ঊষা গাঙ্গুলীর স্মরণে শোকগাথা

ঊষা গাঙ্গুলীর স্মরণে শোকগাথা

মোনায়েম সরকার: ঊষা গাঙ্গুলীকে আমি ঊষা বৌদি বলে ডাকতাম। ঊষা গাঙ্গুলীর স্বামী কমল গাঙ্গুলীকে চিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে। কমলদাকে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসতাম, সেই সুবাদেই ঊষা গাঙ্গুলীকে ‘বৌদি’ বলে ডেকেছি। ঊষা বৌদির সঙ্গে শেষ দেখা হয় ২০১৯ সালের শেষের দিকে। সে সময় নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের একটা নাটকে নির্দেশনা দিতে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। উঠেছিলেন বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের ও সারা যাকেরের বাসায়। আলী যাকেরের বাসা থেকেই ঊষা বৌদিকে আমি চামেলীবাগে নিয়ে আসি। আমাদের ২৩ চামেলীবাগের বাসায় শেষবারের মতো এসে ঊষা বৌদি যতটুকু সময় ছিলেন সেই সময়টুকু আমার চিরদিন স্মরণে থাকবে। রাতে খাবারের আগে তিনি যখন রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীরপত্র’ আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলেন- তখন আমাদের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের রহিমা চৌধুরানী সম্মেলন কক্ষে পিনপতন নীরবতা ছিল। ঊষা বৌদির গলার স্বর এতটাই মোহনীয় ছিল যে- একবার যে তার কণ্ঠ শুনতো সেই মুগ্ধ হতো। একজন খ্যাতিমান নাট্যকর্মী ও নাট্য পরিচালক ছিলেন ঊষা বৌদি। ভারতের বিশাল ভূখণ্ড পেরিয়েও তার নাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মূল কারণ ছিল- নাটককে তিনি জীবনের মতোই ভালোবাসতেন এবং এই নাটক নিয়েই তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ঊষা বৌদি সদালাপী, পরোপকারী, নির্লোভ মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তিনি খুব অন্তরঙ্গ হয়ে মেলামেশা করতেন। অনেক বড় নাট্য-ব্যক্তিত্ব হয়েও তিনি কোনো অহংকার দেখাতেন না। অহংকারবোধ তার ছিল না বললেই চলে। তার ব্যক্তিত্ব, তার দীর্ঘ-সুন্দর মোহনীয় তনুশ্রী দেখলে সবারই শ্রদ্ধা জাগত।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি কলকাতা যাই এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা হয়ে কলকাতা যেতে আমার সময় লাগে তিন দিন তিন রাত। সেদিন আমার সঙ্গে আরো যারা ছিলেন তাদের মধ্যে ওয়াহিদুল হক, লায়লা হাসান (সঙ্গীতা ইমাম তখন কোলের শিশু), হাসান আলী, সরদার দবির, আবুল মনসুর, সনজীদা খাতুন, অধ্যাপক কাশীনাথ রায় প্রমুখের কথা মনে পড়ে। কলকাতা গিয়ে আমরা প্রথম আতিথেয়তা গ্রহণ করি সৈয়দ হাসান ইমামের মামা বাড়িতে। উল্লেখ্য, শিয়ালদহ রেলস্টেশন থেকে হাসান ইমাম ভাই আমাদের সবাইকে তার মামা বাড়িতে নিয়ে যান। তার মামা তখন স্পিকার ছিলেন, সেই সময় হাসান ইমাম ভাইয়ের মামা বাড়ির লোকজন আমাদের ভীষণ উপকার করেন। যা আমরা কোনোদিনই ভুলব না। হাসান ইমাম ভাইয়ের মামা বাড়ি থেকে ওয়ালিউল ইসলাম ও কামাল সিদ্দিকী (প্রাক্তন সিএসপি) জিপে করে আমাকে নিয়ে যান বিদ্রোহী নেত্রী ইলা মিত্রের বাসায়। 

