রহস্যময় তিব্বত

রহস্যময় তিব্বত

বহির্বিশ্বের কাছে বছরের পর বছর ধরে এক নিষিদ্ধ” বিস্ময়ের নাম তিব্বত। হাজার হাজার কিলোমিটার চলে যাওয়া ঊষর, রুক্ষ, পাথুরে ভূমি আর পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গগুলোকে বুকে ধরা বরফগলা রুপালি নদীর সমন্বয়ে গঠিত এ বিস্ময়ভূমির এই তিব্বত। সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে নিষিদ্ধ দেশ তিব্বত আর নিষিদ্ধ নগরী তিব্বতের রাজধানী লাসার কথা পড়েনি এমন কেউ নেই। কেন তিব্বতকে নিষিদ্ধ দেশ বলা হয়? কী এমন গাঢ় রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা তিব্বতের অবয়ব? অবাক করা, জাদুময় রহস্যমন্ডিত ভূখণ্ড তিব্বতের নানা দিক নিয়েই এ প্রতিবেদন।

হিমালয়ের উত্তরে ছোট একটি দেশ হলো তিব্বত। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ দালাইলামা কর্তৃক প্রবর্তিত গণচীনের একটি স্বশাসিত অঞ্চল এটি। মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত এ অঞ্চলটি তিব্বতীয় জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। তিব্বত তার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো মালভূমিগুলোর জন্য জগদ্বিখ্যাত। এখানকার মালভূমির গড় উচ্চতা ১৬,০০০ ফুট; যার কারণে এই অঞ্চলকে পৃথিবীর ছাদও বলা হয়।

তবে এখানকার অনেক তিব্বতীয় এই অঞ্চলকে গণচীনের অংশ মানতে রাজি নয়। ১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিদের স্বাধিকার আন্দোলনে ব্যর্থ হয়। তখন দালাইলামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তিব্বতের রাজধানীর নাম লাসা। এখানকার অধিকাংশ মানুষই বৌদ্ধ”ধর্মাবলম্বী।

চিরতুষারে ঢাকা তিব্বত পৃথিবীর উচ্চতম স্থানও বটে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই তিব্বতকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে অনেক রহস্য। তিব্বতের রাজধানী লাসা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখানে বহির্বিশ্বের লোকের কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। দেশটি পৃথিবীর অন্যান্য সব অঞ্চল থেকে একেবারেই বিচ্ছন্ন ছিল। লাসা নগরীর বিখ্যাত পোতালা প্রাসাদের ছবি প্রথমবারের মতো নজরে আসে ১৯০৪ সালে। আমেরিকার বিখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় এই ছবি ছাপা হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো সভ্য মানুষ এই বিশাল প্রাসাদের ছবি দেখেনি। তিব্বতের চতুর্দিকে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পাহাড়ি গুম্ফা। সেই পাহাড়ি গুম্ফাগুলোতে বাস করে বৌদ্ধ পুরোহিত লামারা। গুম্ফাগুলো নিয়েও রহস্য আর জল্পনা-কল্পনার কোনো শেষ নেই। বাইরের পৃথিবীতে তিব্বত যেন চেনা পৃথিবীর এক অচেনা অধ্যায়। এই জায়গাটা নিয়ে মানুষের মধ্যে বিচিত্র সব ধারণা। রহস্যঘেরা তিব্বত নিয়ে পৃথিবীর মানুষের তাই কৌতূহলের শেষ নেই। সত্যিই কী আছে এই নিষিদ্ধ দেশটায়?

তিব্বতের মতো অজ্ঞাত দেশ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এ দেশটি সম্পর্কে কিছুই যেন জানা যায় না। প্রাকৃতিক দুর্গমতার জন্যই তিব্বত অপরিচিত থেকে গেছে। রাজধানী লাসা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরত্বের মাঝেই আছে বিরাট গোবি মরুভূমি। সেদেশের বেশিরভাগ স্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০০ ফুটেরও ওপরে। বছরের প্রায় ৮ মাস জায়গাটি তুষারে ঢেকে থাকে। ধর্ম তিব্বতীদের সামাজিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাদের প্রধান ধর্মগুরুর নাম দালাইলামা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সেখানে লামা বলে পরিচিত। এর অর্থ হচ্ছে সর্বপ্রধান। দালাই শব্দের অর্থ হলো জ্ঞানসমুদ্র। দালাইলামার মানে হচ্ছে জ্ঞানসমুদ্রের সর্বপ্রধান। তিনি বাস করবেন সোনার চূড়া দেওয়া রহস্যময় পোতালা প্রাসাদে। ১৩৯১ সালে প্রথম দালাইলামার আবির্ভাব ঘটে। দালাইলামাকে তিব্বতীরা বুদ্ধের অবতার মনে করেন। তিব্বতীদের বিশ্বাস, যখনই কেউ দালাইলামার পদে অভিষিক্ত হন তখনই ভগবান বুদ্ধের আত্মা তার মধ্যে আবির্ভূত হয়। এক দালাইলামার মৃত্যুর পর নতুন দালাইলামার নির্বাচন হয়। এটি একটি রহস্যময় এবং রোমাঞ্চকর পদ্ধতি। বর্তমান দালাইলামা রাজনৈতিক কারণে দেশান্তরী। তিনি এখন ভারতে অবস্থান করছেন। বিশ্ব শান্তির জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

