হতাশার হাত ধরে বসে আছে আশা

হতাশার হাত ধরে বসে আছে আশা

সৈয়দ জাহিদ হাসান: গরিবের ভাগ্য সহজে বদল হয় না। মোমবাতির শিখা উন্মুক্ত প্রান্তরে কখনোই একভাবে জ্বলতে পারে না। বসন্তের স্নিগ্ধ বাতাস বলি, আর ঝড়ো হাওয়ার কথাই বলি, যেকোনো অবস্থায়ই তার নিভে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যাদের মাথার উপর ছাদ নেই, পেটে ভাত নেই, চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই, মৃত্যু তাদের যত কাছাকাছি থাকে জীবন ততটাই দূরে সরে যায়। গরিব মূলত জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে, আর মৃত্যুর সাথে করে সন্ধি। এই সন্ধি ও সংগ্রামের দ্বিমুখী দ্বন্দ্বে নিরন্ন মানুষের আর কিছু করা হয় না। ক্রমে ক্রমে তারা পৃথিবীর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের আবাসস্থল হয় রোগজীবাণুর স্থায়ী খামার, দেহগুলো হয় অপুষ্টির নির্মম শিকার।

লক্কর-ঝক্কর ঠেলা গাড়ির মতো ষোলো কোটি মানুষ ঠেলতে ঠেলতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে করে না ভাইরাসের সর্বব্যাপী আক্রমণে ধীর গতিতে চলতে থাকা বাংলাদেশ অগ্রপদ ভাঙা ঘোড়ার মতো মুখ থুবড়ে পড়ে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও অর্থনীতির গতি। করোনা মহামারীতে পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো সময় পার করেছেন রাজনীতিবিদগণ। তাদের ভাষণ, বক্তৃতা, ভার্চুয়াল আড্ডা সবই ঠিকঠাক মতো হয়েছে। শুধু হয়নি মৃত্যু ও দারিদ্যের সমাধান। করোনা মহামারী খেটে খাওয়া অসহায় মানুষগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল, গরিবকে মারার জন্য ভাইরাস বলি আর ভাইস রয় বলি, সকলেই প্রস্তুত, কিন্তু তাদের বাঁচানোর জন্য কারোরই কোনো আন্তরিকতা নেই, নির্ভুল কর্মতৎপরতা নেই।

সাংবাদিক বন্ধুরা বর্তমান সময়কে ‘ফেক নিউজের যুগ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পত্র-পত্রিকায় আজ যেসব কথা সমারোহে প্রচার করা হচ্ছে, সেসব কথায় বিশ্বাস করে যারা আশায় বুক বাঁধে, তাদের মতো বোকা আর কেউ নেই। সাংবাদিকদের মুখে এমন কথা শোনার পর আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি, কতিপয় শয়তান ছাড়া, প্রত্যেকেই আমরা গোলক ধাঁধায় আছি। গোলক ধাঁধার আঁধার গুহা থেকে কবে মানুষ মুক্তি পাবে, তা আমরা কেউ জানি না। এখন আমাদের একটাই কাজ, তাহলো ‘ওয়েটিং ফর গোডো’, কাঙ্খিত গোডো এসে আমাদের জন্য কী বাণী শোনাবেন, তা আমরা কেউ জানি না, তবু আজ সেই অসম্ভবের জন্যই আমাদের প্রতীক্ষা করতে হবে। মানুষের হাতে যখন উপায় থাকে না, বুদ্ধি যখন কোনো কাজ করে না, সহযোদ্ধারা ভুলে যায় সতীর্থের আন্তরিক বন্ধন, তখন প্রতীক্ষাই হয়ে ওঠে একমাত্র সান্ত¦না। আজ আমাদের উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।

খুব ঢাকঢোল পিটিয়েই কিছুদিন আগে আমরা গরিব দেশের পোশাক বদলিয়ে উন্নয়নশীল দেশের পোশাক পরেছিলাম। ইচ্ছে ছিল উন্নয়নশীল দেশ থেকে দ্রুতই আমরা যাত্রা করব মধ্যম আয়ের দেশে। এতসব ভালো খবর শুনে দুঃস্বপ্নের ধুলোবালি ঝেড়ে যখন একটু হাসিখুশি ভাব নিয়ে আড়মোড়া ভাঙছিলাম, তখনই চারপাশের বৈরি পরিবেশ থেকে ছুটে এলো এক ভয়ঙ্কর দুসংবাদ। এই দুসংবাদে অনেকের মতো আমিও নিরাশ হয়েছি, বেদনায় ভেঙে পড়েছি।

কোনো পরিসংখ্যানের দিকে না তাকিয়ে এদেশের মানুষের জীবনমানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষই দরিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন আরো ৩ কোটি ২৪ লক্ষ গরিব মানুষ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার চার ভাগের তিনভাগই হতদরিদ্র। এই হতদরিদ্র মানুষের দেশ কিভাবে উন্নয়নশীল দেশ বলে স্বীকৃত হয়? সীমাহীন দুর্নীততে যে দেশ ডুবে যাচ্ছে, অভিনব সন্ত্রাসে যেদেশ প্রতিদিন ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে, অপরাজনীতির শিকার হয়ে যেদেশ লুট হয়ে যাচ্ছে, সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কে না শঙ্কায় ভুগছে? একের পর দুর্যোগ এসে ঘিরে ধরছে আমাদের। অতল সমুদ্রে অক্টোপাস যেমন করে পেঁচিয়ে ধরে সুস্বাদু শিকার, অপরাজনীতির রাক্ষসও তেমনিভাবে আমাদের গিলে খাচ্ছে। পুঁজিপতিদের পকেট ভরতে গিয়ে পতিত মানুষের পেট ভরাতে ব্যর্থ হচ্ছেন রাজা ও রাজনীতি।

মুনাফালোভীরা আমলা-মন্ত্রীদের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে যোগসাজস করে গরিব মারার পাঁয়তারা করছে নির্লজ্জভাবে। অনেক আগেই রাজপথ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিল। বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্র অনেক আগেই ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের। বিপ্লবীরাও ক্লান্ত হয়ে, কেউবা আত্মবিক্রয় করে ঘুমিয়ে পড়েছে সুখনিদ্রায়। তবু দেখছি হতাশার হাত ধরে বসে আছে আশা। সবকিছুর মৃত্যু হলেও ‘আশা’ বেঁচে আছে। আপাতত ‘আশা’ই আমাদের ভরসা। বুকের ভেতর আশা থাকলে মরতে মরতে একদিন আমরাও বেঁচে উঠব আবার।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.