ক্রেডিটঃ বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি

ক্রেডিটঃ বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি

ফাতেমা বেগমঃ বাড়ির মূল কাঠামোর যেমন একটি নকশা থাকে, তেমনি উত্তর আমেরিকায় আপনার আর্থিক জীবনের নকশা হচ্ছে “বেকন স্কোর” বা “ক্রেডিট স্কোর”। এই রিপোর্ট হচ্ছে আপনার আর্থিক অবস্থার নাড়ি, যার মাধ্যমে আপনার আর্থিক শক্তির অবস্থান, এবং তার  উঠানামা নির্ণীত হবে।

আপনার কোন ঋণ নেই, আপনি কোন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন না, তারপরও আপনার ক্রেডিট ইতিহাস ভালো থাকবে, সেই প্রচলিত তত্ত্ব অচল। এখানে যুক্তি হচ্ছে, ক্রেডিটই যদি না করলেন তাহলে ক্রেডিট ইতিহাসের জন্ম কিভাবে হবে? আপনি মর্টগেজ বা যে কোন ইন্সটলমেন্ট ঋণ পেতে চাইলে এই ক্রেডিট স্কোরের পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। যেমন কম স্কোর মানে দুর্বল ক্রেডিট স্কোর,  তেমনি একদম কোন ঋণ না করলেও আপনি দুর্বল ক্রেডিট স্কোরের দলে পড়ে যাবেন। এব্যাপারে আমার কর্ম অভিজ্ঞতায় বেশ কিছু বাস্তব উদাহরণ দেখেছি।    

ক্রেডিট ইতিহাস থেকে আপনার আর্থিক ব্যবস্থাপনা,এবং আর্থিক জীবনযাত্রার মনস্ত্বাত্বিক বিশ্লেষণ চলতে থাকে। আপনি ক্রেডিটকে কতটুকু মর্যাদা দেন? আপনি কি চুক্তিপত্র মেনে  চলছেন? আপনি কি খুব কম বা খুব বেশী ক্রেডিট করছেন?  আপনি কি ন্যুনতম পরিশোধের সময়সীমা নিয়মিত পালন করে চলেছেন? আপনাকে লিমিট দেয়া থাকবে, কিন্তু আপনি কি আবার  লিমিটের পুরোটা ব্যবহার করে ফেলেছেন? লিমিটে লিমিট মেনে না চলার মানে হচ্ছে আপনার আর্থিক দুর্ভিক্ষের একটি আভাস। তবে আপনার কার্ডে ব্যালেন্স যত বেশী হবে, ক্রেডিট কোম্পানীর আয় তত বেশী।

শতকরা ৮০% এর বেশী মানুষ ক্রেডিটের ব্যাপারে কম জ্ঞানের কারণে চড়া সুদ পরিশোধ করছে। এই চড়া সুদ কি শুধু উল্লেখিত সুদের হারের পরিমান? এখানে দেখতে হবে আপনার ক্রেডিট কি “রিভোলভিং” নাকি  “ফিক্সড”। রিভলভিং হলে সুদের হার চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। আপনার ব্যালেন্স আর এই চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের কারণে আপনার মূল ঋণের পরিমান ফুলে ফেঁপে বিশাল আকার ধারণ করে। রিভলভিং ক্রেডিটে সুদ প্রতিদিন চক্রবৃদ্ধি হারে যোগ হয়। একটা উদাহরণ নেয়া যাকঃ ১৭০০০ ডলারে ক্রেডিট, ১৮% সুদ। রিভলভিং সুদের হারে …১৭ বছর ২ মাস লাগবে পরিশোধ করতে, মোট সুদ $১২,৫০০ ডলার।

ফিক্সড সুদের হার হলে ১৭,০০০ ডলারে সুদের পরিমান হবে $৫৩৭০ ডলার, এবং তা পরিশোধ করা যাবে ৩ বছর দুই মাসে। পার্থক্য হলোঃ $৭১৩০ ডলার এবং ১৪ বছর বেশী।

তিন(৩) ধরণের ক্রেডিট আছে।

‘I’ – ইন্সটলমেন্ট ক্রেডিট যেমন গাড়ি, আসবাবপত্র ঋণ।

‘O’ – কোন সময়সীমা নেই, উন্মুক্ত। যেমন, মোবাইল ফোনের ক্রেডিট

‘R’ – রিভলভিং ক্রেডিট( ক্রেডিট কার্ড এবং লাইন অফ ক্রেডিট)

এই ‘R’ ধরণের ক্রেডিট হচ্ছে আপনার ক্রেডিট যোগ্যতার সবচাইতে বড় নির্ধারক। আপনাকে কমপক্ষে দুইটি ক্রেডিট ব্যবহার করতে হবে। 

ক্রেডিট স্কোর বানাতে “রেটিং” পদ্ধতি কী?

