শেখ মুজিবুর রহমান, আঁধারভেদী এক আলোক-শিখার নাম

শেখ মুজিবুর রহমান, আঁধারভেদী এক আলোক-শিখার নাম

জাহিদ হাসানঃ শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫), আঁধারভেদী এক অনির্বাণ আলোক-শিখার নাম। তৎকালীন ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ার পবিত্র ভ‚মিতে যেদিন (১৭ মার্চ, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ) তিনি সেদিন হতেই শোষিত বাংলার আকাশ-ছোঁয়া অন্ধকার খান খান হয়ে ভেঙে পড়তে থাকে। জন্মমূহূর্তেই তিনি স্বর্গ থেকে বুক ভরে ভালোবাসা নিয়ে এসেছিলেন বাংলার নিপীড়িত মানুষের জন্য। তিনি ছিলেন সর্বংসহা, নীলকণ্ঠ। সমগ্র বাঙালির গøানির গরল আমৃত্যু একা একা পান করেছেন, গড়তে চেয়েছেন সুখী, সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরে ঘাতকের বুলেট-অক্ষর বঙ্গবন্ধুর বুকে কলঙ্কের নকল-নকশা রচনা করে। আজকের আধুনিক বাংলাদেশে সেই পুরাতন, বিকৃত পাঠ বাতিল বলে গণ্য হচ্ছে। নতুন দিনের রক্তলাল ইতিহাস নির্মাণ করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আশাবাদী নতুন মানুষ। এই নব-ইতিহাসে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নবরূপে উদ্ভাসিত হচ্ছেন। একবিংশ শতাব্দীতে নতুন আলো নিয়ে আবিভর্‚ত হয়েছেন বিংশ শতাব্দীর লড়াকু শেখ মুজিব। বুলেটের সামান্য সন্ত্রাস বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল জ্যোতিষ্ককে নেভাতে পারেনি, রক্তকল্লোল গ্রাস করতে পারেনি তাঁর বর্ণাঢ্য বিচ্ছুরণ। বঙ্গ-রাজনীতির বিশাল ইতিহাসে শেখ মুজিবই সর্বোচ্চ অগ্নিশিখা।

বাঙালি জাতির বর্ষপঞ্জিতে পাঁচটি বিশেষ মাস শ্রেষ্ঠসন্তানদের রক্ত দিয়ে আঁকা। ফেব্রæয়ারির ২১ তারিখ ভাষা-সংগ্রামীদের রক্তদানের দিন। আগস্ট মাসের প্রথম, তৃতীয় এবং শেষ সপ্তাহে লোকান্তরিত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ তিনজন বাঙালিÑ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। ৩ নভেম্বর কারাগারের অন্ধকারে নিহত হন মহান মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় চারনেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে এসে বার বার আমাদের অশ্রæ ঝরিয়ে যায়। মার্চের পঁচিশ তারিখ ছাড়া সাত, সতেরো ও ছাব্বিশ মার্চ ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনায় বাঙালির মনে দোলা দিয়ে যায়। এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিনের একক কৃতিত্বের অধিকারী শুধু একজনই। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির হাজার বছরের আকাক্সক্ষা বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে ঘোষিত হয়। ওই দিন রমনার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে মাত্র আঠারো মিনিটে এক হাজার একশত পাঁচ শব্দের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু। এ ভাষণ সত্যিকার অর্থেই ‘স্বতঃস্ফ‚র্ত মহৎ কবিতা।’ একটি অনন্য-কবিতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বিস্ফোরণ-উন্মুখ বাংলাদেশের স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ সাড়ে সাত কোটি, বিচ্ছিন্ন বাঙালিকে একসূত্রে গ্রথিত করেছিল। মাতৃভ‚মিকে ঔপনিবেশিক শক্তির জাল থেকে মুক্ত করার জন্য রক্ত শপথে উদ্দীপ্ত করেছিল। ‘রাজনীতির কবি’ বলে অতুল সম্মানের যে শিরোপা তাঁর মস্তকে জ্বলজ্বল করছে এই বিরল গৌরবের উৎস কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণই। একটি নজিরবিহীন কালোত্তীর্ণ ভাষণ শোষিত মানুষকে কিভাবে স্বাধীনতার মোহনায় নিয়ে যেতে পারেÑ আপসহীন জননায়ক শেখ মুজিবুর রহমান পৃথিবীকে তা দেখিয়ে গেছেন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় অসংখ্য মহাকাব্যিক ভাষণ দিয়েছেন। আমরা যদি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে প্রদত্ত ভাষণ শুনি তাহলে বুঝব মুক্ত-স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে বন্ধুপ্রতিম ভারতের মাটিতে কী ঐশী শ্লোক উচ্চারণ করেছিলেন তিনি। একই দিন বিকেলে রমনার রেসকোর্স ময়দানে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে তিনি যে আবেগময় বাকজাল বিস্তার করেন, তার দৃষ্টান্তও পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।

