জন্মশতবর্ষের পথে শেখ মুজিব : ইতিহাসের পুনর্পাঠ

জন্মশতবর্ষের পথে শেখ মুজিব : ইতিহাসের পুনর্পাঠ

মোনায়েম সরকার: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)। তাঁর নেতৃত্বেই পরাধীন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তিনি বহুবার তার ভাষণে এবং লেখায় এ কথা ব্যক্ত করেন। দীর্ঘদিন জনমত গঠন করে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু কিংবদন্তি জননেতা। তার প্রতিটি কর্মই বাঙালির জন্য অনুসরণীয়। বাঙালিকে তিনি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তার ভাষণ-বিবৃতির প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা এই সত্যের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। ২০২০ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপিত হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ঘিরে দেশে এবং দেশের বাইরে নানামুখি কর্মকা- সংঘটিত হবে। এসব কর্মকা-ে বঙ্গবন্ধুর কীর্তিগাথা বিশ্ববাসী জানতে পারবে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বেও বাংলাদেশ সেভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু নিন্দুক মানুষ এখনও বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বানোয়াট কথা বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তাদের কল্পিত মিথ্যাচারের জন্যই আজ ইতিহাসের পুনর্পাঠ জরুরি।

১৯৫৪ সাল। শেখ মুজিব তখন ৩৪ বছরের যুবক। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে শেখ মুজিব প্রার্থী হলেন ওয়াহিদুজ্জামানের বিপক্ষে। সে সময় গোপালগঞ্জের মোট ভোট ছিল ৬২,৫৬৯, তখন মহিলা ভোটাররা ভোট দিতেন না। প্রদত্ত ভোট ২৯,১৮৭। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী শেখ মুজিবুর রহমান পান ১৯,৩৬২ ভোট, মুসলিম লীগ প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান পান ৯,৫৬৯ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ শামসুদ্দিন পান ৫৫৬ ভোট। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কিভাবে শেখ মুজিব গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন তার চমৎকার বিবরণ আছে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। যারা শেখ মুজিবের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাদের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ার অনুরোধ জানাই।

১৯৭০ সালের নির্বাচন নিয়েও তৎকালীন নেতৃবৃন্দের মনে নানা দ্বিধা ছিল। শেখ মুজিব ও তার দল সেই নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনই স্বাধীন বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। এরপর যদি আমরা ১৯৭১ সালের প্রসঙ্গে আসি, তাহলে দেখবো, বাংলার প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে প্রস্তুত হয়েছিল। সেই সময়ের স্লোগানগুলোর প্রতি মনোযোগী হলেই এ কথার সত্যতা মিলবে। 

আমি একদিন নিজ চোখে দেখেছি শেখ মুজিব কাকরাইলে মানিক মিয়ার বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। তাঁর দেখা হয় পাঁচ থেকে দশ বছরের শিশু মোর্চার সঙ্গে। তারা পাটকাঠির মাথায় লাল কাগজ বেঁধে নিশান বানিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে ঘুরছে আর বলছে, ‘তোমার নেতা, আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’ ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’

আশার পতাকাকে কেউ নিশ্চিহ্ন করতে পারে না। আর তাই অযুত জনতা ’৬৯-এর গণআন্দোলনের মাধ্যমে ফাঁসির মঞ্চ থেকে ছিনিয়ে এসেছিল তাদের জীবন আর সংগ্রামের প্রতীক শেখ মুজিবকে। সেই সংগ্রামের জীবন্ত সাক্ষী আমি। ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিল যাচ্ছিল ক্যান্টনমেন্টের দিকে। তৎকালীন পাক মটরে বর্তমানে বাংলা মটরের সামনে আমরা যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম তারা হাত ধরে ব্যারিকেট করে মিছিল ইস্কাটনের দিকে নিয়ে যেতে চাইলাম। সংগ্রামী জনতা আমাদের মারতে শুরু করলো। তারা বললো এখনই ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনবে। আমিসহ কয়েকজন আহত হলাম, তবে মিছিল ইস্কাটনের দিকে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হলাম। কারণ আমরা জনতাম এবং দেখলাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা এয়ারপোর্টের বারান্দায় মেশিনগান তাক করে আছে। এমতাবস্থায় পাকিস্তানিরা ভয়ে শেখ মুজিবকে তার বাসায় রেখে গেল। মুহূর্তে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো, জনতা ৩২ নম্বর ধানমন্ডির দিকে ছুটলেন।