আপনার ক্রেডিট পরিশোধের ব্যবহারকে ১-৯ পর্যন্ত রেটিং করা হয়। ১ হচ্ছে আপনি নির্ধারিত তারিখের ৩০ দিনের মধ্যে বিল পরিশোধ করছেন। সম্পূর্ণ বা ন্যুনতম পরিমান। ৯ হচ্ছে আপনি কিছুতেই শোধ করছেন না, খারাপ ক্রেডিটের তালিকাভুক্ত হয়ে কালেকশনে চলে গেছে। কেউ যদি কালেকশন থেকে চিঠি বা ফোন পেয়ে থাকেন, তাহলে আপনি “৯”।

ক্রেডিট স্কোর কিভাবে নির্ধারিত হয়?

ধরা যাক, মোট স্কোর ১০০।

৩৫% হিসাব করা হয় আপনার পরিশোধের ইতিহাসের ভিত্তিতে। নিয়মিত, সময়মত শোধ করছেন কিনা। সবচাইতে সাম্প্রতিক আচরন আপনার ক্রেডিট যোগ্যতায় সবচাইতে বেশী প্রভাব ফেলবে।

৩০% হিসাব হয় ক্রেডিট লিমিটের ব্যালেন্সের ভিত্তিতে। সাধারণত, আদর্শ পরিমান হচ্ছে লিমিটের ৩৫% ব্যালেন্স রাখা। আমি অবশ্য ক্লায়েন্টদের ৫০% পর্যন্ত রাখতে পরামর্শ দেই।

১৫% হিসাব হয় ক্রেডিট ইতিহাসের দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে। যত লম্বা এবং যত ভালো, তত বেশী ভালো স্কোর। ধরা যাক, আপনার তিনটি(৩) কার্ড আছে, যথাক্রমে ৭,৬,৫ বছর। তাহলে আপনার গড় দৈর্ঘ্য হবে ৬ বছর। এখন যদি নতুন কার্ড নেন, তাহলে এই দৈর্ঘ্য কমে ৪.৭৫ বছর হবে। খারাপ হলো। স্কোর কমলো।

১০% হিসাব হয় কত ঘন ঘন আপনি নতুন ক্রেডিট চেষ্টা করেন। নতুন ক্রেডিটের চেষ্টায় যে ইনক্যুয়ারী হয় তাকে “হার্ড পুল” বলা হয়।  বেশী নতুন ক্রেডিটের জন্য চেষ্টা করলে তারা ধারনা করে যে আপনি অর্থ সংকটে আছেন। নতুনে স্কোর কমে। তবে ঠিকঠাক বিল পরিশোধ করলে ৯০ দিন পর স্কোর আবার বাড়বে।  

বাকী ১০% হিসাব হয় কি ধরণের ক্রেডিট ব্যবহার হচ্ছে তার ভিত্তিতে। শুধু একধরণের ক্রেডিট সুপারিশ করা হয় না। পাঁচ মিশালী যেমন ইনস্টলমেন্ট, মর্টগেজ, এবং সর্বনিম্ন ২/৩ থেকে সর্বোচ্চ ১০টি রিভলভিং একাউন্ট।

তাহলে ৩৫%+৩০%+১৫%+১০%+১০%=১০০%

সতর্কতাঃ

কিছু ভুল ধারনা

  • কম ঋনের পরিমান, বেশী স্কোর।

তবে আমি এমন মানুষকে জানি যাদের $৭০-৮০,০০০ ডলার ঋণ থাকার  পরও তাদের স্কোর স্বামী ৮০০+ এবং স্ত্রী ৭০০+।

  • প্রতি মাসে সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ করা মানেই স্কোর বেশী হবে।

সময়মত করছেন কিনা সেটা আসল গুরুত্বপূর্ণ। সময়মত ন্যুনতম পরিমান পরিশোধ করলে এবং ব্যালেন্স ঠিক থাকলে স্কোর ঠিক থাকবে।

  • অতিরিক্ত একাউন্টগুলি বন্ধ করে দিলে স্কোর বাড়বে।

একাউন্ট কত পুরানো বা নতুন, সেটা দেখতে হবে। পুরানোগুলি স্কোরকে বেশী প্রভাবিত করে।

  • নিয়মিত শুধু ন্যুনতম পরিমান পরিশোধ করলে স্কোর বাড়ে, এবং তা স্থির থাকে।

এখানে ব্যালেন্সকে যোগ করতে হবে। ব্যালেন্স যদি লিমিটের কাছাকাছি হতে থাকে তখন স্কোর খারাপ হয়। আপনার স্কোরের শতকরা ৬৫% ভাগ এই দুই কারণে প্রভাবিত হয়।

