একুশে গ্রন্থমেলা : শীতে শুরু বসন্তে শেষ

একুশে গ্রন্থমেলা : শীতে শুরু বসন্তে শেষ

সৈয়দ জাহিদ হাসান: খ্রিস্টীয় নতুন বছরের প্রথম মাস যাই যাই করছে। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই ফেব্রুয়ারি মাস এসে হাজির হবে ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় পাতায়। ফেব্রুয়ারি মাস পৃথিবীর একেক প্রান্তে একেক রূপে উপস্থিত হয়। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিনে হয় ভালোবাসার উৎসব (বিশ্ব ভালোবাসা দিবস)। তৃতীয় সপ্তাহের অন্তিম দিনে বেদনার রঙ নিয়ে দেখা দেয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার একদল হার না-মানা তরুণ রাজপথে জীবন উৎসর্গ করেছিল মাতৃভাষা বাংলার জন্য। তখন তারা বাংলা ভাষাকে শুধু রাষ্ট্র ভাষার সম্মানেই ভূষিত করতে চেয়েছিল। অথচ কি আশ্চর্য, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সেই লড়াই পূর্ণতা পেয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’র স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। জাতি হিসেবে এটা যে আমাদের জন্য কত বড় গৌরবের তা আমরা কখনো ভেবে দেখি না। যদি দেখতাম তাহলে বাংলা ভাষা আজ বাংলাদেশের সর্বত্রই ব্যবহার হতে দেখতাম। আমরা সকল বাঙালিই আপ্রাণ চেষ্টা করতাম বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি করতে। যেহেতু আমাদের মধ্যে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের তৎপরতা অনুপস্থিত তাই বলতে কোনো দ্বিধা নেই বাংলা ভাষা এখন পর্যন্ত শুধু আমাদের মৌখিক স্বীকৃতিই পেয়েছে আন্তরিক অনুমোদন লাভ করেনি।

ফেব্রুয়ারি, মার্চ, আগস্ট ও ডিসেম্বর, এই চারটি মাস বাঙালি তথা বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। এই চারটি মাসে বাঙালি জাতি অনন্য আবেগে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এই চারটি মাস প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, শোক ও বিজয়ের রঙে রঙিন।

পূর্বোক্ত চারটি মাসের মধ্যে ফেব্রুয়ারি বিশেষ কারণে দীর্ঘস্থায়ী আবেগ ধারণ করে। অন্যান্য মাসগুলো কেবল একটি বা দুটি দিনের জন্যই স্মর্তব্য, কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসটি একটি বা দুটি দিনের জন্যই আমাদের মাঝে উত্তেজনা জাগায় না, পুরো মাসটিই ব্যাকুলতা সৃষ্টি করে। কেন এই বর্ণিল ব্যাকুলতা? ব্যাকুলতা এই কারণে যে, এই মাসে ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কিছু অংশে) একুশে গ্রন্থমেলা জমে ওঠে। লেখক, পাঠক, প্রকাশকের মহামিলন ঘটে যে উৎসবের মধ্য দিয়ে তার নামই একুশে গ্রন্থমেলা। একুশে গ্রন্থমেলা এলে আবার-বৃদ্ধ-বণিতার মধ্যে গ্রন্থপ্রীতি জেগে ওঠে, কেউ কেউ লেখক হয়ে ওঠারও চেষ্টা করেন।

