গল্প / ডিভি

গল্প / ডিভি

ডিভি

মেসের রুম এরকম গোছানো হবার কথা না। শাহেদ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে সব। রুমমেটরা বলে,তুই মেয়ে হলে সবাই মিলে বিয়ে করতাম রে। তিনজনের একটাই বউ। আমাদের নয়ন হয়ে থাকতিস। তৃতীয় নয়ন না তিন জনের নয়ন। শাহেদ হাসে। মনে করে না কিছু।


 

শান্তিবাগের এই মেসে ওরা চারজন একটিমাত্র রুম শেয়ার ক’রে থাকে। হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে ডিগ্রী ভর্তি হয়েছে শাহেদ। অন্যান্যরা যে যার পছন্দমত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে। ঢাকা শহরে এরকম বাড়ি বা কামরা চোখে পড়ে না। ছোট্ট রুম, কাঠের মেঝে আর টিনের চাল। রুমের পাশে টয়লেট আর রান্নাঘর। দুটো খাট বসিয়ে এক কোণায় আলনা রাখা হয়েছে। অতি ছোটো দুটো টেবিলও আছে। যে যখন রুমে থাকে সে-ই সুযোগ পায় তা ব্যবহার করার। শাহেদ বেশীরভাগ সময় বিছানায় ব’সে বা শুয়ে শুয়ে পড়ে। পড়তে পড়তে প্রায়ই ঘুমিয়ে যায়। দিনে বা রাতে একই ব্যাপার। রুম থেকে ধনুকের মতো পথ বাঁক নিয়েছে মসজিদটার কোণায়। তারপর সোজা এসে মিলেছে মালিবাগ মোড়ে। প্রতিদিনের মতো ক্লাসে যাচ্ছে শাহেদ। হেঁটেই যায় ও। মালিবাগ মোড়ে কত কত গাড়ী এসে থামছে। মৌচাকের দিক থেকে মৌমাছির মতো ঝুলন্ত মানুষ সহ বাসগুলো দড়াম ক’রে দাঁড়াচ্ছে মোড়ে। রিকশার ক্রিং ক্রিং আওয়াজ, মানুষের ভিড় সবমিলিয়ে জনকোলাহলের এই উৎসব প্রায় প্রতিদিন দেখতে হয়। এসব দেখে কোনো যানবাহনে যেনো না উঠতে হয় তাই কলেজের কাছাকাছি মেস নিয়েছিলো। রাস্তার একপাশ দিয়ে একমনে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের গেইট এসে যায়।

 

ডিভি

ঢাকার মতো বড়ো শহরে শাহেদের মাত্র বছর দুয়েক হতে চললো। ক’মাস মাত্র আছে  ডিগ্রী পরীক্ষার। এরপর মন ভরে গ্রামের বাড়ি থাকা যাবে বেশ কিছু দিন। গ্রামের স্কুলে এসএসসি পর্যন্ত পড়লেও ওর বাবা বশির মোড়ল ছেলেকে শহরের কলেজ থেকেই এইচএসসি পাশ করিয়েছেন। একমাত্র ছেলেকে চোখের আড়ালে, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে রেখে পড়িয়েছেন স্ত্রীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কারনে অকারনে শাহেদ বাড়ি আসলে মা খুশি হতেন। বাবা আনন্দ চেপে কপোট বকায় ছেলেকে পড়ার তাগাদা দিতেন।

 

ভালুকা উপজেলার বাটাজোর গ্রাম শিক্ষানুরাগির অঞ্চল বললে কম বলা হয়। প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল আর কলেজ ত্রিকোণ প্রিজমের মতো আলো বিলোয় চারদিকে। বাটাজোর বাজারের কিনার দিয়ে স্কুল ও কলেজের দেয়াল ছুঁয়ে চওড়া রাস্তা শাহেদদের বাড়ির পাশ ঘেঁষে গিয়েছে দূরে। মাটির পথ। বালুময়। রোদের সময় ধবধবে হয়ে থাকে। বৃষ্টি শুষে নিয়ে জেগে ওঠে নীল সমুদ্রের বুকে সাদা সাবমেরিনের মতো। এই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতো শাহেদ। ধুলোয় দু’পা পাউডারের মতো হয়ে থাকতো। বাড়ির আঙিনার ধুলো কখনও ফেলে আসতো স্কুলের সবুজ ঘাসে কখনও বা খেলার মাঠের সবুজতা মাখানো ধূলিকণা বয়ে আনতো বাড়িতে। মা একহাতে বদনায় পানি ঢেলে অন্যহাতে ডলে ডলে ধুয়ে দিতেন হাঁটুর নিচ থেকে পা’র পাতা পর্যন্ত।

