সাফল্যের জন্য পরিশ্রমের বিকল্প নেই

সাফল্যের জন্য পরিশ্রমের বিকল্প নেই

মারিয়া ফাইনাল-১

মারিয়া আর্সেনাল্ট। কঠোর পরিশ্রমী এক সার্থক নারীর উজ্জ্বল প্রতিকৃতি। এক সময়ের পেশাজীবী নার্স; আজ নর্থ কানাডার একজন সফল বিজনেস ম্যাগনেট। অন্টারিও’র একটি ফ্র্যানচাইজ টীমহর্টনস কফি ষ্টোরে মাত্র তের বছর বয়সে যিনি শুরু করেছিলেন তার কর্মজীবন তিনিই আজ নর্থ কানাডার সেরা দু’টি ফ্র্যানচাইজ টীমহর্টনস কফি ষ্টোরের গর্বিত মালিক। প্রথম টীমহর্টনসটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে ক্যালগেরির কান্ট্রিহীল, বুলোভার্ট, নর্থওয়েষ্টে। এবং দ্বিতীয়টি ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে একই শহরের ওয়েষ্ট উইন্ডস ড্রাইভ, নর্থইষ্টে। চমৎকার লোকেশনে গড়ে তোলা যে দু’টি টীমহর্টনস ষ্টোর আজ নর্থ কানাডার শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে। এ ছাড়াও পারিবারিকভাবে আরো বেশ ক’টি ব্যবসা প্রতিষ্টানের সাথেও তিনি অংশীদারীত্ব সূত্রে জড়িত আছেন।

নর্থ কানাডার সুবিশাল পরিমন্ডলে অনেক অভিজ্ঞ পুরুষ ব্যবসায়ীদের টেক্কা দিয়ে খুবই অল্প সময়ে এই নারী কী করে উঠে এসেছেন এই সাফল্যের স্বর্ণালী শিখরে; আজ আমরা সে কাহিনীই শুনবো সফল ব্যবসায়ী খোদ মারিয়া আর্সেনাল্টের মুখ থেকে-

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন, সায়লা পারভীন

 

মারিয়া আর্সেনাল্টের জন্মস্থান পোল্যান্ড হলেও খুব অল্প বয়সে তিনি কানাডায় চলে আসেন। মূলত সেই থেকে শুরু হয় প্রতিষ্ঠিত হবার স্থির সংকল্পে সংগ্রামমুখর জীবন। মাত্র তেরো বছর বয়সে একটি টীমহর্টনস কফি ষ্টোরে তিনি শুরু করেন তার কর্মজীবন। এরপর অপর একটি প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন কাজ করলেও পরে তিনি যোগ দেন পেশাজীবী নার্সিং প্রশিক্ষণে। সাফল্যের সাথে প্রশিক্ষণ শেষ করে শুরু করেন নার্সিং জীবন। বলতে গেলে তার নার্সিং জীবনটাও ছিলো সাফল্যের আলোক মালায় উদ্ভাসিত।

মারিয়ার স্বামী অ্যালান আর্সেনাল্ট একজন প্রফেশনাল ল’ইয়ার। দুই সন্তানের জননী মারিয়ার প্রথম সন্তান মেয়ে। নাম রেশাল, বয়স-১৬ এবং ছেলে-ম্যাথিও, বয়স-১৩। পাঠক চলুন তাহলে প্রবেশ করা যাক সাক্ষাৎকার পর্বে-

 

সময়ের কথা : ব্যবসার ক্ষেত্রে তুমি একজন সফল নারী। আমাদের বলবে কি, কিভাবে তুমি এই বিরাট সাফল্য অর্জন করলে? এ সম্পর্কে তোমার অনুভূতি কি?

মারিয়া : অনুভূতি এক কথায় চমৎকার।

আমি মনে করি আমার আজকের সাফল্যের মূল মন্ত্র হচ্ছে কর্মনিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা এবং কঠোর পরিশ্রম।

প্রতিদিন আমাকে ব্যবসায়িক কাজে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। আমি আমার দৈনন্দিন কর্মকান্ড প্রতিদিনই আগাম নোট করে রাখি। যাতে পরের দিনটিতে ব্যবসা পরিচালনায় আমাকে বিপাকে না পড়তে হয়।

আমার ব্যবসায়িক সাফল্যের পেছনে ‘হাসিমুখ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমি বা আমার কর্মচারীরা যতোক্ষণ ষ্টোরে থাকি ততোক্ষণই মুখে হাসি ধরে রাখি। উৎফুল্ল চিত্তে সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে আগত ক্রেতাদের হাতে তুলে দেই কফি। এতে ক্রেতাদের মুখও হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারা সন্তোষ্ট চিত্তে কফি নিয়ে চলে যায়। পরবর্তীতে আবারও ফিরে আসে কফি আর সেই হাসির টানে।

