কানাডায় নবাগতদের করণীয়-২

কানাডায় নবাগতদের করণীয়-২

কানাডা-৪

টরন্টোর পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের কাস্টমস-এর বিশাল লাইনে প্রায় ত্রিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর কাস্টমসের পুলিশ অফিসার এক ভদ্রমহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি হাসি মুখে আমাকে বললেন, “বোজো মঁশিয়ে”। (ফ্রেঞ্চ ভাষায় শুভেচ্ছা দেওয়া)।

অবাক হলাম একটু। আমাকে কি ফ্রেঞ্চ স্পিকিং কোন মানুষ মনে হয়? দেশে থাকতে তো কোনোদিন ভেবে দেখিনি ব্যাপারটা! যাইহোক, ভদ্রমহিলাকে প্রতিউত্তরে বললাম, “গুড ইভনিং” তিনি বুঝে নিলেন, আমি ইংলিশ স্পিকিং। পরবর্তীতে যখন কানাডা’র মন্ট্রিয়াল শহরে গিয়েছি, সেখানে আরও বিপদে পড়েছি, সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা ওখানে ফ্রেঞ্চ ছাড়া কিছুই পারে না! এই যুগে তারা ইংরেজি বলতে পারে না! মূলত ওরা ইংরেজীকে দারুণভাবে অপছন্দ করে। হৃদয় নিজের মাতৃভাষা ফ্রেঞ্চ-এর বাইরে আর কোনো ভাষাকে স্থান দিতে নারাজ।

ম্যাপল লীফের দেশ কানাডার অফিশিয়াল ভাষা ইংরেজি এবং ফ্রেঞ্চ। কাজেই যারা বাংলাদেশ থেকে ফ্রেঞ্চ শিখে আসছেন, তারা কুইবেক প্রভিন্সে গিয়ে অন্তত: আমার মতো অসহায় বোধ করবেন না। তবে বাংলাদেশের ফ্রেঞ্চ শিক্ষাটা সেখানে তেমন একটা কার্যকর নয়। কেননা, এদের ফ্রেঞ্চটা আর একটু ভীন্ন।

কাস্টমসের অমায়িক মহিলাকে আমার পাসপোর্ট, সি.ও.পি.আর (কপি অব পারমানেন্ট রেসিডেন্স) ফর্ম দেখানোর পর তিনি আমাকে ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে চালান করে দিলেন।

আবার দীর্ঘ লাইন। অবশেষে আমার পালা এলো। ইমিগ্রেশন অফিসার আমার সি.ও.পি.আর ফর্মে নিচের তথ্যগুলো লিখলেন:

১. টরন্টোতে যে ঠিকানায় আমি থাকবো।

২. বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ ডলার সাথে করে এনেছি। (যা এনেছি, সত্যিটাই বলেছি)

৩. সি.ও.পি.আর ফর্মে আমার তিনটা সাক্ষর নিলেন।

এরপর সি.ও.পি.আর ফর্মের (ল্যাণ্ডিং পেপার) একটা কপি এবং পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “ওয়েলকাম টু ক্যানাডা”।

ভদ্রমহিলার থেকে বিদায় নিয়ে আরও দুই জায়গায় আমার পাসপোর্ট আর ল্যাণ্ডিং পেপার দেখাতে হলো। তারা আমাকে একগাদা কাগজ আর কিছু বই ধরিয়ে দিলো কানাডায় আমার পরবর্তী দিনগুলোতে কিভাবে চলতে হবে তার দিক নির্দেশনা হিসেবে। আজকের পর্বে চলুন জেনে নেই সেই দিকনিদের্শনাসমূহের কিছু অংশ:

 

১. SIN Card (Social Insurance Number Card):

টরন্টোতে ল্যাণ্ড করার পরদিন জেটল্যাগের কারণে সারাদিন বেশ আয়েশ করে ঘুমিয়ে কাটালাম। তারপরদিন সকালবেলায় চলে গেলাম বাসার কাছের ‘সার্ভিস কানাডা’তে (৫৩৪৩ ডানডাস স্ট্রীট, কিপলিং টিটিসি-এর কাছে)।

আমার পাসপোর্ট আর ল্যাণ্ডিং পেপার দেখে কর্তব্যরত কর্মকর্তা আমার SIN Card এর অ্যাপ্লিকেশন কম্পিউটারে ইনপুট দিলেন। এখানে কোন খরচ নাই। সপ্তাহ দু”য়েকের মাথায় আমার বাসার ঠিকানায় চিঠিসহ ৯ ডিজিটের SIN Card চলে এলো। SIN Card নম্বরটি গোপনীয় বিধায় আপনাদের সাথে এই মুহূর্তে তা শেয়ার করতে পারছিনা। দু:খিত।

 

২. ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট:

