স্বদেশের শস্যকণা ইদুঁরের গর্ভে বিলীন

স্বদেশের শস্যকণা ইদুঁরের গর্ভে বিলীন

Image may contain: 1 person

সৈয়দ জাহিদ হাসান: সমাজের সর্বত্রই আজ অবক্ষয় দৃশ্যমান। এত অন্ধকার, এত অনাচার বাংলাদেশের সবুজ জমিনে পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য, শিক্ষক, সকলেই আজ গা-ভাসিয়ে দিয়েছেন পঙ্কিলতার নোংরা স্রোতে। মস্তিষ্ক বিকৃত হলে বদাভ্যাসের প্রাবল্য স্বভাবে দেখা দিতেই পারে, তাই বলে বাঘ্র কি বিষ্ঠা ভক্ষণ করবে? মানুষ যত সভ্য হবে, সমাজ ততই সুন্দর থাকার কথা। এটাই প্রগতির পূর্বশর্ত। অথচ আজ আমরা প্রগতির বিরুদ্ধেই যেন যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছি। নিয়ম-কানুনের পরোয়া করছি না, মান-সম্মানের দিকে ফিরে তাকাচ্ছি না, মামুলি মুদ্রার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে সকলেই আজ মাথা কামিয়ে নিচ্ছি দুর্নীতির ক্ষুরে। এমন নির্লজ্জভাবে অর্থ উপাজনের কী মানে আছে? আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে আমলা থেকে কামলা পর্যন্ত সকলেই আজ হন্যে হয়ে ছুটছে কালো টাকার পেছনে। জ্ঞানকে বিসর্জন দিয়ে, বিবেককে বন্দি করে ব্যক্তিস্বার্থের কারাগারে, মানুষ আজ পশুত্বের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক দলের আদর্শহীন আচরণে দেশ এখন গভীর সঙ্কটে নিপতিত হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতা অবরুদ্ধ করে, উন্নয়নের বুলি আওড়িয়ে অবক্ষয়ের চ‚ড়ান্ত স্তরে নেমে যাওয়া এই জাতিকে এখন আর টেনে তোলা সহজ নয় বলেই মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশে খুন এখন নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিদিনই মস্তকবিহীন, হাত-পা ছিন্ন, অর্ধগলিত লাশ যেখানে-সেখানে পাওয়া যাচ্ছে। দিনেদুপুরে সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলায় শিশু সন্তানেরা সামনে নিহত হচ্ছেন অসহায় পিতা। চলন্ত বাসে ধর্ষকদের আদিম ক্ষুধার কাছে সতীত্ব হারাচ্ছে নম্র, নাজুক নারীযাত্রী। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে যে সুনাম অর্জন করেছিল, তা আজ ম্লান হতে চলেছে, সর্বক্ষেত্রে নারীর অনিরাপদ জীবনযাপনের জন্য। পুঁজিবাদী সমাজ নারীকে চিরকালই ভোগ্যপণ্য মনে করে। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও এর ভেতরের কাঠামো পুঁজিবাদী আত্মা দ্বারা আবৃত। রাষ্ট্রের অর্থ-সম্পদ লুট করে সন্ত্রাসীরা আজ শিল্পপতি সেজেছে, ভ‚মিদস্যুরা দখল করেছে আবাসন খাত, অবকাঠামো উন্নয়নের দালালেরা আজ দাপটের সঙ্গে লোপাট করছে বাজেট বরাদ্দ। যে যেখানে চেয়ার পেতে বসেছে, সেখান থেকেই সে টাকার খনি আবিষ্কার করছে। দুর্নীতিবাজ শোষক মানুষের স্বার্থের কাছে সাধারণ মানুষ এতটাই জিম্মি হয়ে পড়েছে যে, মুখ ফুটে টু শব্দ করার উপায় নেই। তবু এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, এগিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ যাবতীয় সেবাখাত! দেশের মানুষ কতটা বোকা হলে, অবক্ষয়কে উন্নয়ন বলে মেনে নেয়, বাংলাদেশে জন্ম না হলে এ কথা উপলব্ধি করা যাবে না।