 

কলেজের গেইটের কাছে হালকা একটু হোঁচট খেলো শাহেদ। জুতোর আগায় ছোট একটা ইটের টুকরো এসে গিয়েছিলো। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটায় ব্যথা করছে একটু। নুয়ে জুতোর আগা চেপে আঙুলটা ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। সামনে একজোড়া পা দাঁড়ানো দেখতে পেলো শাহেদ। সুন্দর ছইওয়ালা জুতোর জানালা দিয়ে আভাময় দুটো পা স্থির হয়ে আছে। পদ-আলোয় উজ্জ্বল হলো শাহেদের চোখ। ব্যথা বুঝতে পারলো না আর। মিহিন আওয়াজ কানে এলো।

‘নিজের পায়ে সালাম করছিস ক্যান, আমার পা ছোঁ, লাভ হবে’।

সোজা হয়ে দাঁড়াল শাহেদ। মিতা হাসছে। এই মেয়েটা মনে হয় অদৃশ্য হতে জানে। তা-না হলে হুট হুট ক’রে কোথা থেকে যে দৃশ্যবতী হয়। পিলে চমকায়!

‘তুমি হঠাৎ, এক সেকেন্ড আগে তো দেখলাম না?’ শাহেদ কোনোরকমে বললো।

‘আমি সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ভেতর দৃষ্টিগ্রাহ্য হতে পারি, জানিস তো?’

জানা অজানার হিসেব করার সময় কম। ক্লাস শুরু হবে। শাহেদ ব্যস্ত হয়ে বললো, মিতা চলো, ক্লাস শুরু হবে এক্ষুণি’।

 

মিতা আর শাহেদ একই ক্লাসে। মিতা তুই বললেও শাহেদ তুমি’র নিচে নামতে পারে নি। এত জড়তা কেন যে হয় ওর। বুঝতে পারে না। গা ছম ছম করে সব সময়। একটু জোরে হাওয়া বইলেও মনে হয় কেউ বুঝি কী যেন বললো ওকে। আশপাশের সবকিছু ঠিক ঠিক বুঝে যায় ও। এই অযাঞ্ঝিত ভীরুতার ভেতর কী যেন দেখেছে মিতা। কতবার কলেজে আড়ালে আবডালে হাত ধরেছে ওর। ভীরু কবুতর ছানার মতো শাহেদের হাত অস্থির হয়েছে মিতার মোলায়েম মুঠোর ভেতর। মিতা ছাড়েনি। শক্ত ক’রে ধ’রে ওর লাল হয়ে ওঠা চোখ-মুখ দেখে মজা নিয়েছে।

ক্লাস শেষে মিতা বললো, এই ভীতু, আজ ফুট্ ক’রে চ’লে যাবি না। কথা আছে’।

শাহেদ ধোক গিললো। চোখদুটো ছলছলে ক’রে তাকালো।

‘তোকে নিয়ে আজ একটা জায়গায় যাবো, বেশি দূর না। পাঁচ মিনিটের রিকশার পথ। হাঁটাও যায় তবে ভিড়ের ভেতর হাঁটতে ভাল্লাগে না’।

‘কোথায়?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেগ করলো শাহেদ।

‘আমার নতুন চশমা বানাতে দিয়েছি, ঢাকা অপটিকসে, সেঞ্চুরি আর্কেডের পাশে ডা: মিজানের ওখানে’

শাহেদ কিছু বলার আগে একটা রিকশা ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। কোলে ওঠার মতো রিকশায় উঠে পড়লো মিতা। শাহেদ তখনও দাঁড়ানো। মিতা তাকালো ওর দিকে। ওর দৃষ্টি বলছে, নাহ ! তোকে নিয়ে পারা যায় না। ব’সে থেকে একহাত ধ’রে টেনে তুললো ওকে। হুড নামিয়ে দিলো মিতা।

 