ইলা মিত্রের স্বামী রমেন মিত্র আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। রমেন দা-ই আমাকে ও আরো দুজন কমরেডসহ কমল গাঙ্গুলীর বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেন। কমল গাঙ্গুলী কালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন। ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা ও কফি হাউসের প্রেসিডেন্ট। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর তাড়া খেয়ে আমি যখন কমলদার বাসায় উঠি ঊষা বৌদি তখন সন্তানসম্ভাবা। শরীর তার খুব একটা ভালো ছিল না। সেই অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন এবং আমাদের আদর যত্নের যেন কোনো ত্রুটি না হয় সেই বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। সে সময় আমরা কেউ তার ঘনিষ্ঠ ছিলাম না, আমাদের জন্য অসুস্থ শরীর নিয়ে অতকিছু তিনি না করলেও পারতেন, তবু করেছেন। তিনি আসলেই কত বড় মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন সেদিনের সেই দুঃসময়েই আমি তা টের পেয়েছিলাম। ঊষা বৌদিকে কোনোদিন কোনো কারণে মলিন মুখে দেখিনি। চিরদিনই তাকে হাসিখুশি প্রসন্ন দেখেছি। তার ভাসুর অমল গাঙ্গুলীর সঙ্গেও আমার সুসম্পর্ক ছিল। অমল দা-ই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতবর্ষের দুই কিংবদন্তি গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও ভূপেন হাজারিকার কাছে। ঊষা বৌদিদের বাসায় আমি কলকাতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষের আসা-যাওয়া দেখেছি। যেমন দেখেছি ইলা মিত্র-রমেন মিত্রের বাসায়।

ঊষা বৌদি আমার সমবয়সী ছিলেন, শুধু সমবয়সী বলব কেন সমমনেরও মানুষ ছিলেন। সমসময়ী হয়েও আমি তাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম, আপন বোনের মতো ভালোবাসতাম। শুধু আমি নই আমার মতো আরো অনেকেই তাকে শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। একজন স্বাধীনচেতা মানুষের যেসকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে, ঊষা গাঙ্গুলী বৌদির মধ্যে তার প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্যই ছিল। তার সহকর্মী যারা ছিলেন- তাদের সঙ্গে ঊষা বৌদির আত্মার সম্পর্ক ছিল। এমন কাজ পাগল মানুষ আমি কমই দেখেছি। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি নাটকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমাধ্যম নিয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করা আসলেই কঠিন ব্যাপার। 

ঊষা বৌদি ১৯৪৫ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার উত্তর প্রদেশের নার্ভা গ্রামে বসবাস করত, তিনি ভরতনাট্যম নৃত্য শিক্ষা সম্পূর্ণ করে কলকাতা শহরে আসেন। এই কলকাতা শহরেই তিনি স্ত্রী শিক্ষায়তন কলেজে পড়াশোনা করেন। স্নাতকোত্তর স্তরে তিনি হিন্দি সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। একদিন কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন কাদের কাছে তিনি নাটকের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তার প্রশিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন রুদ্র প্রসাদ সেন গুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী, তৃপ্তি মিত্র এবং মৃণাল সেন। এরা প্রত্যেকেই ভারতবর্ষের কৃতিব্যক্তিত্ব। এদের সংস্পর্শে এসে ঊষা বৌদি নিজেকে বিকশিত করার অনুপ্রেরণা পান।

আমার সঙ্গে যখন ঊষা বৌদির পরিচয় হয় তখন তিনি কলকাতার ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। তার স্বামী কমল গাঙ্গুলীও একজন অধ্যাপক ছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে ১৯৭০ সালে তিনি কলা মন্দিরের সঙ্গে প্রথম অভিনয় জীবন শুরু করেন। তার অভিনীত প্রথম নাটক ‘মিট্টি কি গাড়ি’। এই নাটকে তিনি বসন্তসেনার ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকের বিপুল ভালোবাসা লাভ করেছিলেন।