লেখক হয়ে ওঠার এই প্রচেষ্টাকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখি। কেননা ভাষা নিয়ে খেলা করতে গেলে, ভাষাকে জানতে হয়, বুঝতে হয়, ভাষার শেকড় সন্ধান করে তার রহস্য উন্মোচন করতে হয়। ভাষা নিয়ে খেলা করার প্রবণতাকে আমি পবিত্রতম আরাধনা বলেই মানি। আমাদের দেশে যতবেশি লেখক তৈরি হবে, তত বেশি পাঠকের সংখ্যা বাড়বে। কারণ একজন লেখক একজন ভালো পাঠকও। লেখক বাড়লে প্রকাশনা শিল্পও দেশের অর্থনীতিতে রাখবে আশানুরূপ অবদান। ২০১৭ সালের বইমেলায় ৬০ কোটি টাকার উপরে বই বিক্রি হয়েছিল। এবার হয়তো ১০০ কোটি টাকার বই বিক্রি হবে। বাংলাদেশের মতো বইবিমুখ মানুষের দেশে এক মাসে ১০০ কোটি টাকার বই বিক্রিকে আমি মস্ত বড় খবর বলেই মনে করি। শুধু টাকার হিসেবেই নয়, আমি অনেক মানুষকেই দেখেছি বইমেলা এলে বুক সেল্ফ কেনেন। নতুন বই সাজিয়ে রাখার জন্য নতুন বুক সেল্ফ ঘরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। আধুনিক সৌন্দর্য-সচেতন মানুষ বুঝতে পেরেছে ঘরের কোনো আসবাবই বইয়ের চেয়ে সুন্দর নয়। একটি ঘরে ঢুকলেই যখন কিছু বই চোখে পড়ে, তখন বুঝা যায়,  সেই ঘরের মানুষগুলো রুচিশীল, শিষ্ট, সংস্কৃতিমান। সুতরাং গৃহসজ্জার উপকরণ হিসেবেও বই এখন দারুণ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বাংলাদেশে। তবে এই জনপ্রিয়তার মূল কারণ হিসেবে সমস্ত প্রশংসাই আমি বইমেলাকে দিতে চাই।

আশির দশকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যখন বইমেলা শুরু হয়, তখন স্বৈরাচার সরকার এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। স্বৈরাচারের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য সেদিনের বইমেলা ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চার করেছিল। এই সাহসই পরে স্বৈরাচার পতনে উদ্বুদ্ধ করে। আজ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর হচ্ছে। এই বিশালত্ব এটাই প্রমাণ করছে, আমরা আগামী দিনে বড় কিছু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা তৈরি হচ্ছি, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য। বইকে সঙ্গী না করলে আমরা কিছুতেই পৃথিবী শাসনের ভার নিতে পারবো না। হয়তো আমরা এই কথাটা আজ কমবেশি বুঝতে শিখেছি। তাই বইমেলা এলে আমাদের প্রাণ জেগে ওঠে, আনন্দ চারদিকে রঙ ছড়িয়ে দেয়। ‘হতাশা’ বিদায় নিয়ে ‘আশা’র জন্য পথ ছেড়ে দেয়।

প্রকৃতিতে ‘শীত’ শূন্যতার, জীর্ণতার প্রতীক। যৌবনের প্রতীক, নতুন প্রাণের প্রতীক ‘বসন্ত’। একুশের গ্রন্থমেলা শীতের শূন্যতার মধ্য দিয়েই শুরু হয়। শেষ হয় বসন্তে। আমার কাছে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় একুশে গ্রন্থমেলার শুরু ও শেষ মুহূর্তটা। বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক অর্জনগুলোর সঙ্গে একুশে গ্রন্থমেলার দারুণ একটি মিল খুঁজে পাই আমি। আমরা অতীতের সব আন্দোলনই বৈরী সময়ে, শূন্য হাতে শুরু করেছি। কিন্তু আমরা প্রাণে প্রাণ যোগ করে সেই সময়কে রূপান্তরিত করেছি বর্ণিল বসন্তে। আমরা শীত নয় বসন্ত চাই। কুয়াশায় জড়ানো কোঁকড়ানো জীবন নয়, রোদ ঝলমল যৌবন যাই, সুতীব্র সাহস চাই। বেদনার নকশিকাঁথায় আর আমরা অবগুণ্ঠিত থাকতে চাই না, এবার আমরা প্রোজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হতে চাই। আমাদের প্রকাশ হোক নতুন সূর্যের নতুন কিরণের মতো। বাঙালি জাতির জন্য একুশের গ্রন্থমেলা হোক নতুনমন্ত্রে প্রত্যয়ী হওয়ার তীর্থভূমি।

লেখক : কবি ও কথাশিল্পী

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.