এখানে ইতিহাসের আরেকটি কথা না বললেই নয়, এরশাদের শাসনকালে ১৯৮৩ সালে আমাদের ১৫ দলের ৩৪ জন নেতাকে চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের জেলে, সেখান থেকে ১৭ দিন পর কেন্দ্রীয় কারাগারে। আমরা ছিলাম ভিআইপি প্রিজনার, তাই বিশ সেলে রাখা হয়েছিল। একদিন রাতে একজন সিপাহী বললো পাশেই দেওয়ানী। সেই দেওয়ানী ফটকে থাকতেন শেখ সাহেব। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন তাঁকে জড়িয়ে দিল, তখন এখান থেকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এসে রাতের অন্ধকারে জেলের সব বন্দি যখন তালাবদ্ধ, তখন তাকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টে। এই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৮ সালে। সে বললো যে-সিপাহীদের পাহারায় রেখেছিল জেল কর্তৃপক্ষ, সেও ছিল তাদের মধ্যে। ক্যান্টনমেন্টে যখন যেতেই হবে তখন আর বাধা না দিয়ে শেখ সাহেব বেরিয়ে এলেন দেওয়ানী ফটকের বারান্দা থেকে। সামনের মাঠ থেকে এক মুঠো মাটি তিনি হাতে তুলে নিলেন। মনে হচ্ছিল যেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে বাংলার ক্ষুদিরাম আবার হাসতে হাসতে অগ্রসর হচ্ছেন। এক মুঠো মাটি তুলে কপালে ঠেকিয়ে যেন বললেন : বাংলা মা আমার। আমি তোমায় ভালোবাসি। তারপর আমাদের জড়িয়ে ধরে বললেন : ‘যাই ভাই। তোমরা আমায় দোয়া করো।’ আরেকদিন রাতে ওই সিপাহী বলেন, জাতীয় চার নেতার হত্যাকা-ের সময়ও আমি সেদিন জেলখানায় পাহারায় ছিলাম। তাজউদ্দিন সাহেব পানি-পানি বলে চিৎকার করছিলেন, পরে তাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

কেউ কেউ বলেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি, কেউ বলেন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ চাননি। কেউ বলেন তিনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কেউ বলে তিনি পতাকা উড়াননি। আবার কেউ বলেন তিনি পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। এসবের জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এর জবাব একটি। ২৬ মার্চ রাতে রেডিও মারফত ইয়াহিয়া সাহেব যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে শুধু একটি নামই উচ্চারিত হয়েছিল শেখ মুজিব। ‘মুজিব, ইজ এ ট্রেইটর টু দ্য নেশন, দিজ টাইম হি উইল নট গো আনপানিসড।’ দেশবাসী জিজ্ঞাসা করুন তাদেরকে যে মানুষ কিছুই করলো না, বাংলাদেশ চাইলো না, পতাকা উড়ালো না, তাঁর উপর পাকিস্তানিদের কেন এত রাগ? তাহলে আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মুজিব বর্ষ পালিত হচ্ছে কেন? ফিলিস্তিনে কেন শেখ মুজিবের নামে সড়ক হচ্ছে?

বঙ্গবন্ধু মাত্র ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কেবল পাকিস্তান আমলেই ১৮ বার কারারুদ্ধ হয়ে ১২ বছর জেলে কাটিয়েছেন। ২৪টি মামলা তিনি সাহসের সঙ্গে লড়েছেন এবং দুইবার মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসায় ফিরে এসেছেন। তিনিই প্রথম নেতা যিনি মাতৃভাষায় প্রথম জাতিসংঘে ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষার মুখ উজ্জ্বল করেন। পৃথিবীর আর কোনো নেতা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ছাড়া তার স্বভাষায় জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছেন কিনা সে ইতিহাস আমাদের অজানা।

বাংলা ভাষার সম্মানে পৃথিবীব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হচ্ছে।  বাঙালি হিসেবে এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এমন কি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন সেটাও আজ ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বঐতিহ্যের অংশীদার। এরপরেও কি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমাদের ভুল ভাঙবে না।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশবিরোধী চক্র। এর পেছনে ছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৭৯ দিন পর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর জাতীয় চার নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপটেন এম. মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকেও নির্মমভাবে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক কথিত ‘সূর্য সন্তানেরা’। আজ বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে না থাকলেও তার আদর্শ আছে, আছে তার কীর্তি ও কর্ম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর কর্মই আমাদের পথ দেখাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,

“ওই মহামানব আসে;/দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।/ সুরলোকে বেজে উঠে শঙ্খ,/ নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক/ এল মহাজন্মের লগ্ন।”

উপরিউক্ত পঙ্ক্তিগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন বলেছিলেন জানি না, তবে আজ মনে হচ্ছে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করেই যেন কথাগুলো বলা হয়েছে। অনেকেই এখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করছেন, বড় বড় গ্রন্থ লিখছেন। ইতোমধ্যে আমার কাছেও দশজন এসেছেন বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে। শুধু লেখক-গবেষকই নন এক সময় যারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, আজ তারাও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধায়নত হচ্ছেন। এসব সুযোগসন্ধানী লেখক-গবেষকদের উদ্দেশ্যে বলতে হচ্ছে করে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরে তো এদের দেখা যায়নি। ১৯৭৯ সালে প্রফেসর মতিন চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা যখন বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করি তখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাও নিষিদ্ধ ছিল। সেই সময়ে যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে জেল, জুলুম, নির্যাতন সয়েছি, তারাও বিস্মিত হচ্ছি দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর নব জাগরণ দেখে। নেতাজি সুভাষ বসুর নামে ‘বিড়ি’ বের হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নামে যেন ওরকম কিছু না হয় সে বিষয়ে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। আজ বাঙালি শ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধুর নামে সমগ্র বিশ্বে ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে। আবহমান কালের প্রবাহমান মানুষ তার নামে উদ্দীপ্ত হবে অনুপ্রাণিত হবে, অনুরণিত হবে, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট                                                    

২৭ জুলাই, ২০১৯

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.