উন্নয়ন মুছে যাচ্ছে দুর্নীতির কালিতে

উন্নয়ন মুছে যাচ্ছে দুর্নীতির কালিতে

Source: Internet

সৈয়দ জাহিদ হাসান: অনুন্নত জনজীবনের সামনে উন্নয়নের তাবিজ ধরলে তাতে খুব কাজ হয়, বুদ্ধিমান রাষ্ট্র শাসকেরা এ কথা জানে বলেই ‘উন্নয়ন’ শব্দটি কখনো কখনো জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তারা নারারকম ফন্দি-ফিকির আঁটে। এই ফন্দি-ফিকির বাস্তবায়ন করার জন্য প্রথমে এরা ক্রয়যোগ্য বুদ্ধিজীবী খরিদ করেন, এরপর ভাড়া করেন পেটোয়া বাহিনী, এ দুটো কাজ করার পরে অনুগত প্রচার কর্মী নিয়োগ দেন, উন্নয়নের মাহাত্ম-চিত্র প্রচার করার জন্য। এভাবেই উন্নয়ন চলতে থাকে। উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে থাকে দেশ ও দেশের মানুষ। ‘ভাসমান’ শব্দটির অর্থ মোটেই ইতিবাচক নয়। ‘ভাসমান মানুষ’ বলতে আমরা বুঝি বাস্তুভিটা থেকে ‘উচ্ছেদ হওয়া মানুষ’। এরা নিরন্ন, অসহায়, আশ্রয়হীন। ‘উন্নয়নের জোয়ারে ভাসমান’ মানুষের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গেলে হাতের সংখ্যাগত তথ্য-উপাত্ত থাকার দরকার। এই মুহূর্তে আমার কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই। সুতরাং উন্নয়নের তাত্ত্বিক আলোচনা না করে দৃশ্যমান কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করাই সঙ্গত হবে বলে মনে করি।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে উন্নয়নের যে চিত্র দেখছি এক অর্থে তা উন্নয়নই। দেশ জুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার, পদ্মা সেতুর মতো স্বপ্নের সেতু নির্মাণ, তথ্য-প্রযুক্তি খাতে চোখ ধাঁধানো সাফল্য, প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রাখা যদি উন্নয়নের মাপকাঠি হয়, তাহলে বলতেই হয় বাংলাদেশে অবশ্যই উন্নয়ন হচ্ছে। বাংলাদেশে উন্নয়নের জোয়ার না এলেও তিরতির করে যে উন্নয়ন হচ্ছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু উন্নয়নের পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ও লক্ষ্য করার মতো। সেটি হলো ‘দুর্নীতি’। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। দুর্নীতি বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে বাংলাদেশকে বিকল করার পাঁয়তারা করছে। বাংলাদেশ অতীতে কখনোই দুর্নীতি মুক্ত ছিল না, বরং দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। এখন বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয় না বটে, তবে লাগামহীন দুর্নীনিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে দেশের সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশে এমন কোনো অফিস-আদালত-প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে গেলে দুর্নীতির পায়ে সালামি দিতে হবে, মৃত মানুষ কবরস্থ করতে গেলেও দুর্নীতির কাছে মাথা নত করতে হয়। শিশুর জন্মের সময় কেউ একটু সতর্ক দৃষ্টি না রাখলে বা অমনোযোগী হলে হাসপাতাল থেকে শিশুটি বদল হয়ে যায়, নয়তো চিরতরে হারিয়ে যায় অতি আকাক্সক্ষার ও অতি আদরের নাড়িছেঁড়া ধন।

বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তা হলো মানুষের জীবন। এখানে সকলেই সকলের জীবন নিয়ে খেলতে পারে, তবে জীবন সংহারের খেলায় এখানে সবচেয়ে এগিয়ে আছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশে যারা আইনশৃঙ্খলা করার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের মতো আর কেউ আইন ভঙ্গ করে বলে কারো তা জানা নেই। পত্র-পত্রিকায় যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে একজন পুলিশ ঘুম থেকে উঠে এবং ঘুমোতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যা করে তার প্রায় সবটুকুই দুর্নীতি (দুই একজন যে এর ব্যতিক্রম নেই তা নয়, তবে তাদের থাকা না থাকায় প্রশাসনের কোনোই লাভ ক্ষতি হচ্ছে না)। বাংলাদেশের পুলিশ শুধু ঘুষ-দুর্নীতির মধ্যেই আজ আর সীমাবদ্ধ নেই, হত্যার খেলায়ও আজ তারা মেতে উঠেছে। যখন যাকে মারতে ইচ্ছে করছে, ঠাস ঠাস করে রিভলভার বা বন্দুকের গুলি চালিয়ে তাকে খতম করে দিচ্ছে। কখনো বা ভাড়াটে গু-া-বদমাস দিয়েই হত্যা করছে নিরপরাধ-নিষ্পাপ মানুষ। দেখে শুনে মনে হচ্ছে এদেশ এখন পুলিশেরই দেশ। দৃশ্যত দেশ রাজনীতিবিদরা চালালেও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা মূলত আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। অতিমাত্রায় প্রশাসন নির্ভর হওয়ায় বর্তমান সরকার সার্বিক শৃঙ্খলারক্ষা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, একটি দেশের প্রশাসন তখনই চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয় যখন তারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর প্রায় সকল রাজনীতিবিদই কমবেশি দুর্নীনিতে আসক্ত। সীমাহীন অর্থলোভ ও ক্ষমতালোভ তাদেরকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলছে। এ ছাড়া প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা তো আছেই। আজ পত্রিকার পাতা খুললেই এমপি-পুত্রদের কুকীর্তির কথা চোখের সামনে ভেসে ওঠছে। খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অপহরণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে এমপি, এমপি-পুত্র ও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে। এ অবস্থায় দেশের মানুষ কতটা ভালো আছে বা আদৌ ভালো আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার কেউ নেই। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই জনমনে গুঞ্জন চলছে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বিজয়ের বন্দরে সহজেই পৌঁছাতে পারবে না। তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। আমি ভেবে পাই না, এত উন্নয়ন করেও, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেও, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় বাংলাদেশকে অভিষিক্ত করেও কেন আগামী নির্বাচনে জয় পেতে এত কষ্ট হবে আওয়ামী লীগকে?  কেউ কেউ বলছেন, কষ্ট হবে এই কারণে যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার যা কিছু উন্নয়ন করছেন তা মুছে ফেলছেন দুর্নীতির কালিতে। ময়মনসিংহের উন্নয়ন ফরিদপুরবাসীর খুব একটা কাজে না লাগলেও ময়মনসিংহের প্রশাসনিক দুর্নীতি আর ফরিদপুরের প্রশাসনিক দুর্নীতি মূলত একই ধরনের। অর্থাৎ উন্নয়নের সুফল গুটি কয়েক মানুষ ভোগ করলেও প্রশাসনিক পীড়ন সব মানুষকেই সমানভাবে সহ্য করতে হচ্ছে। এই বিষয়টা দারুণভাবে বিষিয়ে তুলছে সাধারণ মানুষকে। বর্তমান সময়ে নয় টাকার উন্নয়ন করে একানব্বই টাকা দুর্নীতি করছে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এ কথা সত্যি হলে সরকারের উচিত হবে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রদান করা। আর যদি মিথ্যা হয়, তাহলে গুজব ছড়ানো সেই মিথ্যাবাদীদেরও শাস্তির আওতায় এনে বিচার করা সরকারের দায়িত্ব।