ঊষা গাঙ্গুলী নিবেদিতপ্রাণ নাট্যকর্মী ছিলেন। নাটককে কিভাবে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়া যায় এবং কিভাবে নাটকের মাধ্যমে মানুষের জীবনধারা বদলে দেওয়া যায় সবসময় তিনি এসব কথাই ভাবতেন। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ‘রঙ্গকর্মী’ নামে একটি থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। এই থিয়েটার  গ্রুপ প্রতিষ্ঠার চার মাস পরে ঘটনাক্রমে ঊষা বৌদির সঙ্গে আবার দীর্ঘদিন কাছাকাছি থাকার সুযোগ পাই।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাত্রে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে সমস্ত বাঙালির মতো আমিও বজ্রাহত হই। সে সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই অবনতির দিকে যায়। কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যেত না। সামরিক সরকারের মদদে বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলতে বঙ্গবন্ধুবিরোধী চক্র প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দকে জেল-জুলুম-নির্যাতন করতে থাকে। তখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়Ñ হয় স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের দলে ভিড়ে তোষামোদী করো নয় তো রাজনীতি ছাড়ো বা জেলে পচে মরো। আমি এসবের কোনোটি মেনে না নিয়ে ভারতে স্বেচ্ছা-নির্বাসন বেছে নিই। ১৯৭৫ সালে আমি ভারতে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে গেলে আবার ঊষা গাঙ্গুলী বৌদির সঙ্গে যোগাযোগ সূত্র স্থাপিত হয়। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আমি ভারতে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে কাটাই। এই চার বছরে আমি গাঙ্গুলী পরিবারের কতটা কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলাম তা বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। সব কথা বলে বোঝানো যায় না, কিছু কিছু কথা থাকে যা কেবল অনুভবের মধ্যে, উপলব্ধির মধ্যেই পরিপূর্ণতা পায়।

ঊষা গাঙ্গুলী বৌদির জীবন কর্মময় ছিল। তিনি তার যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে হিন্দি থিয়েটারে একটা নবপ্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার বিখ্যাত নাটক্যকর্মগুলোর মধ্যে মহাভোজ (১৯৮৪), লোককথা (১৯৮৭), হোলি (১৯৮৯), রুদালি (১৯৯২), হিম্মত মাঈ, অন্তর্যাত্রা, কোট মার্শাল অন্যতম। ‘রুদালি’ নাটকটি মূলত নাটক নয়, বিখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর একটি গল্প-নাট্যরূপ দিয়ে তিনি এই রুদালি নাটকটি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি নাট্যকার ছিলেন না। অভিনয় ও নাট্য পরিচালনা করাই তার নেশা ছিল। তবে ‘খোঁজ’ নামে একটি সম্পূর্ণ নাটক লিখেছিলেন বলে হদিশ পাওয়া যায়।

সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কারসহ জীবনে বহু পুরষ্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলে ঊষা গাঙ্গুলী বৌদি। পুরস্কার পেয়ে তাকে কখনো অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখিনি। তিনি বলতেন- ‘আমার কোনো লাইফ নেই থিয়েটার ছাড়া’। আসলেই তাই, যতদিন তাকে দেখেছি ততদিন নাটক নিয়েই চিন্তাভাবনা করতে দেখেছি। নাটকের বাইরে আর কোনো চিন্তাই তাকে আকর্ষণ করতো বলে মনে হয় না।

নভেলা করোনা ভাইরাসের সর্বগ্রাসী আক্রমণে সমগ্র বিশ্ব যখন থমকে গেছে ঠিক সে সময়ে ঊষা গাঙ্গুলীর মহাপ্রস্থান আমাদের জন্য বিরাট শোকের কারণ। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হারাল একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে, রঙ্গকর্মী হারাল তার মহান স্রষ্টাকে আর আমি হারালাম দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের আশ্রয়কে। তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে এপ্রিল মাসে, আবার এই মাসেই বিদায় নিলেন তিনি। যতদিন বেঁচে থাকব এপ্রিল মাসের এই বেদনা ভুলতে পারব না। মহীয়সী এই নাট্যব্যক্তিত্বকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.