গরমের দুপুর। রোদও খুব। শাহেদ ঘামছে। মিতা ওড়না উড়িয়ে বাতাস করছে নিজেকে। ওড়না ওড়াচ্ছে বেশ গোলাকার বৃত্ত ক’রে যাতে শাহেদের গায়েও বাতাসটা লাগে। মিষ্টি ঘ্রাণে শাহেদের গরম লাগা কিছুটা কম কম মনে হতে লাগলো। তেমন কোনো পারফিউমের গন্ধ নয়। অথচ আলাদারকমের একটা সুবাস লেগে থাকে মিতার গায়ে। এরকম কাছাকাছি এলে তা টের পায় শাহেদ।ওর ইন্দ্রিয় অবশ হয়ে আসতে চায়। মিতা যাতে বুঝতে না পারে তাই ঘন ঘন পলক ফ্যালে  আর মনযোগ এদিক ওদিক নেবার চেষ্টা করে।

 

‘ঘ্রাণটা তোর ভালো লাগে?’ আলতো মুখ ঘুরিয়ে দেখলো মিতা।

চমকে উঠলো শাহেদ। একবার শুধু তাকাতে পারলো। মিতা হাসছে। চিকন দুটো ঠোঁটের ভেতর ছোটো ছোটো সাজানো দাঁতের সারি ওদের বাড়ীর পাশের পথের মতো বিছিয়ে গেলো একটু।

 

ডিভিমেসে ফিরে দ্যাখে আবিদ চলে এসেছে। ওকে দেখে খিক্ খিক্ ক’রে হাসলো। শাহেদ বুঝতে পারলো না কিছু। জামাকাপড় ছাড়তে লাগলো। আবিদের হাসির সুর এখন অন্যরকম লাগছে।  হাসির সাথে শব্দ মিশিয়ে বলছে, তুই কী মিতাকেও নিয়ে যাবি নাকি আমেরিকায়? আসতে আসতে দেখলাম তোকে হেঁচড়ে তুলছে রিকশায়। তোর কাজে আসবে রে মেয়েটা। শাহেদ ঠান্ডা চোখে তাকালো আবিদের দিকে।

‘পিয়ন এসেছিলো, তোর ডিভি লেটার এসেছে। পোস্ট অফিসে যেয়ে নিয়ে আসতে হবে’। কথাগুলো ব’লে অন্যদিকে তাকালো আবিদ। যেনো তেমন কিছু হয়নি।

 

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার কথা ভুলে গেলো শাহেদ।  স্থির হয়ে বসে থাকলো বিছানায়। আবিদ খেয়ে দেয়ে আধশোয়া হয়ে পত্রিকা পড়ছে। একটু পর পর আড়চোখে তাকাচ্ছে শাহেদের দিকে। আস্তে ক’রে বললো, খেয়ে নে শাহেদ, আসাদ এলে আমরা যাবো পোস্ট অফিসে।

 

আসাদ এসে হৈ চৈ ফেলে দিলো। দরোজা বন্ধ ক’রে নিলো প্রথমে। হুমড়ি খেয়ে পড়লো শাহেদের ওপর।

শাহেদের ঘোর কাটেনি এখনও। বেশ আগে আসাদ আর আবিদ ডিভি ফরম পূরণ করার সময় শাহেদেরটাও ক’রে দিয়েছিলো। সেকথা ভুলেই গিয়েছিলো শাহেদ।

 

ডাক-পিয়ন ওদের তিনজনকে আসতে দেখে হাসলেন গাল ভরে। মিনিট খানেক আগে পান মুখে দিয়েছিলেন। বয়স হয়েছে। পান খাওয়াও বেড়েছে তার। হাতের আঙুলের ডগায় চুনের ছোপ নিয়ে আঙুলটা উঁচু ক’রে ধরে অন্য আঙুলগুলো দিয়ে চিঠি ধ’রে ধ’রে প্রাপকের হাতে দেন রহিম-পিয়ন। শাহেদরা রহিম চাচা ব’লেই ডাকে।

লাল টুকটুক করছে রহিমের মুখ। হাসির ফাঁকা দিয়ে রঙিন রস চুয়ে গেলো একটু। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘আমারেও তোমার সাথে না নিলে চিডি দিমু না কইলাম’। শাহেদ হাসলো। আড় চোখে তাকিয়ে ওদেরকে পাশের বেঞ্চের দিকে ইশারা ক’রে রহিম ভেতরে গেলেন। একটু পর বড়ো একটা সাদা খাম নিয়ে এলেন। তিনজনই উঠে দাঁড়ালো। শাহেদ কাঁপছে একটু একটু। সবার আগে আসাদ এগিয়ে দাঁড়ালো। হাত বাড়ালো। রহিম রসিকতা ক’রে খামটা হাওয়া থেকে কেড়ে নেয়ার মতো টেনে লুকিয়ে রেখে মুহূর্তে আবার এনে আসাদের হাতে দিলেন। জোরে হেসে উঠলো সবাই।