বর্তমান সরকার আমাদের স্যাটেলাইট উপহার দিয়েছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উপহার দিতে চলেছেন, এ জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই এই কারণেও যে-মৌলবাদীদের উত্থান এই সরকারই প্রতিহত করেছেন শক্ত হাতে। কিন্তু এত কিছুর পরেও বলতে হয়, এই সরকারের আমলে মাতৃজঠরেও সন্তান নিরাপদে নেই, সেখানে তাকে গুলি খেতে হচ্ছে। ব্যাংকের ভল্টে টাকা-পয়সা-সোনা-নিরাপদ নেই, মাটির নিচে খনির পাথর কিংবা খনির কয়লা, তাও দুর্বার দুর্নীতির কারণে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সরকার একটি জায়গায় কোনো রকম সাফল্য দেখাতে শুরু করলেই আরেক জায়গা থেকে বেরিয়ে আসছে বিরাট ও ব্যাপক দুর্নীতির খবর। এই দুর্নীতির খবরে বিষিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের মন। মানুষের মন ভালো কাজ করে বশ করা কঠিন হলেও, খারাপ কাজের কথা শুনলে খুব সহজেই বেঁকে বশে। বর্তমান সরকারের একটি মনে রাখা দরকার, দুর্নীতির হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই বিএনপিকে বর্জন করে এদেশের সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগকে গ্রহণ করেছিল। আওয়ামী লীগের এমন কিছু করা কখনোই ঠিক হবে না, যাতে আওয়ামী লীগকে বিসর্জন দিয়ে আবার দুর্নীতিপ্রবণ বিএনপিকে বেছে নিতে হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণায় খুব একটা পার্থক্য নেই। কেউ কেউ বলেন, দুই দলই একই মুদ্রার এপিট-ওপিঠ। আওয়ামী লীগের উচিত হবে জনতার এই ভুল ভেঙে দেওয়া এবং তাদের মানসিকতায় পজেটিভ চিন্তা প্রতিষ্ঠা করা।

আওয়ামী লীগ আর বিএনপি মোটেই এক নয়, এদের মধ্যে পার্থক্য রাত আর দিন, এই কথাটা জনগণকে বুঝাতে হলে দুর্নীতিকে সমূলে বিনাশ করতে হবে আওয়ামী লীগ সরকারকে। উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। উন্নয়নের চেয়েও বড় দরকার দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। দুর্নীতি কমে গেলে এমনিতেই উন্নয়ন হবে, সুখে-শান্তিতে থাকবে সাধারণ মানুষ। কিন্তু উন-উন্নয়ন ও দুনো-দুর্নীতি একই সঙ্গে চলতে থাকলে ফল হবে শূন্য। সরকারের কোনো কোনো আমলা, মন্ত্রী, এমপি দুর্নীতির পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেন এবং দুর্নীতিবাজদের আড়াল করার হাস্যকর নাটক দেখান। এগুলো শুধু পরিত্যাজ্যই নয়, দ-নীয়ও বটে। সরকারের উচিত হবে এসব বিষয়ে কঠিন ও কঠোর হওয়া। শুধু জঙ্গি আর মাদকের বিরুদ্ধেই জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করলে হবে না, দুর্নীতির ক্ষেত্রেও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে দেশ পরিচালনা করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলেই বিপদ অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণের মন জুগিয়ে চলুন। নিজের মনমতো জনগণকে চালাতে গিয়ে অনর্থক সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকুন। চারদিকে গণেশ উল্টানোর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই গণেশকে জায়গা মতো বসিয়ে রাখুন, একবার গণেশ উল্টালে কে জানে হয়তো চিরতরেই উল্টে যেতে পারে।

লেখক : কবি ও কথাশিল্পী

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.