২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একুইফেক্স থেকে প্রায়  ১৫০ লক্ষ নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়, যেখানে ছিল ব্যক্তিগত তথ্য, সোশ্যাল ইনসুরেন্স নম্বর, ক্রেডিট কার্ড তথ্য। কানাডাতেও ১০০,০০০ কানাডিয়ানদের তথ্য চুরি হয়েছিল। তবে কানাডিয়ানদের ক্ষেত্রে এটা বের করা সম্ভব নয় যে ঠিক কার তথ্য চুরি হয়েছে। একুইফেক্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরী করেছিল যার মাধ্যমে পরীক্ষা করা সম্ভব ছিল কোন নাগরিকদের তথ্য চুরি হয়েছে। কিন্তু কানাডিয়ানদের জন্য একুইফেক্স এমন কোন ওয়েবসাইট বানায়নি। ব্যক্তিগত তথ্য চুক্তি ভঙ্গের কারণে মার্কিনের একুইফেক্সকে $মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে। কানাডায় সেটি সম্ভব হয়নি।

এছাড়া, প্রশাসনিক ভুলের কারণে কারোর তথ্য সঠিকতা হারাতে পারে। সম্প্রতি, একজন ক্লায়েন্টের এই ধরনের ভুগান্তি প্রত্যক্ষ করেছি। তারা তিন(৩) বছর যাবৎ কানাডায় আছেন। অথচ, একটি ক্রেডিট তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০১০ সালে তার একাউন্ট খোলা হয়েছে। তারপর বের হলো যে, তার নামে দুইটা একাউন্ট কাজ করছে। আরেকজনের নাম দিয়ে আরেকটি ক্রেডিট রিপোর্ট।

ভুলের কারণে আরেকেজনের একাউন্টের সাথে আপনার একাউন্ট মিলে যাবে। তাই নিয়মিত ক্রেডিট রিপোর্ট লাইন বাই লাইন মিলিয়ে দেখতে হবে।

আবার, অননুমোদিত কোন ইনক্যুয়ারী হতে পারে, যা আপনি জানেন না এবং যার কারণে আপনার স্কোর কমে যেতে পারে। এক্ষেত্রে, প্রাসঙ্গিক হলো হার্ড পুল এবং সফট পুলের এর পার্থক্য কি তা খেয়াল করা।  নিজের রিপোর্ট নিজে আপলোড করলে তা সফট পুল হবে। কিছু কিছু বাইরের অনুসন্ধানও সফট পুল হতে পারে। তবে তা জেনে নিতে হবে। শতকরা ৯০% এর বেশী উত্তর আমেরিকানদের স্কোর কমে যায় শুধুমাত্র তাদের রিপোর্টে ভুল থাকার জন্য। এবং আমরা অধিকাংশ সেই ভুল সম্পর্কে অবগত থাকি  না।

ক্রেডিট ব্যুরো আপনার জন্য কাজ করে না। তারা ঋণদাতাদের জন্য কাজ করে।

একটি মর্টগেজ ক্রেডিট প্রক্রিয়ায় চার(৪)টি অংশ জড়িত থাকে। ক্রেডিট কার্ড কোম্পানী, ঋণদাতা, ক্রেডিট ব্যুরো এবং আপনি। ক্রেডিট কোম্পানীগুলি আপনার ক্রেডিট ইতিহাস পাঠায় ব্যুরোর কাছে, ব্যুরো রিপোর্ট তৈরী করে। মর্টগেজ ক্রেডিটর সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে আপনার ক্রেডিট যোগ্যতা নির্ধারণ কওরে, সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয়।

নিয়মিত আপনার রিপোর্ট বিস্তারিতভাবে পড়তে হবে।  আমরা বেশীরভাগ শুধু স্কোর দেখে ক্ষান্ত থাকি। আজ আপনার ভালো স্কোর থাকতে পারে, কিন্তু আপনি যদি না বুঝেন কিভাবে আপনার স্কোর ভালো আছে, তাহলে ভবিষ্যতে আপনার অজান্তে স্কোর খারাপ হয়ে যেতে পারে।

তাই ঋণের সুব্যবস্থাপনায় ভালো ক্রেডিট স্কোর আপনার উপকারী বন্ধু। কিন্তু নির্দেশিত নিয়ম না মেনে চললে সেই বন্ধুই একদিন আপনার চরম শত্রু হয়ে যাবে।  

– ফাতেমা বেগম, মটগেজ এক্সপার্ট।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Comments are closed.