আমার অনেক ভালো কর্মচারী আছে যারা সব সময় হাস্যোজ্জ্বল থাকে। ফলে আমার ষ্টোর দু’টির প্রতি ক্রেতাদের আকর্ষণও বেশী। পূর্বের ক্রেতারাও ফিরে আসে।

মূলতঃ আমার প্রচেষ্টা আর কর্মচারীদের সহযোগিতার ফসলই হচ্ছে, আমার আজকের সাফল্য।

মারিয়া ফাইনাল-২

সময়ের কথা : তোমার আজকের সাফল্যের পেছনে কার অনুপ্রেরণা সব থেকে বেশী?

মারিয়া : এ প্রশ্নের জবাবে আমি বলবো, আমিই আমার সব থেকে বড় প্রেরণা।

ব্যবসা খুব সহজ কাজ নয়। সব সময় মাথায় রাখতে হয়। পাশাপাশি এখানে সময় এবং অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। ফলে এ নিয়ে মাথায় চিন্তাটাও থাকে বেশী।

একটা পর্যায়ে আমাকে অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। যখন আমার বাচ্চারা ছোট ছিলো, আমাকে একই সঙ্গে ব্যবসা এবং সংসার, বাচ্চা-কাচ্চার লালন-পালন সবই সামলাতে হতো। তখন আমি সব সামলে নিয়েছি কঠোর মনোভাবে। বাচ্চারা এখন বড় হয়েছে। আজ সেই সমস্যাটা নেই।

এ ছাড়া আমার দুই ষ্টোরে এখন দক্ষ কর্মচারীরা কাজ করছে; সেদিক থেকেও আমার নিজের ওপর অনেক চাপ কমে গেছে।

এখন আমি নিজের জন্যও সময় বের করতে পারি। টেলিফোনেও তদারকি করে থাকি।

এখন আমি আমার কাজটাকে আমি এনজয় করি।

 

সময়ের কথা : টীম হর্টনস ছাড়া অন্য আর কি কি ব্যবসার সাথে তুমি জড়িত আছো?

মারিয়া : মূলত টীম হর্টনস ষ্টোর দুটোই আমি পরিচালনা করে থাকি। বাকি ব্যবসা প্রতিষ্টানগুলো আমার স্বামী দেখাশোনা করে। তার তত্বাবধানে রেডডিয়ারে একটা হোটেল হচ্ছে। এ ছাড়া ক্যালগেরি, রেডডিয়ার এবং ক্যানমোরে তিনটি রেস্টুরেন্ট হচ্ছে। এ ব্যবসায় আমাদের সাথে বোষ্টন পিজারও যোগ দেবার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি এক্সপ্রেরিয়া ক্রুজের একটা ট্র্যাভেল এজেন্সি আছে আমাদের।

 

সময়ের কথা : ব্যবসা শুরু আগের জীবন সম্পর্কে কিছু বলবে কি?

মারিয়া : নিজের ব্যবসা শুরুর করার আগে থেকেই আমি টীমহর্টনসে কাজ করি। মাত্র তের বছর বয়সেই আমি কর্মজীবন শুরু করি।

বলতে গেলর সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই আমি এ ব্যবসায় পা রাখি; এবং আজও সে অভিজ্ঞতার আলোকেই আমার ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছি।

সে সময় আমি টীমহর্টণস ছাড়াও আরো একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। এরপর আমি নার্সিংয়ে ভর্তি হই। পরে নার্সিংকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করি। আমি ছিলাম লিডারশিপের অপারেটর। পনেরোটা কক্ষ আমার অধীনে ছিলো।

নার্সিং জীবনের পাশাপাশি এক সময় ব্যবসা শুরু করি। অনেকদিন ব্যবসা এবং নার্সিং একই সাথে চালিয়ে গেছি।

 

সময়ের কথা : জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে একজন মানুষের কোন বিষয়টির ওপর সব থেকে গুরুত্ব দেয়া উচিত?

মারিয়া : ভালো মন্দ দুটোকেই সমানভাবে গ্রহণ করতে হবে। কোনোটাকে কম গুরুত্ব দেয়া যাবে না।

 

সময়ের কথা : তোমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের সঙ্গে সম্পর্কে কেমন?