১৯ জুন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন, সেটাও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো ঘটনা। আমলাতন্ত্রের আগল ভেঙে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার তিনি ওই ভাষণে ব্যক্ত করেছিলেন বাংলার সমগ্র ইহিাসে তা অমর হয়ে থাকবে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু থেকেই গণমানুষের নজর কেড়েছিল। পঁচাত্তর-পরবর্তী  বাংলাদেশে দীর্ঘ একুশ বছর এ ভাষণ অবরুদ্ধ থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে মাঝে মাঝে এ ভাষণ বাতাসে বেজে ওঠে। আবার কালো ঝড়ে সুদূরে মিলিয়ে যায়। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ঐতিহাসিক এই ভাষণকে ‘বিশ্ব-ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। এর ফলে নতুনভাবে আলোচনায় উঠে আসে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। এই ভাষণ নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উত্থাপিত হয়েছে। দেশ-বিদেশের বরেণ্য গবেষক, সমালোচক এই ভাষণের কাব্যিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও রণনৈতিক মূল্যায়ন উপস্থিত করেছেন। যার ফলে এ ভাষণের সুদূর-প্রসারী প্রভাব উপলব্ধি করা সম্ভব হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে শুধু জ্ঞানী-গুণী-বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাই আলোকপাত করেননি, বঙ্গবন্ধু নিজেও এ ভাষণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বার বার বাংলার মানুষকে অবগত করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি কী ছিল সেই বিষয়টি একটু আলোকপাত করলে ইতিহাসের একটি বিতর্কিত অধ্যায় মুছে ফেলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো গবেষক এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন কিনা তা আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে ৭ মার্চ সব সময়ই গুরুত্ববহ ছিল। তিনি মনে করতেন ৭ মার্চের বিদ্রোহী বিকেলেই ঘোষিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন,

“স্বাধীনতার ইতিহাস কোনোদিন মিথ্যা করতে নাই। আমার সহকর্মীরা যারা এখানে ছিল তারা সকলে জানতো যে, ২৫ তারিখ রাত্রে কী ঘটবে। তাদের বলেছিলাম, আমি মরি আর বাঁচি, সংগ্রাম চালিয়ে যেও। বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। ৭ মার্চ কি স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলার বাকি ছিল? প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেদিন পরিষ্কার বলা হয়েছিল, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রামÑ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।” [সূত্র : মোনায়েম সরকার (সম্পা.) শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর শত-ভাষণ, পৃ. ৩৯৮, প্রথম মুদ্রণ, ফেব্রæয়ারি, ২০২০, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা]

