দুটি দুর্ঘটনা, বাজেট ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ

দুটি দুর্ঘটনা, বাজেট ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ

মোনায়েম সরকার: মান-সম্মান বোধ সকলের সমান নয়। কেউ কেউ পদ-পদবি-জীবনের চেয়ে সম্মানকে বেশি গুরুত্ব দেন। যারা আত্মমর্যাদাবান তারাই জগতে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। অপরদিকে নির্লজ্জ, বেহায়া মানুষও পৃথিবীতে আছেন, যারা সম্মানের চেয়ে পদ-পদবি বড় মনে করে। যক্ষের ধনের মতো তা আঁকড়ে পড়ে থাকেন। এরা সমাজের মূল্যায়নে বিচলিত হন না, জনরোষের তোয়াক্কা করেন না, বেপরোয়াভাবে নিজেকে শুধু অধঃপতনের দিকেই নিয়ে যান।

গরিবের কাছে মান-সম্মানের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি। বিশেষ করে পেট-সর্বস্ব মানুষের কাছে আদর্শের কথা বিরক্তিই উৎপাদন করে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হলেও দিনে দিনে এদেশে বেশরম গরিবের সংখ্যা বাড়ছে। এ দেশের গ্রামে-গঞ্জে-বস্তিতেই শুধু গরিব মানুষ থাকে না, গুলশান, বারিধারা, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায়ও গরিবেরা বসবাস করেন। এসব গরিবদের বাড়ি আছে, দামি দামি গাড়ি আছে, ব্যাংকভরা টাকাও আছে। তবু এরা গরিব। গরিবের লোভ কখনোই শেষ হয় না। এই তথাকথিত ভিআইপি গরিবগুলোরও লোভের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এত লোভী এদেশের ভিআইপি গরিবেরা তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।

লুটপাটে ব্যস্ত বাংলাদেশের ক্ষমতাবানেরা। লুটপাট এমন সীমায় পৌঁছে যে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে নব নির্মিত তিনটি ব্রিজ ভেঙে পড়ছে, একনেকে কোটি কোটি টাকার ভুল প্রকল্প পাশ করে টাকার কুমির হচ্ছে ‘শক্তিশালী সিন্ডিকেট’। সাধারণ গরিব মানুষের ট্যাক্সের টাকা কৌশলে লুন্ঠন করছে অতি গরিব ক্ষমতাবানেরা। এসব অতিগরিবদের লুণ্ঠন ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জনসাধারণ ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে। এই ক্ষোভ যে কোনো সময় বিক্ষোভে রূপ নিতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তাণ্ডবে লাভ হয়েছে পড়শি রাষ্ট্র ভারতের বেশ কয়েকটি প্রদেশ। বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলগুলোতেও এই ঝড় ক্ষয়-ক্ষতির চিহ্ন রেখে যায়। খুলনার কয়রা অঞ্চলে বেড়ি বাঁধ ভেঙে গিয়ে, অপ্রত্যাশিত লবণজলের বন্যা হানা দিয়ে, জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলগুলো এমনিতেই অবহেলিত। এই ‘অবহেলা’ কোনোদিন ‘আদরে’ পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না।  ১৯৭০ সালে উপক‚লীয় অঞ্চল ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। দশ লক্ষ লোক নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল সেই প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল সেই ঘূর্ণিঝড়। এবারের ঘূর্ণিঝড়ে আরো একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেটা সম্মানের নয়, কলঙ্কের।

১ জুন, ২০২১ তারিখে কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া এলাকায় খুলনা-৬ আসনের (পাইকগাছা-কয়রা) সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান ভেঙে যাওয়া বাঁধ দেখতে গেলে স্থানীয় কয়েক হাজার জনগণ তাকে কাদা ছুড়ে মারে। প্রায় দশমিনিট তার উপর কাদা বর্ষিত হয়। পরে তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন এবং স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিয়ে জনগণের সঙ্গে আপস-রফার চেষ্টা করে পরিস্থিতি সামাল দেন। কেন এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল তা একটু বিশ্লেষণ করা দরকার। এই ঘটনার মূল সূত্র উদ্ঘাটিত হলে কে অপরাধী হবেন? জনগণ নাকি জনপ্রতিনিধি? এদেশের জনপ্রতিনিধিগণ বেশির ভাগই নির্বাচিত হওয়ার পর জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, ভুলে যান মাটির গন্ধ।

নির্বাচনী এলাকার মানুষ ও মাটিকে ভুলে যারা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তারা কি আসলেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য? সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো সম্মানিত সংসদ সদস্যকে অকারণে কাদা ছুড়ে মেরে অসম্মান করে থাকলে, তার বিচার করা হোক, আর যদি সংসদ সদস্যই অপরাধী হন তাহলে তিনিও সতর্ক হোন। আমরা উন্নয়নশীল দেশ হলেও, এখনও গরিব দেশের কাতারেই আছি। গরিবের অনেক সমস্যা থাকে। সব সমস্যা একদিনেই সমাধানযোগ্য নয়। ধীরে ধীরে এগুলো সমাধান করতে হবে। তবে সেই সমাধানের উদ্যোগ যেন জনসাধারণ বুঝতে পারে তার জন্য সংসদ সদস্যদের উচিত জনগণের মধ্যে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তুলে ধরা। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে জনগণ আশার বাণী শুনতে চায়। দেখতে চায় কথা ও কাজের মিল। এসব না করে জনপ্রতিনিধিরা উল্টোপথে হাঁটলে কাদা নিক্ষিপ্ত হবেই।

