সংবাদপত্র হোক মুক্তচিন্তার বাতিঘর

সংবাদপত্র হোক মুক্তচিন্তার বাতিঘর

মোনায়েম সরকার: আধুনিক জীবন সংবাদপত্র ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। সংবাদপত্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের খবরাখবর আমাদের সামনে এনে হাজির করে বলেই এর গুরুত্ব আমরা স্বীকার করছি ব্যাপারটা এমন নয়। সংবাদপত্র শুধু সংবাদ পরিবেশনই করে না, এটি সুস্থ, সুন্দর সমাজ গঠনেও অপরিসীম ভূমিকা রাখে। মানুষের সংস্কৃতির মান ও রুচিবোধ তৈরিতেও সংবাদপত্রের অবদান অসামান্য।

আধুনিক নগরজীবনেই শুধু নয়, গ্রামীণ জীবনেও সকাল হলেই রঙ-বেরঙের পত্রিকা হকারের হাত ধরে পৌঁছে যায় আমাদের ঘরে ঘরে। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের সংবাদপত্রের চেহারা মোটেই এমনটি ছিল না। তখনকার সংবাদপত্র সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন পুঁজির ছোঁয়া লাগার সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে সংবাদপত্রের আকার ও আদর্শ। এক সময় সংবাদপত্রের উদ্দেশ্য ছিল দেশের মানুষকে বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক খবর জানানো। যেখানে মানবতার লাঞ্ছনা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিবেকের কণ্ঠরোধ সেখানেই সংবাদপত্র প্রতিবাদী, কিন্তু দিন যত যাচ্ছে ততই দেখছি সংবাদপত্র এসব বৈশিষ্ট্যকে পরিহার করে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম পরিণত হওয়ার চেষ্টা করছে।

আজকের সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্ব সব মানুষই কমবেশি উপলব্ধি করছে। মানুষ বুঝতে শিখেছে ধর্ম আর রাষ্ট্র এক জিনিস নয়। রাষ্ট্র যদি কোনো বিশেষ ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে, তাহলে সেই রাষ্ট্রে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। যা পরিণামে রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্ট করে। গোত্রে গোত্রে ছড়িয়ে দেয় নীরব সন্ত্রাস। এক সময় বাংলাদেশে সংবাদপত্রগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষেই ছিল, কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে ধর্মীয় উস্কানি ছাপা হয় বা প্রকাশ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী ধর্মীয় বক্তব্য ছাপা হয় এমন সংবাদপত্রের সংখ্যা অনেক। এমন কি বেশ কিছু সংবাদপত্র আছে যারা কৌশলগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে এ রকম সংবাদপত্রের হিসাব সরকারের কাছেও আছে কিনা সন্দেহ।

বর্তমান কালে হলুদ সাংবাদিকতাভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমাদের যৌবনে আমরা এমনভাবে হলুদ সাংবাদিকতা দেখিনি। আজ হলুদ সংবাদ সত্য সংবাদকেই যেন গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। দিনে দিনে আমাদের সংবাদপত্রগুলো আরো কত সর্বনাশ রূপ নিবে এখনই তা অনুমান করা যাচ্ছে না, তবে এভাবে চলতে থাকলে সংবাদপত্রের উপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এক সময় মাওলানা আকরম খাঁ, নাসিরউদ্দিন আহমদ, তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম, কাজী মহম্মদ ইদ্রিস প্রমুখ সম্পাদকবৃন্দ যে মানের পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, এখনকার যুগে সে মানের সম্পাদক পাওয়া কঠিন, যদিও এ যুগে সহজেই একটি মানসম্মত পত্রিকা সম্পাদনা করা যেতে পারে। পূর্বসূরিদের আদর্শধারণ করে যদি এ সময়ের সম্পাদকগণ পত্রিকা প্রকাশ মনোনিবেশ করেন, তাহলে এদেশের সংবাদপত্র নতুন করে প্রাণ পাবে বলে বিশ্বাস করি।

পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে সংবাদপত্রও নিচ্ছে পুঁজিবাদী রূপ। কার পত্রিকা কত বড় হলো, কে কত পৃষ্ঠার রঙিন ছবি ছাপালো, কার সার্কুলেশন কত, কে কাকে টপকে এগিয়ে গেল, কার মুনাফা ও বিজ্ঞাপন আয় বেশি, এগুলোই এখন সংবাদপত্রের ক্রেডিট বলে গণ্য। এর ফলে সাধারণ মানুষ তাদের কাক্সিক্ষত সংবাদপত্রের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সংবাদপত্র হারাচ্ছে তার ঐতিহ্যের গৌরব। কিছু কিছু সংবাদপত্র এখনো তাদের সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী ও পুঁজিবাদবিরোধী মানসিকতা ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের অবস্থা ভীষণ করুন, যেন শ্বাসকষ্টের রোগীর মতো কোনো ক্রমেই নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে। যে কোনো সময়ই এসব ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে নতুন গজিয়ে ওঠা পত্রিকাগুলো বরং খুশিই হবে।