১৯৭৪ সালে এমন কি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল, যার কারণে বঙ্গবন্ধুকে ৭ মার্চের ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রসঙ্গে কথা বলতে হয়েছিল? এই প্রশ্নের একটি উত্তর খোঁজা দরকার। স্বাধীনতার ‘ঘোষণা’ ও ‘ঘোষক’ নিয়ে যথেষ্ট জল ঘোলা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক রায় ঘোষিত হওয়ার পরেও ওই প্রশ্নের সর্বসম্মত সমাধান হয়েছে বলে মনে হয় না। বঙ্গবন্ধুর রচিত গ্রন্থাবলি ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে আজকে অনেক ঘটনা পরিষ্কার করে দিচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ-বক্তৃতা ব্যাখ্যা করলেও উপরিউক্ত বিতর্কের জবাব পাওয়া যায়।

৭ মার্চের ঘোষণাই যে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এ বিষয়ে আরেকটি সমর্থন পাওয়া যায় ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজের জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। এ ভাষণে তিনি বলেন,

আমি বলেছিলাম বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। আমি বলেছিলাম ৭ মার্চ তারিখে, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ [সূত্র : পূর্বোক্ত পৃ. ২৪১]   

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত ভ্রমণ করেন ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি। এদিন তিনি ভারতের মাটিতে বলেন,

গত ৭ই মার্চ তারিখে আমি জানতাম পৈশাচিক বাহিনী আমার মানুষের উপর আক্রমণ করবে। আমি বলেছিলাম ‘আমি যদি হুকুম দেবার না পারি তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ তৈয়ার কর’। আমি বলেছিলাম ‘যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবিলা কর।’ আমি বলেছিলাম, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’  [সূত্র : পূর্বোক্ত পৃ. ২০৩-২০৪]   

বঙ্গবন্ধুর এ কথায় প্রমাণিত হয় ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। আজকাল অনেকেই মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ ও প্রয়াত জিয়াউর রহমানকে উদ্ধৃত করেনÑ ৭ মার্চের ভাষণকে গুরুত্ববহ করার জন্য। উপরিউক্ত সেনা কর্মকর্তাদ্বয় নাকি বলেছেনÑ ৭ মার্চের ভাষণই ছিল তাদের জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধের গ্রিন সিগন্যাল’।  আমার মনে হয় উনারা স্বীকার না করলেও এই ভাষণই যে স্বাধীনতার ঘোষণা তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না।

রাজনীতি এমন এক রহস্যময় শাস্ত্র যেখানে সত্য-মিথ্যা-কল্পনা-গুজব একসঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকে। দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য অনেক সময়ই রাজনীতিবিদগণ মিথ্যার, ছলনার আশ্রয় নেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক চরিত্র। রাজনৈতিক কখনোই তিনি মিথ্যার ছদ্মবেশ গ্রহণ করেননি। মরে যেতে চেয়েছেন, অথচ মিথ্যা বলে মুক্তি পেতে চাননি। তিনি তাঁর ভাষণে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,

আমি মিথ্যা ওয়াদা করতে পারি নাই। আমি মিথ্যা ওয়াদা জীবনে কোনোদিন করি নাই। আমি আপনাদের ভোট নিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। আমি বলেছিলাম ৭ মার্চ তারিখে, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ [সূত্র : পূর্বোক্ত পৃ. ২৪১]   

বঙ্গবন্ধু কখনোই চাননিÑ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হোক এবং এটা অঙ্কুরে বিনষ্ট হোক। আমৃত্যু সংগ্রামী শেখ মুজিব দেখেছেন বৃহৎ শক্তি কিভাবে স্বাধীনতার আন্দোলন যুগে যুগে নস্যাৎ করে দিয়েছে। তাঁর সামনে নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার (১৯৬৭-’৭০) জ্বলন্ত উদাহরণ ছিল। তাই তিনি ওই পথে না-হেঁটে দেশের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে পাকিস্তানি দখলদার কর্তৃক চ‚ড়ান্ত আক্রমণের অপেক্ষায় থাকেন। ২৫ মার্চ কালরাত্রে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক বাঙালিনিধন অভিযান শুরু হলে গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেনÑ সেই সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নিজেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক ৭ জুন তারিখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে। তিনি বলেনÑ