 

তিনবন্ধু মিলে ফার্স্ট লেটার পূরণ ক’রে পাঠিয়ে দিলো। তাও যে-সে পোস্ট অফিস থেকে নয়, একেবারে গুলিস্তান জিপিও’তে গিয়ে। কাগজপত্র বানাতে হাতির পুলের উকিল কাজী শামসুল হকের সহযোগিতা নিয়েছিলো।

পরীক্ষার আগে কাউকে জানায়নি ওরা। শাহেদ চুপচাপ পরীক্ষা দিয়ে বের হতো। তবে কলেজে কারো কারো অন্যরকমভাবে তাকাতে দেখেছে ওর দিকে। একই হলে সিট পড়েছিলো মিতার। পড়াশোনার বাইরে কোনো কথা বলেনি। মাঝে মাঝে পরীক্ষা কেমন হয়েছে তাই জানতে চাইতো। আর সেই স্বভাবমতো খুনসুটি।

 

দিনে দিনে শাহেদ আরও যেনো চুপচাপ হয়ে গেলো। মিতার নজর এড়ালো না। লটারির লেটার আসার পরদিন কলেজে গেলেই ও বুঝে গিয়েছিলো কিছু একটা হয়েছে শাহেদের। জিজ্ঞেস করে নি কিছু।

 

পরীক্ষার শেষদিন আগেই খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে এলো শাহেদ। মিতা তখনও মনযোগ দিয়ে লিখছে। ঘাড় গুঁজে ঝুঁকে আছে খাতার ওপর। দু’পাশ থেকে চুল বেয়ে খাতার বুকে গড়াগড়ি খাচ্ছে ওর এলোচুল। পাশের জানলার বাতাসে একবার উড়ে গেল একপাশের চুলগুলো। চশমার কাচের ভেতর দিয়ে অক্ষর দেখে দেখে দৃষ্টি এগিয়ে নিচ্ছে খাতার বাম দিক ডানে। যেনো কথা বলছে নিজের লেখার সাথেও।  নীরবে হাসলো শাহেদ। এই মেয়ে কী কোনো না কোনোভাবে কথা না ব’লে থাকতে পারে না?

 

‘এই ভুতুম, সুড় সুড় ক’রে আগে বেরোলি কেনো, অন্যান্য দিন তো আমার ছায়া না দেখে বোরোবার পথ পাস না?’

কলেজের সামনের ঘাসের ওপর একা একা ব’সে আছে শাহেদ। মিতা’র কথায় ফিরে তাকালো। হাসলো শুধু। সেই হাসি।

‘বেরোতে বোরেতে আমার দিকে ওইরকম দেখছিলি কী তাই বল্?  মিতা শাহেদের ডান কানের লতি আলতো ক’রে ধরলো। শাহেদ হা হয়ে গেলো। ‘ওর কী পেছনেও চোখ আছে না-কি?’

 

‘সামনা সামনি আসলে তো তোর ঘাড় ভারী হয়, মাথা উঠাতে পারিস না। দ্যাখ্, এখন দ্যাখ্ আমাকে এই আমি তোর সামনে বসলাম।

‘না না না ওখানে শুধু ঘাসের ওপর বোসো না, কাপড়ে দাগ লাগবে’। মিতার হাত ধ’রে ফেললো শাহেদ।

মিতা মুচকি হেসে বললো, কেনো, কেনো, তুই যে বসেছিস?

দৃষ্টি উদাস ক’রে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে শাহেদ বললো, ‘এই মাটিটাকে আরও গায়ের সাথে মিশিয়ে নিতে চাই মিতা। জানিনা কবে দূরে চলে যাই’।

‘তোর সেকেন্ড লেটারটা কবে আসছে?’ মিতা প্রশ্ন ক’রে সোজা তাকাল।

শাহেদ একবার শুধু মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নামালো।

‘আমি তোমাকে আগেই বলতে চেয়েছিলাম, সাহস পাচ্ছিলাম না—  আজই বলতাম’।

‘তোর সাহসগুলো যেখানে হারিয়েছিস তার হদিস দিতে পারিস আমাকে, আমি যেয়ে নিয়ে আসতাম’।

শরীর দুলিয়ে  হাসলো শাহেদ।

 

