবে তার চাইতে একটি দেশের জন্য, একটি জাতির জন্য দুঃখজনক আর কী হতে পারে!
এমন বাস্তবতায় আবেগ কোনো প্রশ্রয় পেতে পারে না। অন্তত পক্ষে আমি তা দেবো না।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় ঐশীর নাকি মাসিক হাতখরচ ছিলো এক লাখ টাকা। জানিনা সংবাদটা কতোটুকু সত্যি, তবে তা যদি সত্যিই হয় সেখানে প্রশ্ন এসে যায়, এতো টাকা কিশোরী মেয়ে ঐশী পেতো কোথায়? এ টাকার উৎস কোথায়? কে দিতো তাকে এই টাকা?
এদিকে সবচাইতে ভয়াবহ বার্তাটি হচ্ছে, সমাজের কিশোর-তরুণ সমাজ যেহারে মাদকাসক্তদের খাতায় নাম লেখাচ্ছে, তাতে সমাজ সচেতন বিবেকী মানুষ তো বটেই প্রতিটি বাবা-মা আজ উদ্বিগ্ন। আতঙ্কিত।
এ কথা আজ অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘কন্যার হাতে নয়; পুলিশ দম্পতি খুন হয়েছেন ইয়াবার হাতে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, এই ইয়াবা কাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও নজরদারীতে বিস্তৃতি লাভ করছে?
আসলে ঐশী কিংবা ইয়াবা কেউই নয়; আমরা নিজেরাই নিজেদের খুন করছি। আমাদের কর্তৃপক্ষীয় একটা শ্রেনী আপন নগ্ন স্বার্থনেশায় সে পথকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে; করে দিচ্ছে প্রসারিত। এর যে আরো কতো কঠিন মূল্য কাকে কিভাবে দিতে হবে সেটা একমাত্র ভবিতব্যই বলতে পারেন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত আর এক তথ্য থেকে জানা যায়, গত মাত্র এক বছরে নেশাগ্রস্ত সন্তানের হাতে খুন হয়েছেন অন্তত দুই ডজনের ওপরে বাবা-মা। কী নির্মম তথ্য! কী ভয়াবহ ভবিষ্যতের আগাম বার্তা!
বর্তমানে দেশব্যাপী নিয়ন্ত্রণহীন মাদকের গতি। । মাদক নির্মমভাবে কেড়ে নিচ্ছে তারুণ্য, মেধা, বিবেক, লেখাপড়া ও মনুষ্যত্ব-সবকিছু। বিনষ্ট করছে স্নেহ-মায়া, ভালোবাসা, পারিবারিক বন্ধন। কেন? কাদের পৃষ্ঠপোষকতায়? কোথায় আমাদের আইন? কোথায় আমাদের শৃংখলা? প্রশ্নটা খোদ আইন-শৃংখলা কর্তৃপক্ষের কাছেই রইলো।
পরিশেষে বলবো, আজ কিশোরী ঐশীকে নিয়ে পুলিশ, সাংবাদিক, আইন-আদালত যেভাবে টানাহ্যাঁচড়া করছে সে থেকেও উঠে আসছে নানা প্রশ্ন। ঐশী ইস্যুতে সংবাদপত্রগুলোর ভূমিকাও নানাভাবে সমালোচিত হচ্ছে। অনেক পাঠকের মন্তব্য হচ্ছে, একেক পত্রিকা একেক রকম সংবাদ পরিবেশন করছে; তাতে পাঠকের কাছে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কোন সংবাদটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা যাচাই করা কঠিন। আবার কোনো কোনো পত্রিকা ঐশী চরিত্রের বাজে দিকগুলোকে এমন ফলাও করে প্রকাশ করছে তাতে রুচিশীল পাঠক যেমন বিরক্ত হচ্ছেন পাশাপাশি এর প্রভাব ঐশীর বয়সী অনেক কিশোরীর ওপর পড়তে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন। কাজেই এ জাতীয় ইস্যুতে আমাদের সংবাদপত্রগুলোকে আরো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া উচিত।
অবশ্য সময়ের স্বাভাবিক নিয়মেই ঐশী ইস্যুটা দিনে দিনে থিতু হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি মাদক ইস্যুও মিলিয়ে যাবে জাতির চোখের সামনে থেকে। আবার কোনো ভয়াবহ ঘটনার পর সেটা পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে..আবার বইবে আলোচনা পর্যালোচনার ঝড়। নেতা-নেত্রী, সমাজপতিরা কইবে কত্তো কথা! তবে দিনে দিনে আমাদের ঘর যে সর্বগ্রাসী মাদক গ্রাস করে নিচ্ছে, আমরা কি কেউ সর্বদা রাখবো সে খবর? না। অন্তত অতীত অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। হয়তো আবার কোনো মা-বাবার করব দেখে করবো উহু আহঃ, চিৎকার করে ক্ষোভ ঝরিয়ে বলবো, মাদক তুই নিপাত যা; ব্যস, আবার থিতু! এটা আমাদের চরিত্রেরই একটা বৈশিষ্ঠ্য।
mhniru@gmail.com
-ক্যালগেরি, ৩১ আগষ্ট ২০১৩।