২৫শে মার্চ রাত্রে ইয়াহিয়া বর্বর বাহিনী আমার উপর আক্রমণ চালায়। সেদিন রাতে আমার অবস্থা যে কেমন ছিল সেটা কেবল আমিই জানি। আমি জানতাম ঘর থেকে বের হলেই আমাকে গুলি করে মারবে। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কিন্তু বাংলার মাটিকে আমি ছাড়তে পারি নাই। রাত্রি ১১টার সময় আমার সমস্ত সহকর্মীকে, আওয়ামী লীগের নেতাদের হুকুম দিলাম, বের হয়ে যাও যেখানে পার। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। খবরদার, স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেয়ো।

রাতে আমি চট্টগ্রামে নির্দেশ পাঠালাম। আগে যাকে ই,পি,আর বলা হতো,তাদের সদর দফতর ছিল চট্টগ্রামে। পিলখানা হেডকোয়ার্টার তখন শত্রæরা দখল করে নিয়েছে। ওদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। আমি যখন পিলখানার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না তখন আমি চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগ করে বললাম, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। তোমরা বাংলার সব জায়গায় ওয়ারলেসে এ খবর দিয়ে দাও। পুলিশ হোক, সেনাবাহিনী হোক, আওয়ামী লীগ হোক, ছাত্র হোক, যে যেখানে আছে, পশ্চিমাদের বাংলা থেকে খতম না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাও। বাংলাদেশ স্বাধীন। তারা আমার কথা মতো খবর পৌঁছিয়েছিল। [সূত্র : পূর্বোক্ত পৃ. ২৯০]

বঙ্গবন্ধু সে-রাতে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণ করেছিলেন বলেই কালুর ঘাটের বেতার কেন্দ্র স্বাধীনতার ঘোষণা প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছিল। তা নাহলে আর কেউ কি স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারত? নাকি সে-অধিকার অন্য কারো ছিল?

আমরা ইতিহাসে দেখি ৭ মার্চের ভাষণের পরেই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হস্তগত হয়। তখন শেখ মুজিবের নির্দেশেই পরিচালিত হয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু যদি ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না-ও করতেন তবু বাঙালি মরণপণ যুদ্ধ করত ৭ মার্চের ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু কী বলেছিলেন তা একটু পাঠ করা যাকÑ

‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহŸান জানাচ্ছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চ‚ড়ান্ত বিজয় না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’  [সূত্র : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ষষ্ঠ তফসিল, পৃ. ৭৮, অক্টোবর ২০১১]

উপরিউক্ত ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু মাত্র তিনটি বাক্য ও তেপ্পান্নটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। এই ঘোষণার প্রথম বাক্য ছাড়া আর সবকিছুতেই আছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিধ্বনি। সুতরাং ৭ মার্চ এবং ২৬ মার্চ একই সূত্রে গাঁথাÑ এমন সিদ্ধান্ত অনায়াসেই গ্রহণ করা যায়। বঙ্গবন্ধু নিজেই তা বার বার উল্লেখ করেছেন।

১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,

২৫ মার্চ [রাত ১২.২০ মিনিটে] তারিখে আমি যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম, আমি যখন বাংলার মানুষকে ডাক দিলাম তখন আমি গ্রেফতার হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার সহকর্মীরা আমার অনুপস্থিতিতেও সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংগ্রাম উপরের থেকে পড়ে নাই। নজরুল তখন অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট আমাকে করে। তাজউদ্দিন প্রাইম মিনিস্টার হয়েছিল। তারা দেশের এই সংগ্রাম চালায়। অবশ্য আমাদের সহযোগী দু-একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আমাদের সমর্থন দিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি দিয়েছিল। আমাদের মুফাফ্ফর ন্যাপও দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন প্রতিষ্ঠান ছিল কার? নেতৃত্ব ছিল কার? আজ যারা বড় বড় কথা বলে, কোথায় ছিল তারা? কোথা থেকে তারা এসেছে? কে তাঁদের কথা শুনত?        