ডিভিপরীক্ষা শেষ। গরমও পড়েছে বেশ। ক’মাস দেশের বাড়ীতে থাকতে পারবে ভেবে আনন্দ লাগছে শাহেদের। মহাখালি থেকে ময়মনসিংহের বাসে উঠলো। ভায়া ভালুকা। গেইক লক ব’লে উঠালেও সারাপথ এদের গাড়ীর গেইট আন-লকই থাকে। ভালোই হলো। ডাইরেক্ট বাস, ইন-ডাইরেক্টে সুবিধামতো নেমে পড়া যাবে।

 

বাস ছাড়লো। মহাখালি পার হলে খুব ভালো লাগে। কেমন চওড়া রাস্তা। জট কম। এমন হতো ঢাকার সব রাস্তাঘাট! বাম দিকে বসেছে শাহেদ। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কাছাকাছি এলে একমনে তাকিয়ে থাকলো ওইদিকে। একটি বিমান এইমাত্র উড়লো। মাথা উঁচু ক’রে উঠছে উপরের দিকে। কখনও বিমান বন্দরের ভেতরে যায় নি ও। একবার আসাদের সাথে প্লেন-পড়া দেখতে এসেছিলো। খুব অবাক হয়েছিলো। এতবড়ো একটা জিনিস, পাখির মতো ওড়ে, কী আশ্চর্য ব্যাপার!

 

সিডস্টোর বাজারে নামলো শাহেদ। হালকা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনও ঝরছে দু’এক ফোঁটা। রাস্তার ওইপারে সারি সারি কাঁঠাল বাগান। তার তলায় পাকা পাকা কাঁঠালের স্তুপ। ভ্যান-রিকশায় ওঠাচ্ছে কয়েকজন। লুঙি উঠিয়ে মাথায় গামছা পেঁচিয়ে কাদা-পানি থেকে রক্ষা করতে চাইছে। তাদের খালি পা রাঙা রাঙা কাদায় লেপ্টে আছে। বৃষ্টির পানিতে আর ভিজে হাওয়ায় মৌ মৌ করছে পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণ। মন চনমন ক’রে উঠলো শাহেদের। কখন বাড়ী পৌঁছতে পারবে। ওদের বাড়ীর গাছের কাঁঠালের স্বাদ মনে ক’রে মুখে পানি এসে যাবার মতো হলো। এই কাদায় বাস বন্ধ। কাদের ডাক্তারের চেম্বার পার হয়ে বাজারের শেষ মাথায় এসে দাঁড়াল। কয়েকটা রিকশা আর ভ্যান-রিকশা দাঁড়ানো।

 

‘কুন হানো যাইবাইন বাই? শাহেদ গ্রামে এলে আঞ্চলিক ভাষা বলে। সেভাবেই জিজ্ঞেস করলো।

‘কাচিনা বাজার যাইবাম, ছাব’ একজন রিকশা-ওয়ালা জবাব দিলো।

‘ক্যান, বাটাজোর যাইতাইন না?’

‘না গো ছাব, আমার বারী ওইহানোউ, এই বাদলার মইদ্যে অতো দূর গ্যালে ফির‌্যা আইতে পারতাম না, আফনে হ্যার ভানে যাইন গা, বৃষ্টি থামচে’।

 

আরও দু’এক উঠলে ছাড়লো ভ্যান-রিকশা। ইটের খোয়ায় লাল হয়ে আছে রাস্তা। আধ-ভাঙা ইটের পরে চাকা গেলে খর্ খর্ ক’রে উঠছে ভ্যান। ঝাঁকি লাগছে। ব্যাগের ওপর হাত রেখে শক্ত হয়ে বসে আছে শাহেদ। কাঁচা পথে নামলে কাদা জমে জমে চাকা মোটা হয়ে উঠলো।  ভ্যান-ওয়ালা কাঠি কুড়িয়ে এনে টায়ার পরিষ্কার করতে লাগলো একটু পর পর। শাহেদ নেমে নেমে ভ্যানের পেছন ধ’রে ঠেলেও দিলো কয়েকবার। একটু পরে বেলেমাটির রাস্তা পেয়ে দ্রুত চলতে লাগলো ভ্যান। কিছুটা রোদও ফুটলো। রোদের তাপে ভেজা মাটির ভাঁপ উঠছে। খোলা মাঠের দূর থেকে মাঝে মাঝে ঢু মেরে যাচ্ছে পশলা পশলা বাতাস। কী নরোম, ঠান্ডা আর আদ্র সুখময় এই বাতাসেরা। এসে কিছুক্ষণ যদি থাকতো। কেনো যে উড়ে যাচ্ছে আবার। ওরা তো মেঘ নয়। বৃষ্টি দেবার তাড়া নেই। অশরীরে শুধু ব’য়ে চলা।

