বড়ই তৃপ্তিকর শ্রুতিমধুর সংবাদ

বড়ই তৃপ্তিকর শ্রুতিমধুর সংবাদ

আয়েশা-২

মাহাবুবুল হাসান নীরু : এই প্রবাসে বসে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, কিংবা বাংলাদেশের কোনো কৃতি সন্তানের সাফল্য হৃদয়ময় কতোটা যে সুখ ছড়িয়ে দেয় সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমরা যারা প্রবাসে বসবাস করি, দেশের প্রতি তাদের টান বরবরই প্রগাঢ়। সব সময়ই উন্মুখ হয়ে থাকি একটা ভালো খবর শোনার জন্য। সু-সংবাদ জানার জন্য। আর কোনোভাবে যদি বাতাসও বয়ে নিসে আসে তেমন কোনো শুভ সংবাদ, সেটা যেনো কানে মধুবর্ষণ করে। সেটা যে কতোটা শ্রুতিমধুর তা বলে-কয়ে বোঝানো যাবে না।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, তেমন সু-সংবাদ খুব একটা পাই না। বরং দুঃসংবাদ, বাজে সংবাদ শুনে শুনে কান যেমন ঝালাপালা হয়ে যায়, পাশাপাশি মনটাও হয়ে ওঠে ত্যক্ত-বিরক্ত।ayesha-[1]

আমরা যারা দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বসবাস করি; স্বভাবতই তাদের সাথে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের সংযোগটাই বেশী। মি‌শতে হয় নানা দেশের নানা মানুষের সাথে। কথা বলতে হয়, নানা বিষয়ে। বলাবাহুল্য, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশ-মাটি ও মানু‍ষের সুনাম-সমৃদ্ধির সুবিস্তৃতি ঘটায় এমন সংবাদে আমাদের হৃদয়টা আত্ম-অহঙ্কারে ফুঁলে ফেঁপে ওঠে। আমরা সেই সংবাদটা বিদেশীদের সাথে শেয়ার করে বিশেষ আত্মতৃপ্তি অনুভব করি।

কিন্তু যখন কোনো লোভী মালিক শ্রেনীর বলি হয় কোনো গার্মেন্টস শিল্প, হাজারো শ্রমিকের ঘটে নির্মম প্রাণহাণি। বাংলাদেশের অসহায় দুর্ঘটনাকবলিত শ্রমিকদের রক্তাক্ত ছবি ও আহাজারিতে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে; কিংবা উন্নত বিশ্বের বায়াররা যখন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, ‘রক্তমাখা পোষাক কিনবে না তারা’ তখন বিদেশীদের সামনে আমাদের মাথাটা লজ্জায় নু’য়ে পড়ে।

আবর যখন নাফিসের মতো পথভ্রষ্ট সন্তানের জঘন্য অপরাধ প্রমানিত হয়; তার সাজা হয়, তখনও সীমাহীন লজ্জা মাথাটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। সে অভিজ্ঞতা বড়ই তিক্ত! আর সেসবের সাথে তো আছেই আমাদের রাজনৈতিক কর্দমাক্ত কর্মকান্ড। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে তার দুর্গন্ধ আরো অধিক নোংরা লাগে।

সামনে নির্বাচনকে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ যা ঘটে চলেছে তা মোটেও সুখপ্রদ নয়। এর প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ‘দেশের ভয়াবহ পরিণতির’ কথাই উচ্চারিত হচ্ছে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একশ্রেনীর সংবাদ মাধ্যম তা ফলাও করে প্রচার করে এক ধরণের আত্মপ্রসাদও লাভ করছে।

সে যাই হোক, এতোসব অশুভ সংবাদকে ছাপিয়ে সদ্য যে সংবাদটি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদের জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছে, প্রবাসীদের মাথাটাকে উন্নত করতে সহায়তা করেছে; তা হচ্ছে, বাংলাদেশের সোনার মেয়ে আয়েশা উদ্ভাবন করেছেন ‘কৃত্রিম মানব ফুসফুস’! বড়ই তৃপ্তিকর শ্রুতিমধুর সংবাদ!