নৈতিক উন্নয়ন ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশ উন্নতির শিখর স্পর্শ করতে পারেনি। উন্নত বিশ্ব বলতে যা বোঝায় তার মূলে রয়েছে নৈতিক শিক্ষার আশ্চর্য সাফল্য। নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে যখন আইনের শাসন যুক্ত হয় তখন সেই জাতি হয় সত্যিকারের উন্নত জাতি। বাংলাদেশে এখন এই দুটো জিনিসের তীব্র অভাব দৃশ্যমান। নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, ক্ষমতাবানরা যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছেন । কেউ দেখার নেই। আর যদি কেউ থাকেনও তবু তিনি দেখছেন না, দেখার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করছেন কিনা সন্দেহ।

রাজনীতি হলো একটি দেশের মূল চালিকা শক্তি। রাজনীতিতে যখন নীতিহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন দেশের সমস্ত শুভ সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে। বাংলাদেশে গত দুই দশকে রাজনীতিতে যত সুবিধাবাদী-নীতিবর্জিত নেতার আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করা শুধু কঠিন নয় অসম্ভবও। মাদক ব্যবসায়ী, লুণ্ঠনকারী, নারীলোভী, দুস্যপ্রবৃত্তির মানুষ যেন বেনো জলের মতো ঢুকে পড়েছে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে। সৎ রাজনৈতিক নেতার সংখ্যা অসৎ নেতাদের ভিড়ে ক্রমেই লোপ পাচ্ছে।

এভাবেই যদি অপ্রতিরোধ গতিতে সবকিছু চলতে থাকে, তাহলে এদেশ হবে পশুদের দেশ বলে খ্যাত এক আশ্চর্য । কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এত অনাচার ও দুর্নীতি দিবালোকে হতে পারে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আজ কারো মাথা ব্যথা নেই। সবাই যার যার ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত। বিদেশি শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো আমাদের লুট করার পাশাপাশি বাঙালিরাও বাংলাদেশের অর্থ-সম্পদ-মান-সম্মান লুট করে বিদেশে পাচার করছে বাংলাদেশ ত্যাগ করার বাসনা নিয়ে। এক অন্ধ, অদ্ভুত জাতি আমরা। পরিশ্রম না করে বড় লোক হওয়ার তীব্র লোভে সবাই আজ দিকভ্রান্ত। মেরুদÐহীন কেঁচোর মতো আমরা সবাই পেট ভরে বিষ্ঠা সঞ্চয়ে ব্যস্ত। সরকারও কী মেরুদÐহীন, মলে মজ্জমান?

নভেল করোনা ভাইরাসের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অনেক আগেই নিঃস্ব হয়ে গেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে দেশের লাখ লাখ মানুষ। শিক্ষিত বেকার যুবক যারাÑ তারা টিউশন করে যাও দুই পয়সা উপার্জন করতো, অনেক আগে সেপথও বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ করার মতো অসংখ্য হাত আজ বেকার পড়ে আছে, অথচ তাদের হাতে কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। নিরন্ন মানুষ ক্ষুধায় হয়তো মরছে না, কিন্তু যেভাবে বেঁচে আছে সেটা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।

চাষীর সোনালি ধান যেমন করে লোভী ইদুঁরের দল মাটির গর্তে পাচার করে দেয়, সেভাবেই দেশি-বিদেশি ইদুঁরেরা বাংলার সম্পদ পাতাল পুরীতে চালান করে দিচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে চাইলে এখন ইদুঁর হত্যার মিশনে নামতে হবে। স্বদেশের শস্যকণা ইদুঁরের পেটে পুরোপুরি বিলীন হওয়ার আগেই ইঁদুর বধ জরুরি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.