এ পাপ আমার, এ পাপ তোমার

এ পাপ আমার, এ পাপ তোমার

সৈয়দ জাহিদ হাসান: আমাদের সকালগুলো একরাশ দুঃসংবাদ দিয়ে শুরু হয়। প্রতিদিনই এমন সব খবর আমাদের সামনে এসে হাজির হয়, তাতে মন খারাপ না-হয়ে পারে না। ইতর স্বভাবের মানুষগুলোর বিবেকহীন কাজে প্রতিদিনই ভরে উঠছে পত্র-পত্রিকার প্রশস্ত পাতা। দুঃসংবাদের ভিড়ে যে কখনো কখনো সুসংবাদ থাকে না এমন নয়, তবে একশটি দুর্ঘটনার ভিড়ে দুই-একটি ভালো খবর সহসা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় না। মানুষের ধারণা দুর্ঘটনাই আমাদের জীবনে স্বাভাবিক, বরং সুখবরই ব্যতিক্রম, অপ্রত্যাশিত।

ধর্ষণ এখন বাংলাদেশে মামুলি অপরাধ। প্রতিদিনই এখানে কামাক্রান্ত দুর্জনেরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে নমনীয় নারীর উপর। একক ধর্ষণের চেয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণই এই সময়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশি। পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে আমাদের দেশের বিকৃত রুচির মানুষেরা অনেক উদ্ভট অভ্যাস আয়ত্ত করেছে। সংঘবদ্ধ ‘ধর্ষণ’ তারই উদাহরণ। প্রেমের নামে ছলনা করে, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কিংবা ভালো  কোনো কাজের প্রস্তাব দিয়ে সহজ-সরল-নাজুক নারীদের প্রতারণা করে ধর্ষণ, অতঃপর হত্যার মতো ঘৃণিত ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের মামলা যে হচ্ছে না-তা নয়। একশটি ধর্ষণ হলে হয়তো একটি মামলা হয়, এক লক্ষ ধর্ষণ মামলায় এক-দুইজনের নির্ধারণ হয়, বাকিগুলো হারিয়ে যায় অন্ধকারে। যেখানে বিচারালয়ই অচল-অবশ, সেখানে ন্যায় বিচার কে পেতে পারে?

বাংলাদেশ ঘুষের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। এদেশের বেশির ভাগ মানুষই ঘুষ দেয় এবং নেয়। ঘুষ লেনদেন এ সমাজে অপরাধ বলে গণ্য নয়। এমন কোনো সরকারি দপ্তর বোধ হয় বাংলাদেশে নেই, যে দপ্তরে ঘুষ লেনদেন হয় না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, নিরাপত্তা, সব দপ্তরেই ‘ঘুষ’ একটি প্রিয় নাম। সৎ মানুষও এই ঘুষের সমুদ্রে পড়ে ঘুষখোর হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে শুধুই পাপ, অনাচার, নোংরামি। ভালো থাকা বাংলাদেশে সাধনার ব্যাপার।

এক সময় ভাবতাম গ্রামীণ জীবনেই স্বস্তি আছে, সরলতা ও সততা আছে। অপরাজনীতির কালো ছায়া পড়ে প্রান্তিক মানুষের স্বচ্ছ জীবনেও অন্ধকার জমে উঠেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গ্রামের মানুষেরা এখন সামাজিক কাজকর্মে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে সালিশে, মজলিসে নির্বিকারভাবে অসত্য সাক্ষ্য দিচ্ছে। লজ্জা আজ আর কারো চোখেই নেই। যে সমাজের মানুষের চোখ আছে, কিন্তু চক্ষুলজ্জা নেই সে-সমাজ কি সভ্য মানুষের সমাজ?

আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন পড়াশোনার ফাঁকে আড্ডাটার প্রতিই আকর্ষণ ছিল বেশি। সহপাঠীদের কিংবা সমমনা বন্ধুদের বুদ্ধিদীপ্ত আড্ডার আকর্ষণে পরীক্ষার খাতায় দুই-এক নম্বর কম পেলেও ব্যথিত হতাম না। গ্রাম থেকে শহরে এলে স্মৃতি হাতড়াতে যখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাই, তখন তরুণ-তরুণীদের ভিড় দেখি, কিন্তু আড্ডা দেখি না। আধুনিক ডিভাইজগুলো কাছের মানুষটাকেও কিভাবে ভুলিয়ে দেয়, অ্যানড্রয়েট মোবাইল সেট ব্যবহারকারী যুবাদের দেখলে তা আন্দাজ করা যায়।

কাছে থেকেও আমরা এখন অনেক দূরের মানুষ হয়ে যাচ্ছি। হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে এখন আর কারো হৃদয় স্পর্শ করতে আমরা কেউ উদ্বিগ্ন হই না। কারো বিপদে এখন আর সশরীরে উপস্থিত হওয়ার তাগিদ বোধ করছি না। ফেসবুকে ‘আমিন’, ‘ফি আমানিল্লাহ’ কিংবা ‘ইন্নালিল্লাহ’ বলেই দায়িত্ব শেষ করছি। আমরা মিছিল ভুলে গেছি, স্লোগান ভুলে গেছি, জীবন ভুলে গেছি। গর্দভের মতো মূলার লোভে হাঁটছি তো হাঁটছি। বুদ্ধি খাটিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি না, দুষ্টুরা প্রতারণা করতে পারে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণের ক্ষমতাকে স্বীকার করা হয়েছে। জনগণই ক্ষমতার উৎস হলে জনগণ শোষিত-নিপীড়িত-আইনের অধিকার থেকে বঞ্চিত কেন? এই প্রশ্নটা আমি সরকারকে নয়, জনগণকেই করতে চাই। আমজনতা লোভে পড়ে দিশেহারা হয়ে গেছে। তারা ভুলেই গেছে সরকার শাস্তিদাতা নন, সেবক। বস্তুত, সরকার নিজেই ভুলে বসে আছে সে-সরকার। এই ব্যাধি থেকে কবে মুক্ত হবে এদেশের সচেতন মানুষ?

শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আমলা, ইমাম, পাদরি, পুরোহিত সকলেই লোভের অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে উদগ্রীব হয়ে উঠছি। ব্যস্ত জীবনের দোহাই দিয়ে, সীমাহীন ভোগ-বিলাসে নিজেদের ভাসিয়ে দিতে স্বেচ্ছায় পাপাচার করছি। ব্যক্তিগত পাপ সজ্ঞানে সঞ্চার করছি সমাজদেহে। নিজেদের পাপ মুছে দিতে নিজেরাই তৈরি করছি মিথ্যাময় শাস্ত্র বাণী। ‘ব্যভিচার’ এখানে ‘মানবিক বিয়ে’ নামে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে, অধর্মীয় মৌলবাদকে চালানো হচ্ছে ধর্মীয় জিহাদ অভিধায়। আত্মশুদ্ধি ছাড়া আর কোনো মহৌষধ নেই আমাদের সামনে।

সম্পদে সুখ নেই, ক্ষমতায় সুখ নেই, অন্যায় আচরণে সুখ, এগুলো নীতি কথাই শুধু নয়। জীবনাভিজ্ঞ মানুষের বর্ণাঢ্য জীবনের কথা। এগুলোই মানবজাতির পথচলার পাথেয়। পুঁজিবাদি সমাজব্যবস্থায় পাপ কাজ সহজে করার সব পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে রাখা হয় মহৎ কাজের প্রচেষ্টা। সুখ-শান্তি বিঘিœত করে সবাইকে মাতাল করে দেয় দুষ্টু পুঁজিপতিসংঘ। মানুষ যত অস্থির থাকে, বোধহীন থাকে, ততই বৃদ্ধি পায় কালোটাকার পাহাড়। আমরা সবাই কালো টাকায়, কালো সম্পর্কে, কালো আইনের মোড়কে পাপ বিনিময় করছি। এ পাপের কোনো ক্ষমা নেই, প্রভু আমাদের ক্ষমা করো।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.