এদেশের অনেক সংসদ সদস্যই আইন-কানুন মানতে চান না। যা ইচ্ছে তাই করে নিজের ভাবমূর্তির সঙ্গে সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তিও এরা ক্ষুণ করছেন। এদের সম্পর্কে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। এদের বহিষ্কার করাই উত্তম। বঙ্গবন্ধুও তাঁর ৩৭ জন এমএনএ-কে বহিষ্কার করেছিলেন দুর্নীতির কারণে। আমি আশা করি, বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দুর্নীতিবাজ এমপি-মন্ত্রীদের বহিষ্কার করতে দ্বিধা করবেন না।  অমন কিছু করতে পারলে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার আরো বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করবেন।

কয়রার ঘটনাকে যারা সাধারণ দুর্ঘটনা মনে করছেন তারা ভুল করছেন। জনগণের আক্রোশ-অভিপ্রায় বুঝতে না পেরে এটাকে ধামাচাপা দিলে পরিণামে মন্দ ফল ভোগ করবেন সরকার। দেশের সর্বত্রই এখন কাদা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সাধারণ জনগণ। কার গায়ে কখন এই ‘কাদা’ ‘কামান’ হয়ে গর্জে উঠবে তা অনুমান করা গেলেও মুখ ফুটে বলা যাচ্ছে না।  

সম্মানিত সংসদ সদস্যদের জনবিচ্ছিন্নতার পাশাপাশি, দেশের সর্বত্র এখন সহিংস ঘটনা ও নিরাপত্তাহীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের মানুষ কতটা অনিরাপদ তার একটি ছোট্ট প্রমাণ দিনদুপুরে পরিকল্পনা মন্ত্রীর সরকারি গাড়ি থেকে অত্যাধুনিক মোবাইল ফোন ছিনতাই। মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী মহোদয় বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে করতে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে সঙ্গে নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়ে জরুরি কাজে যাচ্ছিলেন। এমন সময় এক ছিনতাইকারী বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে মন্ত্রী মহোদয়ের মোবাইল ফোনটি ছিনতাই করে। কিভাবে ফোনটি ছিনতাই হলো! ছিনতাই ঘটনার আকস্মিকতায় মন্ত্রী মহোদয় নিজেই হতভম্ব হয়ে যান। তার সঙ্গে থাকা গানম্যান, পাইক পেয়াদা তারাও কিছু বুঝতে পারেননি। কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের প্রটোকলের জন্য যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী রাখা হয়েছে, তাদের সামনে থেইে যদি মাননীয় মন্ত্রী দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তাহলে যেসব সাধারণ মানুষ প্রতিদিন নানামুখী প্রতিক‚লতা সামলিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করেন, তাদের অবস্থা কত শোচনীয় তা আর ব্যাখ্যা করার দরকার আছে বলে মনে হয় না।

নভেল করোনা ভাইরাস দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। ক্রমাগত লকডাউনে ব্যবসা-বাণিজ্য অচল প্রায়, অসংখ্য চাকরিজীবী প্রতিদিন চাকরি হারাচ্ছেন, দিন মজুরেরা ঠিক মতো শ্রম বিক্রি করতে না পেরে অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। কদিন আগেও রাজধানীতে এত ভিক্ষুক চোখে পড়েনি। এখন রাস্তায় বের হলে মানুষের চেয়ে ভিক্ষুকই বেশি চোখে পড়ে। উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল, বেকার মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই দানা বাঁধবে জনরোষ। দলীয় নেতাকর্মী-এমপি-মন্ত্রীদের আচরণে জনগণের মধ্যে অসন্তোষের সীমা নেই। এই মুহূর্তে এমন বাজেট প্রণয়ন করতে হবে, সেটার সুফল যেন সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে। সাধারণ মানুষকে অতিষ্ঠ করে কেবল পুঁজিপতিদের পকেট ভরার বাজেট জনগণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করলেও এর ভবিষ্যৎ ফল হবে ভয়াবহ। দেশের টাকায় দেশের সব মানুষের অধিকার আছে। যারা দুর্নীতি করে, মাদক ব্যবসা করে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণের পকেট কাটে তাদের সুবিধার জন্য বাজেট প্রণয়ন যেন না করা হয়, আশা করি সে বিষয়ে বর্তমান সরকার সচেষ্ট থাকবেন।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভুল পথে পরিচালিত হলে যে কোনো সময় অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। সংসদে ক্রমেই ব্যবসায়ীদের ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রাজনীতি রক্ষা করতে হলে সৎ নেতা-কর্মীদের প্রাধান্য দিতে হবে। আদর্শবান নেতা-কর্মী ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল টিকে থাকতে পারে না। সুবিধাবাদী আদর্শহীন নেতাকর্মীদের দিয়ে যে রাজনৈতিক দল চলতে পারে না অর্ধমৃত বিএনপি ও নিষ্প্রাণ জাতীয় পার্টিই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এ বিষয়ে সতর্ক আছেন। শত্রæ সব শেষ হয়ে গেছে, এ কথা ভেবে হাতগুটিয়ে বসে থাকার সময় এখনও আসেনি। অন্ধকারে শত্রæর দল গা ঢাকা দিয়েছে। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে ঘাড়ের উপর। তাই, জনগণকে অনাদর, অবহেলা নয়, তাদেরকে ভালোবেসেই বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নির্মাণ করতে হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা।   

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.