কানাডায় নবাগতদের করণীয়

কানাডায় নবাগতদের করণীয়

গোটা বিশ্বের কাছে কানাডা একটি স্বপ্নের দেশ। ম্যাপেল সৌন্দর্যের প্রগাঢ় আহ্বানে এ দেশে বসত গড়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসছে হাজার হাজার মানুষ। আসছে আমাদের দেশ থেকেও। একটি উন্নয়নশীল দেশ থেকে এক লাফে আধুনিক বিশ্বের এই সেরা দেশটিতে পা রেখে এ দেশের সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়ে চলাটা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। এবং সেটা সময় সাপেক্ষও বটে। অনুকুলে সব থাকলেও না জানার কারণে কিংবা প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে আগতদের নানা প্রতিকুলতার শিকার হতে হয়। অযথাই সময় নষ্ট হয়। কানাডায় নবাগতদের এদেশে স্থিতিশীল হতে সহযোগিতা করা এবং সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করার লক্ষ্যে ‘কানাডায় নবাগতদের করণীয়’ শীর্ষক এ উপস্থাপনা। লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনটি কানাডায় নবাগতদের বিশেষ উপকারে আসবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।-সম্পাদক কানাডা-৪

 

টার্কিশ এয়ারলাইনসের সুবিশাল এয়ারবাসটা যখন কানাডা’র মাটি স্পর্শ করলো, ঘড়িতে তখন স্থানীয় সময় বিকাল পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। টরন্টো’র পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের কাস্টমস-ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ বেল্ট থেকে নিজের মালামালগুলো খুঁজে নিয়ে দীর্ঘ প্রায় ২০ ঘন্টার জার্নি শেষে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটায় প্রায় জমে যাবার যোগাড়। আমাকে যে বন্ধুটি নিতে আসার কথা তাকে কোথাও দেখলাম না। তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যে বড় বড় লাগেজগুলো সামলাতে আমি যখন ব্যাস্ত, হঠাৎ পাশ থেকে এক নারী কণ্ঠের প্রশ্ন, “ক্যান আই হেল্প ইউ, স্যার?” তাকিয়ে দেখলাম এক ভদ্রমহিলা। এয়ারপোর্টের-ই কোন এক পুলিশ অফিসার হবেন। তাকে জানালাম যে, আমার বন্ধু গাড়ি নিয়ে আসার কথা আমাকে নেবার জন্যে। আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি। ভদ্রমহিলা নিজে থেকেই আমার বন্ধুর ফোন নম্বর নিয়ে তাকে ফোন দিয়ে আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। এই প্রথম পরিচিত হলাম কানাডার মানুষদের চমৎকার ব্যবহারের সাথে।   বাংলাদেশ থেকে আসার আগে কানাডা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা ছিলনা। শুধু ই্উটিউব আর হলিউড সিনেমার বদৌলতে এখানকার বাড়ি-গাড়ি-মানুষজন দেখেছি। বাংলাদেশ থেকে এখানে আসার আগে অনেক অজানা শঙ্কা, দ্বিধা মনের ভেতরে ঘুরপাক খেয়েছে।   আজ তাই আমার সদ্য অভিজ্ঞতার আলোকে এই লেখাটি লিখছি শুধু তাদের জন্যেই, যারা অদূর ভবিষ্যতে সুদূর বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার কানাডার টরন্টো শহরে আসছেন ইমিগ্র্যান্ট হয়ে। লেখাটি সম্পূর্ণরূপেই আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে লিখিত। পাঠক, চলুন তা হলে শুরু করা যাক- কানাডা-৪

 