যারা এখানে নতুন আসবেন, তাদের জন্যে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের বিভিন্ন ‘নিউ কামার’ অফার রয়েছে। তবে ইচ্ছে মতো অ্যাকাউন্ট না খুলে আপনার বাসার কাছের CIBC এবং RBC (Royal Bank of Canada) ব্যাংকে একটি করে chequing অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলুন। CIBC এর সুবিধা হলো, এরা এক বছর আপনার ওই chequing অ্যাকাউন্টের জন্যে কোন মাসিক ফি কাটবে না। আর সাময়িক অসুবিধা হলো, এদের থেকে ফ্রি ক্রেডিট কার্ড নিতে গেলে আপনার কানাডিয়ান একটা ফটো আই.ডি লাগবে (পি.আর কার্ড/ ড্রাইভিং লাইসেন্স)।

ল্যাণ্ড করার আড়াই-তিন মাসের আগে আপনি পি.আর কার্ড (পারমানেন্ট রেসিডেন্সি কার্ড) পাবেন না, যা আপনার বাসার ঠিকানায় অটোমেটিক চলে আসবে। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স তুলতেও কিছুটা সময় লেগে যায়। এই বেলা ছোট একটি কথা জানিয়ে রাখি। কানাডা আসার পর আমি পি.আর কার্ড পেয়েছি ঠিক আট সপ্তাহের মাথায়। কানাডা থেকে যে কোন সময় আপনি বের হয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু ঢুকতে হলে এই পি.আর কার্ড আপনাকে ইমিগ্রেশনে দেখাতেই হবে। সুতরায় পি.আর কার্ড হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কানাডা থেকে বের হয়ে যাওয়াটা বেশ রিস্ক-এর ব্যাপার।

 

ছবি: পি.আর কার্ড

 

RBC (Royal Bank of Canada) ব্যাঙ্কের সুবিধা হলো তিনটি:

এক. এরা chequing অ্যাকাউন্টের জন্যে প্রথম ছয় মাস কোন মাসিক ফি কাটবেনা।

দুই. এখানে অ্যাকাউন্ট করে ১০০০ ডলারের একটা গোল্ড ক্রেডিট কার্ড (ভিসা) আপনি সপ্তাহখানেকের ভেতরেই পেয়ে যাবেন। আপনার অ্যাকাউন্টে একটা টাকা না রাখলেও চলবে।

তিন. এক বছরের জন্যে আপনাকে একটা ছোট লকার এরা ফ্রি-তে দেবে। ওই লকারে আপনি আপনার পাসপোর্ট, পি.আর. কার্ড, সিন কার্ড, ডলারসহ গোপন কাগজাদি রাখতে পারবেন। এক বছর ফ্রি শেষ হবার পর বছরে চল্লিশ ডলার করে দিলে আপনি এই লকার সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন। প্রসঙ্গত: জানিয়ে রাখছি, লকারের ২ টা চাবি সযত্নে রাখতে হবে। লকার থেকে কিছু তুলতে বা জমা দিতে গেলে ওই দুইটা চাবি সাথে নিয়ে যেতে হবে। একটা চাবি হারালে ২৫ ডলার জরিমানা। দুইটা চাবি হারালে ২৫০ ডলার জরিমানা।

যেকোন ব্যাঙ্কে শুরুতে চেকিং অ্যাকাউন্ট করে ছয়মাস বা একবছর ‘ফ্রি মাসিক ফি’ সুবিধা উপভোগ করার পর ওই ব্যাঙ্ক/ব্যাঙ্কগুলোতে অ্যাপ্লাই করে সর্বনিম্ন মাসিক ফি (মাসে ২-৩ ডলার) এর সেভিংস অ্যাকাউন্ট প্ল্যানে চলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

TD ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম ফ্রি তে যদি একটা ক্রেডিট কার্ড বাগানো যায়। কিন্তু তারা জানালো, অ্যাউন্টে ৫০০ ডলার রাখলে ৫০০ ডলারের একটা ক্রেডিট কার্ড দিবে। ভদ্রলোকের মতো সালাম দিয়ে উঠে এলাম।

সোজা বাংলা, টরন্টোতে ল্যাণ্ড করার পরপরই যে যে ব্যাঙ্ক থেকে ফ্রিতে ক্রেডিট কার্ড পাবেন, নিয়ে নেবেন। পরে আর কিন্তু ফ্রি নেই কোন! প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করার সময় আপনার পাসপোর্ট, ল্যাণ্ডিং পেপার এবং ঠিকানার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

 

কানাডার ক্রেডিট কার্ড এবং ক্রেডিট রেটিং নিয়ে পরবর্তী পর্বে আরও বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে আছে।

 

৩. হেলথ কার্ড:

আপনার পাসপোর্ট, ল্যাণ্ডিং পেপার এবং ১ মাসের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট (ব্যাঙ্ক থেকে আপনার বাসার ঠিকানায় পোস্ট করা) অথবা ফটো আই.ডি (পি.আর কার্ড অথবা ড্রাইভিং লাইসেন্স) নিয়ে বাসার কাছের সার্ভিস ওন্টারিও-তে চলে যান।এখানে কোন খরচ নাই। আপনার বাসার ঠিকানায় অটোমেটিক হেলথ কার্ড চলে আসবে।