তিব্বতীদের দালাইলামা বা নেতা নির্বাচনের পদ্ধতিটি খুবই বিচিত্র। তিব্বতি প্রথা মতে কারো মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার মরদেহের সৎকার হয় না। তাদের দৃড় বিশ্বাস, মৃত্যুর পরও আত্মা জাগতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ করে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মা জাগতিক পরিমণ্ডল ত্যাগ না করে তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মরদেহটি তাদের বাড়িতে রেখে দেয়। কোনো লামার মৃত্যু হলে লাসার পূর্বে লহামপূর্ণ সরোবরের তীরে লামারা ধ্যান করতে বসে। তারা এক রহস্যময় কারণে কিছু অদ্ভুত বিশ্বাসকে লালন করে। ধ্যানযোগে লামারা দেখতে পায় সেই সরোবরে স্বচ্ছ পানির ওপর ভেসে উঠছে একটি গুম্ফার প্রতিবিম্ব। যে গুম্ফার পাশে আছে একটি ছোট্ট বাড়ি। প্রধান লামা তার সেই অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা দৃশ্যের মাধ্যমে এঁকে দিবেন। বড় বড় লামারা সেই দৃশ্যের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন। তারপর কয়েকজন লামা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে যায় শিশু অবতারের খোঁজে। বর্তমান দালাইলামাকে পাওয়া গিয়েছিল এমনি এক পদ্ধতির মাধ্যমে। খোঁজ চলাকালীন একটি দল উত্তর-পূর্বে আম দো প্রদেশের অন্তর্গত দো খাম জেলার তাকসের গ্রামে পেঁৗছে দূর থেকে একটি গুম্ফা দেখতে পেলেন। সেখানেই ছোট্ট একটা কুটির। অবিকল যেন সেই প্রধান লামার এঁকে দেওয়া ছবিটির মতো। দলনেতা এবার একজন সঙ্গী লামাকে গুম্ফার অদূরে ওই বাড়িটিতে খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য পাঠালেন। লামাটি ফিরে এসে জানালেন, ওই কুঠিরে একজন কৃষক সপরিবারে বাস করেন এবং তার ছোট ছেলেটির বয়স দু’বছর। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল লামাদের মুখ। তারা তাহলে সঠিক জায়গাতেই এসেছেন। আশ্চর্যের কথা, সেখানে যাওয়ামাত্র সেই দু’বছরের শিশুটি এসে দলনেতা লামাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যেন তিনি তার কতকালের চেনা। এবার শুরু হলো আসল পরীক্ষা। লামারা শিশুটির শরীরের বিভিন্ন লক্ষণ দেখে বুঝলেন। শিশুটি অত্যন্ত সুলক্ষণযুক্ত। ত্রয়োদশ দালাইলামার ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র তারা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। জপের মালা, ধর্মচক্র, টুপি, পোশাক, লাঠি ইত্যাদি। ওই জিনিসগুলোর সঙ্গে একই রকম মালা, লাঠি ইত্যাদি মিলিয়ে শিশুটির সামনে রাখা হলো। দু’বছরের ছোট শিশুটি কিন্তু সঠিকভাবে ত্রয়োদশ দালাইলামার জিনিসগুলোই বেছে নিলেন। এভাবে পরীক্ষা ও প্রমাণ শেষ হলে সন্তুষ্ট লামারা ত্রিরত্নের শরণ নিলেন এবং তাদের অভিপ্রায় শিশুটির পিতার কাছে জানালেন। তিব্বতি পিতা-মাতার কাছে এ যেন মহাপুণ্যের ফল। সামান্য কৃষক তারা, তাদের ঘরে কিনা জন্ম নিয়েছেন স্বয়ং দালাইলামা। এরপর সেই অবতার শিশু ও তার পরিবারের লোকজন সবাইকে নিয়ে লামারা রাজধানী লাসার উদ্দেশে রওনা হলেন। লাসায় পৌঁছানোর পর জনসাধারণ বিপুল উল্লাসে অভ্যর্থনা জানালেন শিশু অবতারকে। কিন্তু সেখানেও আরও অনেক পরীক্ষা দিতে হলো শিশুটিকে। অবশেষে লামারা নিশ্চিন্ত হলেন যে, এই শিশুই দালাইলামা। অন্যদিকে শুরু হলো শিশু অবতারের বিভিন্ন শিক্ষা। বিডিপ্রতিদিন

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.