বাংলাদেশে এখন ব্যবসায়ীরা সংবাদপত্রের মালিক হচ্ছে। যেমনভাবে ব্যবসায়ীরা মালিক হচ্ছে হাসপাতাল আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই দুটো সেবাখাতই এখন অঢেল অর্থ উপার্জনের শক্তিশালী উৎস। আগে হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হতো মানুষকে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ভালো চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষা সেবা দেওয়ার জন্য। এখন এগুলো করা হয় মানুষের পকেট কাটার জন্য। সংবাদপত্র এখন ব্যবসায়ীদের ব্যবসার হাতিয়ার, টাকা উপার্জনের অভিনব কৌশল। এটা আবার আত্মরক্ষার কাজে ভীষণ উপকারী অস্ত্র।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রকাশিত সবগুলো পত্রিকার মানই যে ভালো ও দৃষ্টান্তযোগ্য এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। এদেশে যেমন গুটি কয়েক সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদপত্র আছে, তেমনি অসৎ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদপত্রের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। একটি রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সংবাদপত্র রাখতে পারে অপরিসীম অবদান। দলাদলি ও লেজুড়বৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠে যথাযোগ্য দায়িত্ব পালন করাই একটি আদর্শ সংবাদপত্রের কাজ। কিন্তু এখনকার সংবাদগুলো হয় দলীয় উদ্দেশ্যে কাজ করে, নয়তো টাকা বানানোর কাজে ব্যবহৃত হয়, যা একজন পাঠক হিসেবে মোটেই কাম্য নয়।

ইদানীং সংবাদপত্রে বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঘটা করে আয়োজন ও কেক কাটার ধুম দেখে ভীষণ প্রশ্ন জাগে মনে, কে কেক কাটলো, কে কাকে মিষ্টি বা কেক খাইয়ে দিল,  এসব জেনে পাঠকের কি লাভ হয় জানি না। তবে যার ছবি ছাপা হলো কেক কাটা বা খাওয়ানোর অছিলায় তার কাছ থেকে একটু সাহায্য পাওয়ার আশা থাকলে সেই আশা বিফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখানেও পুঁজির চিন্তা কাজ করে বলে মনে হয়।

বাংলাদেশে এখন এমন শিল্পপতির সংখ্যা হাতে গোনা যার একটা পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেল নেই। এসব গণমাধ্যম হাতে রেখে তারা লুটপাট করে কিনা জানি না, তবে এদের হাত যে কত বড় লম্বা তা দূর থেকে বোঝার উপায় নেই। সংবাদপত্রকে আবার মানুষের কথা বলার সাহস দেখাতে হবে, তা না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। পাঠকের সঙ্গে বঞ্চনা করে নয়, পাঠকের মন জয় করে পত্রিকাগুলোকে আগামী দিনের কর্ম নির্ধারণের অনুরোধ জানাচ্ছি।

পরিশেষে বলতে চাই, এখনকার সংবাদপত্রগুলো শুধু সংবাদ ছেপেই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে এমন নয়, সংবাদপত্র এখন সাহিত্য ও সৃজনশীল লেখাও নিয়মিত প্রকাশ করছে। এর ফলে নতুন নতুন লেখকও তৈরি হচ্ছে। শাণিত হচ্ছে মানুষের চেতনা। লেখক সৃষ্টির পাশাপাশি লেখক সম্মানীর বিষয়টিও পত্রিকাগুলোকে ভেবে দেখা দরকার। একজন লেখকের লেখার মূল্য দিলে (তার পরিমাণ যতই হোক) সেই লেখক অনুপ্রাণিত হন, লেখতে আগ্রহবোধ করে। এদেশের কয়টা পত্রিকা এখন লেখক সম্মানী দেয় জানি না, না দিলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষগুলোকে এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি, সেই সঙ্গে উপসম্পাদকীয় ও সাহিত্য পাতার লেখাগুলো সমৃদ্ধ ও গঠনমূলক করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি। সংবাদপত্র অর্থ বা ক্ষমতার উৎস না হয়ে মুক্ত চিন্তার বাতিঘর হোক। সংবাদপত্র  হোক সত্যিকার সমাজদর্পণ।  

০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.