কানাডার ভিসা পাবার পর যা করণীয়

১. প্রথমেই আপনাকে পরামর্শ দেবো, আপনার পাসপোর্ট এবং COPR ফর্মটি অতন্ত্য যত্নের সাথে সংরক্ষণ করুন। টার্কিশ এয়ারলাইন্সে কানাডায় আসার পথে ইস্তাম্বুলের এয়ারপোর্টে আমার পাসপোর্টের সাথে এই COPR ফর্মটি কর্তব্যরত অফিসার দেখতে চেয়েছিলেন। সুতরাং এই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হ্যাণ্ড-লাগেজে বহন করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।   ২. যত দ্রুত সম্ভব টিকেট বুকিং দিন। রওনা হবার কমপক্ষে দেড় থেকে দুই মাস আগে টিকেট কনফার্ম করলে কিছুটা কম দামে টিকেট পেতে পারেন।   ৩. যারা দীর্ঘ সময়ের জন্যে কানাডা আসছেন, তাদের উদ্দেশ্যে জানাচ্ছি, টার্কিশ, এমিরেটস ইত্যাদি প্রায় সব এয়ারলাইন্সেই আপনাকে ২৩ কেজি করে দু’টি বড় লাগেজ এবং হ্যাণ্ড লাগেজে ৭-৮ কেজি মালামাল বহন করতে পারবেন। ২৩ কেজির জায়গায় সর্বোচ্চ ২৫ কেজি পর্যন্ত আনতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে যাত্রার দিন বোর্ডিং-এর সময় আগে আগে যাবার পরামর্শ দিচ্ছি।   ৪. কানাডা আসার আগে আমার মনে প্রশ্ন ছিল, কি কি নিয়ে আসতে পারবো, কি কি আনতে পারবো না ইত্যাদি। কানাডায় অবস্থানরত অনেকেই অনেক পরামর্শ দিয়েছে। আমি এত বিস্তারিততে নাই বা গেলাম। শুধু এতটুকু বলতে চাই, আসার আগে প্রচুর আণ্ডারগার্মেন্ট, মোজা, টি-শার্ট, ফরমাল শার্ট, বঙ্গবাজারের কানটুপি যা এনেছি, সেসব এখন বেশ কাজে দিচ্ছে। আর গরম কাপড় বলতে দুইটা মোটা সোয়েটার এনেছিলাম। বাকী গরম জামা বলতে লেদার জ্যাকেট, ইনার, হাতমোজা, ওভারকোট ইত্যাদি বাংলাদেশ থেকে না এনে এখান থেকে কিনেছি। কারণ বাংলাদেশী ফ্যাশন এখানে চলবে না।   ৫. বাংলাদেশ থেকে আসার সময় সবচাইতে যে চিন্তাটা মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল তাহলো, সাথে করে সর্বোচ্চ কত ডলার নিয়ে আসা যায়? এ ব্যাপারে বাংলদেশ সরকারের সকল নিয়মনীতি ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে জানলাম, বর্তমানে ১ বছরের মধ্যে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) জনপ্রতি সর্বোচ্চ ৫০০০ ডলার যে কোন ব্যাক্তি পাসপোর্টে এনডোর্স করে (ব্যাঙ্ক/মানি এক্সচেঞ্জ থেকে) বাংলাদেশ থেকে বিদেশে নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু ব্যাঙ্কে (স্ট্যাণ্ডার্ড চাটার্ড ব্যাঙ্ক) খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, জনপ্রতি সর্বোচ্চ ২০০০ ইউ.এস ডলার তারা পাসপোর্টে এনডোর্সমেন্ট করতে পারবে। বাকী ৩০০০ ইউ.এস ডলার ব্যাঙ্ক থেকে ‘ট্র্যাভেলার্স চেক’ হিসেবে নিয়ে আসা যায় যেটা করাটা বোকামী, কারণ ‘ট্র্যাভেলার্স চেক’ করে আনলে কানাডা আসার পর দেখবেন আপনি ডলারে সে টাকাটা অনেক কম পাচ্ছেন।   সুতরাং, এত ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে নিয়ম অনুযায়ী স্ট্যাণ্ডার্ড চাটার্ড ব্যাঙ্ক থেকে ২০০০ ইউ.