 

কাচিনা বাজার সামনে। স্কুল ঘর আর বাজারের চায়ের স্টল দেখা যাচ্ছে। রোদ নেই এখন। উপরের দিকে তাকলো শাহেদ। বাটাজোরের ওইদিকে, ওদের বাড়ীর দিকটায় মেঘ জমে আছে শামিয়ানার মতো। বাজারে আসলে একজন বললো, ভাইছাব, একটু খারান, চা খাইয়া লই’।

‘না না, চা খাওন লাগবো না, দ্যখতাছুইন না, কীরুম ম্যাগ আইবো অহনই, আমনে যাইনগা। বললো আরেকজন।

ওদের কথা শেষ হতে না হতেই বড়ো বড়ো ফোটায় বৃষ্টি নামলো। ভ্যান-ওয়ালা বললো, আমার ভারা দিয়া দেন, গারী আর যাইতো না’।

 

এই বৃষ্টি থামবে ব’লে মনে হলো না শাহেদের কাছে। বাজারে বসে থাকলেও পরে কোনোকিছু পাওয়াও যাবে না বাটাজোর যাবার জন্যে। ওর ব্যাগটা তেমন ভারী না। জামা-কাপড় আর তার ভেতরে প্রাণ-ভোমরার মতো কিছু অবসরে পড়ার বই। পালিথিন দিয়ে বইগুলো পেঁচানো। ব্যাগে ভরার আগে সবসময় বই পলিথিনে মুড়ে নেয় শাহেদ। ব্যাগটার ওপর একবার হাত বুলিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটা শুরু করলো। চায়ের স্টল থেকে লোকজন ওর দিকে তাকাল। কেউ একজন চেঁচিয়ে বললো, বাইজান, ম্যাগ অনেক ত্যাজ কইরা আইবো, থাইক্যা যান আমগো বারীত। ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে আবার সামনে এগোলো।

 

ডিভিকাচিনা থেকে বাটাজোর বড়জোর মাইল তিনেকের পথ। বৃষ্টিমাখা কাদাময় দিনে তা তিন আলোকবর্ষ মনে হতে পারে। এঁটেল মাটিতে পানি প’ড়ে রাস্তা এখন জিয়ল মাছের গা। একবার পা পিছলে গেলো শাহেদের। একপা সামনে সড়াত ক’রে এগিয়ে গেলো, না ব’লে ক’য়ে। যেনো ওর ওই পা’টা মাছ মারার ছিপ, জুতোটা বড়শীর আগা। খাবার ভেবে মাছ এসে দিলো টান। টাল সামলে সোজা হলো শাহেদ। তুমুল বৃষ্টিতে ধোঁয়াটে চারদিক। সাদা সাদা হয়ে আছে দূরের মাঠ, কাঁঠাল বাগান, ক্ষেতের বেড়া, সামনের রাস্তা। এই আকাশ-ভাঙা জল-পতন কোনোদিন থামবে বলে মনে হলো না। নিজেকে থামিয়ে কী লাভ। ভেজা পিছল পথ তাতে কী? এই ‘পথ চলাতেই আনন্দ’। এমন ক’রে কোনোদিন যদি আমার মাটির এত নরোম মাখামাখি আদর না পাই। এই যে অফুরন্ত ধারাজল অবিরল অনর্গল ঝর ঝর ঝরছে। এমন উদার বৃষ্টি কী অন্য কোনো দেশে, অন্য কোনো ভূমিতে পড়ে? জবজবে মাথা মায়ের সামনে এগিয়ে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে কী সেখানে। মায়ের আঙুলের নীচে তাঁর আঁচলের ঝড় থামলে শুকনো চুলে চিরুনী বোলাবেন। মা’কে ছেড়ে কতদিন থাকা যাবে। আদেয় যাবে কী?’ আর ভাবতে পারলো না। দূরের আকাশে দু’ফালি বিদ্যুৎ-রেখা পাল্লা দিয়ে নেমে এলো নীচে। ডুকরে কেঁদে উঠলো শাহেদ। চোখের পানি আর বৃষ্টির জল একাকার হয়ে গড়িয়ে পড়লো।

 