[সূত্র : মোনায়েম সরকার (সম্পা.) শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর শত-ভাষণ, পৃ. ৩৯৭, প্রথম মুদ্রণ, ফেব্রæয়ারি, ২০২০, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা] 

বঙ্গবন্ধুর সময়েই তাঁর প্রতিপক্ষ একটি অপশক্তি তৈরি হয়েছিল। এদের পালকপিতা ছিল আমেরিকা, চীন, পাকিস্তান। ‘প্রগতিশীল’ ছদ্মনামের আড়ালে এরা গুপ্তচরবৃত্তি, নরহত্যা ও লুন্ঠন করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু যখন এদের দমন করতে পদক্ষেপ নেন, তখন এই ডুবন্ত বিশ্বাসঘাতকগুলো খড়কুটোর মতো উচ্চাভিলাসী জিয়াউর রহমানকে আঁকড়ে ধরে। জিয়াউর রহমান সে-সুযোগ এমনভাবেই গ্রহণ করেন যে পুরো বাংলাদেশের ইতিহাসই বদলে যায়।

পৃথিবীর অনেক কিছুই ইতঃপূর্বে বদলেছে। অনেক পুরাতন শাস্ত্রসূত্র, বিধান, রীতি-নীতি-দিবসের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে নতুন সত্য। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও বঙ্গবন্ধুর বিশ্লেষণ থেকে এ দাবি যৌক্তিকভাবেই উত্থাপন করা যায় ২৬ মার্চের পরিবর্তে ৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-দিবস ঘোষণা করা হোক। হয়তো এ জন্য আমাদের সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে, তাতে কিছু যায় আসে না। বাংলাদেশের সংবিধান বঙ্গবন্ধুই প্রণয়ন করে রেখেছেন। তাঁর স্বপ্নের সংবিধানে তাঁর নাম যুক্ত হতে আপত্তি কোথায়। ১৯৭২ সালের নবীন বাংলাদেশ আর আজকের আধুনিক বাংলাদেশ কখনোই সমান সহানুভ‚তিতে তুলনাযোগ্য নয়। অনেক পÐিত মানুষের গবেষণায় প্রতিনিয়ত নতুন সত্য আবিষ্কৃত হচ্ছে। সেই নতুন সত্যের আলোতেই ৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।

৭ মার্চ স্বাধীনতা-দিবস হিসেবে ঘোষিত হতে পারে আরো একটি যুক্তিতে। তাহলে বিজয় দিবসের ইতিহাসের সঙ্গে হুবহু মিলিয়ে নেওয়া যায় ৭ মার্চকে। রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ভাষণ দেওয়া হয় লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে অপরাহ্ণে। আমাদের চ‚ড়ান্ত বিজয়ও একই জায়গায় একই পরিস্থিতি স্বাক্ষরিত হয়। যে মাঠে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা, সে মাঠেই চ‚ড়ান্ত বিজয়। রাতের অন্ধকারে পশ্চিমা কাপুরুষেরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলেই তিনি সর্বশেষ বাণী পাঠ করেছিলেন স্বাধীনতার নামে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো রাতের অন্ধকারে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করার মতো মানুষ নন। আশা করি রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতীয় ঐক্য ও স্বাধীনতার প্রতীক। তিনি এমন এক নেতা যাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা অবর্ণনীয়। তাঁর হাত ধরেই জন্ম নেয় স্বাধীন, সার্বভৌম নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাঙালির স্বাধীনতার মহামন্ত্র তিনিই প্রথম দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেন এবং বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে প্রতিস্থাপন করেন। তাঁর অনুপম নেতৃত্বের বিকল্প কোনো দিনই বাংলার মাটিতে ছিল না, এখনো নেই। হয়তো ভবিষ্যতেও হবে না.

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.