এস ডলার পাসপোর্টে এনডোর্স করালাম। আর আমার বাকী টাকাকে গুলশানের এক মানি-এক্সচেঞ্জে গিয়ে কানাডিয়ান ডলারে পরিণত করলাম। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে ২০০০ ইউ.এস ডলার মানি ব্যাগে রাখলাম আর বাকী কানাডিয়ান ডলারগুলো স্মার্টলি প্যান্টের পকেটে ভরে নিয়ে এলাম। ভাগ্য ভালো ছিল বলে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন এ খবর জানলো না। সুতরাং ডলার নিয়ে এ্যাত টেনশন করার কিছু নেই। বাংলাদেশ সরকারের নিয়ম অনুযায়ী যা পাসপোর্টে এনডোর্স করাতে হয়, তা করে বাকীটা পকেটে অথবা সুবিধামত জায়গায় ভরে নিয়ে আসতে হবে, আর কাস্টমস-ইমিগ্রেশনের সাথে স্মার্টলি কথা বলতে হবে। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ব্যাঙ্ক/মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ইউ.এস ডলারের এনডোর্সমেন্ট হয়, কানাডিয়ান ডলারের হয় না।   ৬. দুধ/দুগ্ধজাত পণ্য, কাঠের তৈরি বস্তু ইত্যাদি সাথে আনতে পারবেন না। সিগারেট জনপ্রতি এক কার্টুনের বেশি আনলে অতিরিক্ত কার্টুনের জন্যে বিশাল ট্যাক্স দিতে হবে। এমন কোন বাংলাদেশী পণ্য নেই, যা এখানে পাওয়া যায়না। সুতরাং খাদ্যবস্তুর বোঝা টেনে আনাটা বোকামী বলেই আমি মনে করি।   ৭. কানাডায় আসার আগেই এখানকার পরিচিত মানুষজনের সাথে কথা বলে থাকার জায়গা ঠিক করে নিন।কারণ টরন্টোতে ইমিগ্রেশনের সময় ইমিগ্রেশন অফিসার আপনার টরন্টোর একটা ঠিকানা চাইবে, যে ঠিকানায় ভবিষ্যতে আপনার পি.আর কার্ড পৌঁছে যাবে।   ৮. টরন্টোতে প্রতিমাসে কি রকম খরচ হতে পারে তার আনুমানিক একটা কম খরচের হিসাব নিচে দিলাম:   ক. বাসা ভাড়া ১ বেড- লিভিংরুম- ডাইনিং-কিচেন- ওয়াশরুম: ৮০০-৮৫০ ডলার খ. হাইড্রো বিল (ইলেকট্রিসিটি বিল): ৭০-৮০ ডলার (দুই মাসে)। গ. মোবাইল ফোন যদি কম খরচের কানেকশন নেন তাহলে মাসে নূন্যতম ৩৫ টাকা ঘ. খাবার খরচ জনপ্রতি ১০০-১২০ ডলার। ঙ. বাস/ট্রেনে যাতায়াত, লণ্ড্রি এবং আনুঙ্গিক খরচ ৫০ ডলার ধরে রাখুন। (অন্যান্য আরও অনেক ধরনের খরচ আছে যা আমার পরের পর্বগুলোতে আলোচনা করা হবে)।

কানাডা-৪

 

কি কাজ করবেন

যারা কানাডায় একেবারেই নতুন, তারা আসার পর যেকোন কাজ পেতে একটু সময় লাগতে পারে। তাই বাংলাদেশ থেকে ২-৩ মাস চলার মতো টাকা নিয়ে আসাটা ভালো। একটা কথা এই বেলা বলে রাখি, বাংলাদেশী টাকার সাথে কানাডিয়ান ডলার রেট চিন্তা করে যদি কানাডায় খরচ করেন, তাহলে মন খারাপ হয়ে যেতে পারে। এখানকার লিভিং স্টাইল এবং খরচ অনুযায়ী চিন্তা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।   পরের পর্বে পি.আর কার্ড, সিন কার্ড, হেল্থ কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ড সহ আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার আশা রাখছি। ॥ চলবে॥

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.