বাটাজোর বাজারে আসতে আসতে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠতে লাগলো। মালেকের চায়ের দোকান এরকম দিনেও খোলা আছে। চটার বেঞ্চের পেছনে চালের আগায় নীল প্লাস্টিকের পর্দা দুলছে। বাতাস আর বৃষ্টির ছাঁট লেগে শব্দ হচ্ছে খই ফোটার মতো। হঠাৎ বাতাসে পর্দা উড়ে রাস্তার দিকটা ফাকা হলে একজন দেখতে পেলো শাহেদ আসছে। জোরে ডাক দিলো ওকে। ‘আরে পানিত বিজ্জা, বিজ্জা বিলাই অইচস্, বারীত যাবার আগে চা খায়া ল, আগুনে হাত পাও ছ্যাক’। বলতে বলতে শহীদ উঠে এসে ওর কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিলো। শাহেদকে বসার জায়গা ক’রে দিলো অন্যরা। গলার গামছা উল্টো ঘুরিয়ে খুলে এগিয়ে দিলো শাহেদের দিকে একজন বয়স্ক লোক। শাহেদ ধন্যবাদের হাসি হেসে মাথা মুছতে লাগলো। একটু পরে চা এগিয়ে দিলো মালেক।

 

বৃষ্টি থেমেছে। অন্ধকার জমাট বাঁধেনি এখনও। মাঝে মাঝে গাছের জল-ভরা ডালপালা টুপ টুপ ক’রে ঝরিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি-বিন্দুগুলো। শাহেদ আর শহীদ হাঁটছে পাশাপাশি। এ-পাড়া ও-পাড়া বাড়ী ওদের। শাহেদের বাবা শহীদের দূর সম্পর্কের ভাই হলেও ওরা দু’জন এক বয়সী আর একই ক্লাসে পড়াশোনা করায় তুই তুই বলে। হাই স্কুলের মাঠে এখনও ফুটবল খেলছে একদল ছেলে। কাদা-মাখা পিছল বলে লাথি মেরে সড় সড় ক’রে গড়িয়ে যাচ্ছে ওরা। হেসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এ-ওর গায়ের ওপর। ওরা কিছুক্ষণ খেলা দেখে  হাসলো। আবার বাড়ীর দিকে হাঁটতে লাগলো।

 

HPC191উঠোন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে শহীদ চলে গেলো। শাহেদের মা, আয়েশা বেগম ঘর থেকে হারিকেন জ্বালিয়ে রান্নাঘরে যাবার জন্যে বের হয়েছেন। দেখেন শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ওর মা কী করছেন তাই দেখছিলো। চমকে দেবার ইচ্ছে ছিলো। পারলো না। আয়েশা হারিকেন ঠপ ক’রে উঠোনে রেখে দৌঁড়ে এলেন। ছেলের হাত ধ’রে বললেন, এই বাদলার ভাব কাটলে তারপরে আইতি। ম্যাগের পানি মাতাত পরলে জ্বর হইবো’।

‘তুমি মাথা মুইচ্ছা দিলে কিচ্চু হইবো না মা, সুমন-সুমনা কই?’

‘অরা পরতাছে গরের মইদ্দে, চল্। আয়েশা বললেন।

‘আব্বা গ্যাছে কই, আব্বারে তো দেহি না’। এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

‘ওই পারায় তার সালিশ আছে একটা, নজিবর চেয়ারম্যানও আইবো’।

‘ও’।

 

পা ধুয়ে ঘরে গেলো শাহেদ। ওকে দেখে চমকে উঠলো ওর সাত বছরের যজম ভাই-বোন, সুমন আর সুমনা। উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো দু’জন। ব্যাগ থেকে চকলেট বের ক’রে ওদের হাতে দিলো ও। শাহেদের পর অনেকদিন কোন সন্তানাদি হয়নি বশির মেম্বার আর আয়েশা বেগমের। ডাক্তার আর কবিরাজ-বাড়ী হেঁটে হেঁটে ওই জোড়া-মানিক হয়েছে ব’লে আয়েশার মনে অপার আনন্দ। প্রতিদিনের নামাজে কেঁদে কেঁদে শাড়ীর আঁচল ভিজিয়ে ফেলেন। জন্মদিন এলে বাড়ীতে ঈমাম আর লোকজন ডেকে মিলাদ দিতে ভোলেন না বশির।

 

বাবা বাড়ীতে এলে রাতের খাবার খেতে খেতে ডিভি’র কথাটা বললো শাহেদ। বশির শেষ নলা মুখে দিতে ভুলে গেলেন। প্লেট আর মুখের মাঝখানে ঝুলে রইলো মুঠোভর্তি ভাত। আড়চোখে দেখলেন আয়েশাকে। আয়েশা তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে।

