জিয়ার ‘খেতাব’ বাতিল সময়ের দাবি

জিয়ার ‘খেতাব’ বাতিল সময়ের দাবি

মোনায়েম সরকার: মুমূর্ষু বিএনপি হঠাৎ করে নড়াচড়া দিয়ে উঠেছে। নিয়মিত সভাসমাবেশ থেকে তারা নানারকম আজগুবি কথা বলছে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, জিয়াউর রহমান সম্পর্কে। বিএনপি নিজেই জানে জিয়াউর রহমান একদিন তার কর্মকাণ্ডের জন্যে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি জিয়াউর রহমান ইতিহাসে ধিক্কৃত হয়ে উঠবে এটা তারা ভাবেনি। বিএনপি এমন একটি দল যে দলের জন্ম হয়েছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। ষড়যন্ত্রই এই দলের মূল পুঁজি। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ও জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ঘাতকদের বিএনপি যেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছে তাতে বাংলাদেশ শুধু রাজনৈতিকভাবেই পিছিয়ে পড়েনি অর্থনৈতিকভাবেও অস্বাভাবিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ভুমিকা কী ছিল সে কথা এ প্রজন্মের তরুণ সমাজ না জানলেও সেদিন আমরা যারা শত্রæর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছি তারা তা ভুলিনি। জিয়াউর রহমান কখনোই বাংলাদেশকে বিশ্বাস করেননি। তিনি সব সময়ই পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছেন। সোয়াত জাহাজ আমি চিনি। এই জাহাজে করে একবার আমি ন্যাপ সম্মেলন শেষে সাত দিন সাত রাতের দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে করাচি থেকে বাংলাদেশে এসেছিলাম। যাত্রীবাহী সোয়াত জাহাজ ভরে পাকিস্তানিরা অস্ত্র পাঠিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষকে শায়েস্তা করার জন্য। সে অস্ত্র খালাস করতে সহযোগিতা করছিলেন জিয়াউর রহমান। এই কথা অস্বীকার করার কোনোই সুযোগ নেই। আজ যারা জিয়ার এই অপকীর্তি ঢাকার জন্য মিথ্যা গল্প তৈরি করে জিয়াকে রক্ষা করতে চাইছেন বাংলাদেশের মানুষ একদিন তাদেরকেও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে।

তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণদান কালে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’  বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণাকে সেদিন কে.এম. সফিউল্লাহ ও মেজর জিয়া মুক্তিযুদ্ধের গ্রিনসিগন্যাল বলে মনে করেছিলেন। এ কথা তাদের লেখায় নিজেরাই স্বীকার করেছেন।

২৫ মার্চ মধ্য রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সেদিন অনেকেই রেডিওতে পাঠ করেছিলেন। তেমনি একজন পাঠক ছিলেন জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর নামে পাঠ না করে সেদিন প্রথম নিজের নামে পাঠ করে ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস বিকৃত করে বাঙালি জাতিকে ধোকা দিতে চায়। পরে যখন এটা জানাজানি হয় এবং অন্যান্য বাঙালি অফিসার এর প্রতিবাদ করেন এবং জিয়া বাধ্য হন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী পাঠ করতে। জিয়া মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার নানারকম ফন্দি-ফিকির করেছেন। তার কোনো কৌশলই বাংলার মানুষ মেনে নেয়নি।

আজ বিশ্বাসঘাতক জিয়াকে রক্ষা করার জন্য বিএনপি তার ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী কিংবা বিকৃত ইতিহাস রচনাকারীদের দিয়ে যতই বিকৃত ইতিহাস তৈরি করুক না কেন- কেউই জিয়ার অপকর্ম ঢাকতে পারবে না। মিথ্যা দিয়ে যেমন সত্যকে আড়াল করা যায় না- তেমনি মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে জিয়ার যে কুখ্যাত অপকর্ম তাও কেউ আড়াল করতে পারবে না। জিয়াউর রহমান কোনোদিনই স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্বাস করেননি। এ কথা বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় সামান্য প্রকাশ পেলেও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু এমন এক মহান নেতা যাকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ রাজনীতিবিদরাই শুধু নন, পাকিস্তানি রাজনীতিবিদরাও বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় হারাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু নিজের যোগ্যতা ও নেতৃত্বের কারণেই অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে যে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না- এটা পাকিস্তানের পরাজিত সেনাশাসকরা বুঝতে পেরেছিলেন। এ কারণেই তারা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করেন। যেসব ঘাতক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করছিল তারা জিয়াউর রহমানের সঙ্গেই এ বিষয়ে প্রথম কথা বলে। কেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ঘাতকেরা প্রথম জিয়াউর রহমানের কাছে তাদের নীলনকশা তুলে ধরেছিল তা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। নিশ্চয়ই ঘাতকদের সঙ্গে জিয়ার এমন কোনো যোগসূত্র ছিল যার ফলে তারা জিয়াকেই ভরসার জায়গা হিসেবে মনে করেছিল।

জিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কোনো বিচার করেননি (অবশ্য বিচার করার প্রশ্নই উঠে না- কেননা এক অর্থে তিনিও হত্যাকারীদেরই একজন), বরং বিচার কাজ যেন কোনোদিনই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হতে না পারে সেজন্য বিশেষ আদেশে ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের নিরাপত্তা দান করেন। জিয়াই সেই মানুষ যে পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনীতিকে পুরোপুরি অন্ধকারে ঢেকে দেয়। সে রাজাকারদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে পুনর্বাসিত করে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বড় বড় পদে চাকরি দিয়ে হত্যার পুরষ্কার দেয় এবং বাংলাদেশকে নিয়ে যায় পাকিস্তানি, মৌলবাদী ভাবধারায় যার বিস্তার বাংলাদেশের মানুষ এখনো প্রত্যক্ষ করছে। নৃশংস জিয়াউর রহমানের চোখের ইশারায় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। কারাগারগুলো জিয়ার অবৈধ শাসনামলে ভরে উঠেছিল। প্রতিদিন রাতেই জিয়ার আমলে ‘কারফিউ’ দেওয়া হতো। দেশ গঠন নয়, রাতে কারফিউ জারি করে কারান্তরালে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করাই জিয়ার প্রথম কাজ ছিল।

বাংলাদেশের মানুষের অন্তর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার জন্য যা কিছু করণীয় জিয়া সেগুলো করতে কোনো কার্পণ্য করেননি। তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমানও একই কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে পুত্রতুল্য মনে করতেন। বিশাল হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু জিয়ার দোষত্রুটি ক্ষমা করে তাকে সুপথে আনার সব রকমের চেষ্টাই করেছিলেন। বর্ণচোরা জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু খুবই ক্ষমাশীল-কোমল হৃদয়ের মানুষ। এমনকি পুতুলকে (খালেদা জিয়া) স্বাধীনতার পর জিয়া গ্রহণ করতে না চাইলে বঙ্গবন্ধু পুতুলকে মেয়ের মর্যাদা দিয়ে জিয়ার হাতে তুলে দেন। বঙ্গবন্ধুর এই সুযোগ নিয়ে জিয়া ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিষবৃক্ষ রোপণ করে। একদিন সেই রোপিত বিষবৃক্ষই দানবীয় চেহারা নিয়ে ঘিরে ধরে সমগ্র বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধের ‘খেতাব’ রাষ্ট্র প্রদত্ত উপাধি। রাষ্ট্র যদি মনে করে পূর্বের কোনো সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক কিংবা অসঙ্গতিপূর্ণ- তাহলে তা সংশোধন করার ক্ষমতা রাষ্ট্র অবশ্যই প্রদর্শন করতে পারে। জিয়া একজন প্রকৃত দেশদ্রোহী, অনিচ্ছুক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তার ভ‚মিকা প্রশ্নবিদ্ধ। জাতির পিতার হত্যাকারীরা তারা আশীর্বাদপুষ্ট, রাজাকাররা তার আমলেই পুনর্বাসিত। ‘Money is no problem’ থিউরি আবিষ্কার করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কালোটাকার প্রচলন প্রথম জিয়াউর রহমানই করেন। একজন নির্দয় ডিকটেটরকে রক্ষা করতে বিএনপির নির্বিষ আন্দোলনকে ভয় না পেয়ে এই সরকারের উচিত হবে যথাযথ অভিযোগ উত্থাপন করে জিয়ার খেতাব বাতিল করা।

বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শুধু জিয়ার খেতাব বাতিলই চাই না, সেই সঙ্গে জিয়ার মরণোত্তরণ বিচার দাবি করি এবং জাতীয় সংসদ ভবন থেকে স্থপতি লুই আই কানের নকশা বহিভর্‚ত জিয়ার কবর অপসারণের জোর দাবি জানাই। জিয়ার মতো একজন চিহ্নিত স্বৈরশাসকের কবর কিছুতেই পবিত্র জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় থাকতে পারে না। এই কাজটি আরো অনেক আগেই করা উচিত ছিল। তবু যেহেতু এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ জিয়ার খেতাব বাতিলের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন, আশা করি জিয়ার কবরের প্রশ্নেও তারা সোচ্চার হয়ে ওই কবর অপসারণ করবেন।

আজ আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সময়। এখন অতীতের ভুল সংশোধন করে সামনে অগ্রসর হতে হবে। এই মুহূর্তে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে বিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধরে সবকিছু মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নকামী জনগণ বর্তমান সরকারের সঙ্গে আছে। তারা জিয়ার খেতাব বাতিলসহ যেকোনো সিদ্ধান্তকেই স্বাগত জানাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ এখন স্বমহিমায় জেগে উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষকে আর ভুল ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরে এখন অনেক তথ্যই আবিষ্কৃত হচ্ছে। এসব তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করলে জিয়ার সব অপকীর্তি প্রকাশ্য হয়ে যাবে। এসব তথ্য প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

– মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.