আয়েশা তার এই আবিস্কার দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে একটা বিশেষ উচ্চতায় তুলে এনেছেন।

তার পুরো নাম, আয়েশা আরেফিন টুম্পা। একজন তরুণ নারী বিজ্ঞানী। ন্যানো-প্রযুক্তির মাধ্যমে তিনি তৈরি করেছেন এই কৃত্রিম মানব ফুসফুস।

আয়েশা-১১

জানা যায়, ২০১১ সালে আমেরিকার আলামস ন্যাশনাল ল্যাবেরটরির গবেষক ক্রিস ডেটার বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংক্রান্ত এক কাজে এসে এরকমই এক সম্ভাবনাময় জিন বিজ্ঞানী আয়েশা আরেফিনের দেখা পান। ডেটার ও তাঁর সহকর্মী ল্যান্স গ্রিনের একান্ত সহযোগিতার ফলেই আয়েশা লস আলামস ন্যাশনাল ল্যাবেরটরিতে উচ্চতর পড়াশোনা ও গবেষণার সুযোগ পান।

বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব নিউ মেক্সিকোতে ন্যানো-সায়েন্সের উপর ডক্টরেট করছেন। একই সাথে লস আলামস ন্যাশনাল ল্যাবেরটরিতে চলছে তাঁর গবেষণা।

আয়েশা তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন লস আলামস ন্যাশনাল ল্যাবেরটরির বায়ো-সিকিউরিটি বিভাগে। এরপরেই ঐ ল্যাবের ভারতীয় গবেষক প্রখ্যাত টক্সিকোলজিস্ট রাশি আইয়ার আয়েশাকে অপ্টোজেনিক্স সংক্রান্ত গবেষণা কাজের জন্য নিয়োগ দেন। প্টোজেনিকস হচ্ছে, জিন-বিদ্যা ও প্রোটিন প্রকৌশল(ইঞ্জিনিয়ারিং) এর মাধ্যমে জীবন্ত টিস্যুর মাঝে ঘটতে থাকা বিভিন্ন স্নায়বিক কাজ (neuron activity) নিয়ন্ত্রণ করা। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও কৃত্রিম টিস্যু বা কলা তৈরি করা সম্ভব।

আয়েশা ও রাশি আয়ারের দলের অন্যান্য সদস্যরা বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট বিষক্রিয়া, রোগ ও কৃত্রিম অংগ সংস্থাপনের জন্য সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছেন। তাঁরা একটি কৃত্রিম মানব ফুসফুস তৈরি করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, Chronic Obstructive Pulmonary Disease এর সময় ফুসফুসের কোষগুলো কিভাবে কাজ করে তা জানা ও এর প্রতিষেধক উদ্ভাবন করা।। এটি হচ্ছে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভয়াবহ রোগ যাতে আমেরিকার অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আয়েশা একই সাথে বিভিন্ন স্নায়বিক ব্যাধি ও মস্তিষ্কে রক্ত-ক্ষরণ নিয়েও গবেষণা করছেন।

শুধু একজন তরুণ কৃতি বিজ্ঞানী হিসেবেই নয়; আয়েশা সত্যিকারার্থে নিজের মনের গহীনে লালিত্য দেশাত্মবোধের যে পরিচয় মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেছেন তা আমাদের মুখ উজ্জল করে বৈকি। বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে দেশে ফিরে মানুষের জন্য কাজ করতে আগ্রহী তিনি।’ শুধু তাই নয়, দেশে থাকাকালীন সময়ে তিনি নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি এইচ আই ভি/এইডস নিয়ে পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও কাজ করেছেন।

দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তার ইচ্ছের কথাও আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘তাঁর ইচ্ছা দেশে এসে নিজের বাড়িতে একটি স্কুল খোলার। যেখানে যে কোন শিশু বিজ্ঞান ও গণিত পড়ার সুযোগ পাবে।’

আমরা চাই আয়েশার , মনোস্কামনা পূর্ণ হোক।

বলাবাহুল্য, আয়েশা তার বক্তব্যে আর একটি উদার মানসিকতার পরিচয় মিলেছে। তিনি  বলেছেন, ‘আমি আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করি ভাগ্য ও আশেপাশের কিছু মানুষের সহযোগিতা ছাড়া আমার এই সাফল্য আসতো না।’ তিনি বলেছেন, “ আমি আমার গবেষণাগারের মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি আনন্দিত যে ব্যতিক্রম কিছু করার সুযোগ পেয়েছি”। তিনি আরো বলেছেন, ‘লস আলামসে কর্মরত অন্য অনেক দেশের গবেষক বিশেষ করে মন্টেনিগ্রোর গবেষক Momo Vuyisich তাঁর জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।’

আমরা এই বাংলাদেশী স্বর্ণকন্যার আরো সুখ্যাতি এবং আরো সাফল্য কামনা করি।

mhniru@gmail.com

ক্যালগেরি, কানাডা।

 

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.