‘তোমার পোলায় কী কয়, হুনচো,  আমরিকা যাইবো বোলে? হ্যার পরালেহা তো শ্যাষ অয় নাই’। গলা ধ’রে এলো বশিরের।

‘শুযুক পাইলে যাইবো, পোলা আমার বিলাত ফ্যারত না অইলেও আমরিকা ফ্যারত তো অইবো?’ স্বাভাবিক ভাবে বললেন আয়েশা।

 

বশির হা ক’রে রইলেন। চোখের পলক পড়া বন্ধ হলো। নীরবে হাত ধুয়ে উঠে গেলেন।

‘তর বাপের কতা হুনলী?  তুই ক’ ওইহানো কলেজ নাই? পোলা য্যান্ খালি হ্যার-ই পরালেহা করে। আমার কইলাম মত আছে’।

শাহেদ কিছু বলতে পারলো না।

 

প্রায় একবছর কেটে গেলো। এর মধ্যে ঢাকা আর বাড়ী যাতায়াত করেছে বহুবার। ‘ডিভি লেটার’-এর সমস্ত ফর্মালিটি শেষ। এখন ভিসার জন্য প্রতীক্ষা। একা একা ভিসা আনতে যেতে ভয় লাগছে শাহেদের। রুমমেট আবিদ, আশরাফ আর আসাদ যাচ্ছে ওর সাথে। সক্কাল বেলা লাইনে দাঁড়াতে হবে আমেরিকান অ্যামব্যাসীর সামনে। একটা ট্যাক্সি ব’লে রেখেছিলো আসাদ আগে থেকেই। খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলো ওরা।

 

দুপুর বেলা। আমেরিকান অ্যামব্যাসীর গেইট থেকে সামান্য দূরে ইটের সলিঙের ওপর গাছের ছায়ায় ব’সে আছে তিনজন। এইমাত্র ওরা চারজন হলো। মিতা এসেছে।

‘তোমরা আমাকে দল থেকে বাদ দিলে কেনো? শাহেদ কী আমাকে নিতে না করেছে? ও বের হোক, চেহারা পাল্টে দেবো’।

কাঁপতে লাগলো তিনজন।

‘না… আ-ম-রা ভাবলাম এতো সকালে আসতে হবে, তোমাকে ও ভিসা পাবার পর কল করতাম’। তোতলিয়ে বললো আসাদ।

‘এত সকালে তোমরা আসতে পারলে, আমি পারবো না ক্যান্, মেয়ে ব’লে?’

‘না না না না না, তিনজন একসাথে হাত উপরে উঠালো।  হেসে ফেললো মিতা।

 

আশরাফ চিপস আর কোক কিনে এনেছে। খেতে খেতে ওরা তাকিয়ে আছে গেইটের দিকে। দেরি হচ্ছে দেখে গল্প করতে লাগলো তিনজন। মিতা দৃষ্টি সরায়নি গেইট থেকে। কেউ কেউ বের হওয়া শুরু করেছে। দৌঁড়ে এসে আত্বীয়-স্বজন স্বাগত জানাচ্ছে।

প্রখর রোদ। ফাইল উপরে ধ’রে রোদ বাঁচিয়ে চোখ তুলে তাকালো শাহেদ। দাঁড়াল একটু। কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। মিতা দৌঁড়ে গেল। পেনসিল হিলের জুতোয় এমন দৌঁড়াতে কেউ পারে তা ওকে না দেখলে বোঝা যাবে না।

 

শাহেদ এগিয়ে আসলো একটু। সিঁড়িতে পা রাখার আগে হুমড়ি খেলো মিতা। ধ’রে ফেললো শাহেদ। দু’হাত শিশু কোলে নেবার মতো ক’রে ধ’রে আছে ও। মিতা সামলে নিয়ে হাত ধরলো শাহেদের। গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। ভিসা আসাদের হাতে দিলো শাহেদ। তিন-বন্ধু একসাথে জড়িয়ে ধরলো ওকে। হাউমাউ ক’রে কেঁদে উঠলো শাহেদ।  ফোঁপাতে লাগলো। চোখ-মুছিয়ে দিলো বন্ধুরা। কিছুক্ষণ পর শাহেদ এদিক-ওদিক তাকাল। ডানে, বাঁয়ে, শাহজাদপুর বাজারের দিকে,  অ্যামব্যাসীর মাঠ পেরিয়ে নতুন বাজারের ওই দিকে ওর দৃষ্টি খুঁজতে লাগলো কাউকে। মিতার দেখা নেই কোথাও।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.