প্রসঙ্গত: জানিয়ে রাখছি, কানাডায় হেলথ সার্ভিস ফ্রি। ছোট-খাট অসুস্থতার জন্য ওয়াকিং ক্লিনিক-এ যেতে পারেন। আর বড় ধরণের অসুস্থতার জন্যে সরাসরি হেলথ কার্ড নিয়ে ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে চলে যেতে পারেন। অর্থাৎ আপনি অসুস্থ হলে ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে যাবেন, ডাক্তার আপনার হেলথ কার্ড দিয়ে কানাডা গভর্ণমেন্টের থেকে তার সার্ভিস চার্জ নিয়ে নেবেন এবং আপনি সম্পূর্ণ ফ্রি চিকিৎসা পাবেন। তবে ওষুধের খরচ আপনার নিজের। যদি আপনার মেডিকেলি ইনস্যুরেন্স করা থাকে, তাহলে ওষুধের যে টাকা আপনি খরচ করবেন, পরবর্তীতে কানাডা গভর্ণমেন্ট আপনাকে সেই টাকা ফেরৎ দিয়ে দেবে। আর একটি কথা, কানাডার ইমিগ্র্যান্ট কেউ যদি প্রফেশনাল জব করেন, তাহলে তার কোম্পানী থেকেই ‘মেডিকেল ইনস্যুরেন্স’ করে দেয়, তাকে আলাদা ভাবে টাকা খরচ করে এই ইনস্যুরেন্স করতে হয়না।

আরেকটি বিষয় জানিয়ে রাখি, হেলথ কার্ড অর্থাৎ হেলথ ইনস্যুরেন্স, যা কানাডা গভর্ণমেন্ট প্রতিটি সিটিজেন এবং ইমিগ্র্যান্টদেরকে ফ্রি অব কস্ট দিয়ে থাকে (যে কোন ধরণের মেডিকেল/ সার্জিকেল সমস্যা), তা দিয়ে চোখ এবং দাঁতের চিকিৎসা ফ্রি-তে করা যাবে না। বিশেষত: দাঁতের চিকিৎসার খরচ এখানে মারাত্মক। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে কানাডা আসার আগে ভাল করে চোখ এবং দাঁতের চিকিৎসা করিয়ে আসুন। আর যাদের চোখে দূরদৃষ্টি কিংবা নিকটদৃষ্টির সমস্যা আছে বলে গ্লাস ব্যবহার করেন, তারা বাংলাদেশ থেকে বেশি করে গ্লাস/ফ্রেম কিনে নিয়ে আসলে ভালো হয়।

 

 

৪. ড্রাইভিং লাইসেন্স:

আপনার দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টগুলোর অন্যতম হলো ড্রাইভিং লাইসেন্স। এটি আপনার একটি ক্যানাডিয়ান ফটো আই.ডি যা প্রতিনিয়ত কাজে লাগবে।নিচের ধাপগুলো অনুযায়ী আগাতে পারলে ভালো হয়:

 

ক. বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ৫-৬ বছরের পুরনো ইংরেজি ভার্সন লাইসেন্স থাকলে সাথে করে নিয়ে আসুন।

খ. ওই লাইসেন্সের মূল কপি, ১ টা ফটোকপি, ১ কপি ছবি এবং ওটোয়া’তে বাংলাদেশ হাই কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা ফরম পূরণ করে কানাডা পোস্টের মাধ্যমে অটোয়াস্থ বাংলাদেশ হাই-কমিশনে সব ডকুমেন্ট পাঠিয়ে দিন। সাথে কানাডা পোস্ট থেকে ২৫ ডলার দিয়ে একটা ব্যাঙ্ক ড্রাফট এবং ফিরতি খাম সংযুক্ত করে দিন। মনে রাখবেন, অটোয়াতে পাঠানো সব কাগজপত্র অতিরিক্ত টাকা খরচ করে এক্সপ্রেস মেইলে পাঠাবেন এবং ফিরতি খামটাও এক্সপ্রেস মেইল দিয়ে দেবেন।

খ. ওয়েবে সার্চ করে আপনার বাসার কাছাকাছি G1 লিখিত পরীক্ষার সেন্টারে প্রথমেই আপনাকে G1 লাইসেন্সের জন্যে (লার্নার) লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে। এক্ষেত্রে ১২৫ ডলার, আপনার পাসপোর্ট, ল্যাণ্ডিং পেপার, অটোয়া থেকে আপনার বাংলাদেশি লাইসেন্সের অথারাইজেশন লেটার ইত্যাদি সাথে করে নিয়ে যান। G1 পাশ করে গেলে আপনি এবার সরাসরি G লাইসেন্সের জন্যে পরীক্ষা দিতে পারবেন।

G1 লাইসেন্সের প্রস্তুতির জন্যে এই ওয়েবসাইটটি দেখতে পারেন।

আর একটি কথা, ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে প্রভিন্স বিশেষে অনেক নিয়ম-কানুনের হেরফের রয়েছে।

এ সংখ্যায় এ পর্যন্তই। পরের সংখ্যায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে হাজির হওয়ার আশা রাখছি।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.