মারিয়া : খুই চমৎকার। আমি সব সময়ই আমার ষ্টাফদের নিজ পরিবারের সদস্যই মনে করি।

প্রতিটি ষ্টাফের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমি কিছু না কিছু জানি।

আমার ষ্টোর দুটোতে শতকরা পঁচানব্বই জন ষ্টাফই নারী। ফলে আমিও সেভাবেই চিন্তা করি, ওদের পরিবারে যেমন সন্তানেরা আছে; আমারও আছে। ওদের সমস্যাগুলোর মতো আমারও একই সমস্যা হয়ে থাকে।

বিশেষ করে বাচ্চাদের কারণেই মায়েরা অধিকাংশ সময় ‘সিককল’ করে, আমি সেটা মেনে নেই। আবার অন্যদিকে ওদের ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে ভালো কিছু করে সেটা শুনেও বেশ আনন্দিত হই। চেষ্টা করি ষ্টাফদের খোঁজ-খবর রাখতে।

আমি সব সময়ই ব্যস্ত থাকি। আমার ষ্টাফ সংখ্যা ১৪৫ জনের বেশী। আর তাই সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে কুশল জিজ্ঞাসা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না; তবে সবাইকে হায়-হ্যালো বলি।

অন্যদিকে, আমি ওদের কালচার সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করি।

আর একটি কথা, আমি ষ্টাফদের থেকে নিজেকে কখনোই আলাদা ভাবিনা । সম্ভব হলে ওদের কাজটাকে আমার নিজের কাজ মনে করি। কেননা আমার স্টাফরা যেনো এটা বুঝতে পারে যে, ওদের আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যার কারণে ওরা এখানে কাজ করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

আমার ষ্টোরের ষ্টাফরা সব সময়ই আনন্দ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করে, যা আমি পছন্দ করি। এখানে এমনও ষ্টাফও আছে যারা দশ বছর যাবৎ কাজ করছে।

আসল কথা হচ্ছে, ব্যবসার ক্ষেত্রে মালিক-কর্মচারীদের মধ্য গুড রিলেশনশীপ সব থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

মারিয়া ফাইনাল-৩

 সময়ের কথা : একজন সফল নারী হিসেবে অন্য নারীদের প্রতি তোমার পরামর্শ কি?

মারিয়া : এ কথা আমরা সবাই জানি যে, নারীদের ধৈর্য বেশী। সে দিক থেকে যে কোনো প্রতিষ্টানের জন্য পুরুষদের চাইতে তারা অধিকতর যোগ্য। অন্য নারীদের প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, তারা যেনো তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে সেই যোগ্যতার সঠিক প্রতিফলন ঘটান।

আমার ষ্টোরে অতীতে এমন অনেকেই কাজ করেছে যারা কাজ ছেড়ে চলে গিয়ে নিজেরা আরো শক্তভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেষ্টা করছে। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত হয়েও গেছে। যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমি সব সময়ই তাদের প্রশংসা করি।

কানাডা হচ্ছে অনেক সুযোগ-সুবিদার দেশ। নারীদের ক্ষেত্র এ কথা আরো বেশী প্রযোজ্য। নার্সিং, ডে-কেয়ার, সেলস, হেয়ার ড্রেসার, ড্রাইভিং নানা কর্মক্ষেত্রে এখানে সুবিস্তৃত। এখানে নারীরা সদিচ্ছা থাকলেই খুব সহজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

 

সময়ের কথা : তোমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?

মারিয়া : আমার ব্যবসা নিয়ে আমি অনেক সুখী। এটাকেই আরো শীর্ষে নিয়ে যাওয়াই আমার লক্ষ্য।

 

সময়ের কথা : এ পর্যন্ত ব্যবসায়িক সাফল্যের কারণে তুমি সরকারী বা বেসরকারী কোনো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছো কি?

মারিয়া :  আমি যখনই কোনো মিটিংয়ে যাই, বলি, আমার বাসাটাই হচ্ছে একটা অ্যাওয়ার্ডের মিউজিয়াম। সাক্সেসের জন্য, অলওয়েজ ফ্রেস, স্পিড অব সার্ভিস, টপ সেলিং-এর জন্য আমি অনেক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। পেয়েছি চেয়ারম্যান অ্যাওয়ার্ড।

ব্যবসায়িক সাফল্যই বলুন আর অ্যাওয়ার্ডই বলুন, এ পর্যন্ত আমরা যা পেয়েছি তা আমার ও আমার স্বামীর কঠোর পরিশ্রমের ফসল। সাফল্যের জন্য পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।

 

-প্রকাশিত মারিয়া আর্সেনাল্টের সাক্ষাৎকারটি তার কিংবা সময়ের কথা’র অনুমতি ব্যতিরেকে পূর্ণ বা আংশিক অন্য কোনো প্রচার মাধ্যমে প্রচার কিংবা প্রকাশ করা যাবে না।-সম্পাদক

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.