গুঞ্জরণটা শোনা যাচ্ছিলো অনেক আগে থেকেই। তবে এটাই যে পরিশেষে বাস্তবে রূপ নেবে সেটা ভাবেনি অনেকেই। বিশেষ করে নিজেকে আড়াল করে রাখা একজন নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যকর্মী হঠাৎ করেই স্বীয় কর্মের আলোকমালায় এভাবে উদ্ধাসিত হয়ে উঠবেন সেটাই এখানে মুখ্য।
যাকে নিয়ে ওপরের ছোট্ট ভূমিকাটা তিনি হচ্ছেন কানাডার ছোটগল্পকার এলিস অ্যান মুনরো। জয় করলেন এ বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সেক্রেটারি পিতর এংলুন্দ স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় সারা বিশ্ব থেকে জড়ো হওয়া হলভর্তি সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে ৩০ সেকেন্ডেরও কম সময় ঘোষণা করলেন ২০১৩ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীর নাম। যদিও সময়ের এ স্বল্পতা নিয়ে বইছে বিতর্কের ঝড়।
নোবেল ইতিহাসে এত কম সময় নিয়ে ঘোষণা এই প্রথম, যা সারা বিশ্বকে করেছে অবাক, সেই সঙ্গে হতাশও। প্রথামতো সংবাদ সম্মেলন থেকে সরাসরি ফোন করা হলো নোবেল বিজয়ী এলিস মুনরোকে; কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল অটোমেটিক অ্যান্সারিং মেশিনের আওয়াজ। আবারো ইতিহাস- অ্যান্সারিং মেশিনেই এ বছরের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তাঁর নোবেল বিজয়ের সংবাদ জেনে নিলেন।
কানাডার সময় ভোর ৪টায় নোবেল কমিটির স্থায়ী সেক্রেটারি দরজা খুলে হলভর্তি সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা করেন বিজয়ীর নাম। এলিস মুনরো ঘুমাচ্ছিলেন তখন। তাঁর মেয়ে তখন ফোন করে এলিসকে জাগিয়ে দিয়ে চিৎকার করে জানালেন, ‘মা, তুমি নোবেল বিজয়ী হয়েছ।’ কিছুক্ষণ পর কানাডার রেডিও সিবিসিকে তিনি বলেন, তিনি পুরো ব্যাপারটিই ভুলে বসেছিলেন; তিনি তাঁর বিজয়ী হওয়ার বিষয়টিকে ‘চমৎকার’ অভিহিত করেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই যখন সিবিসি রেডিওর সাংবাদিক তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি হচ্ছেন নোবেল ইতিহাসে ১৩তম নারী সাহিত্যিক, তখন মুনরো বিরক্ত এবং কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘এটা কি সম্ভব? এটা খুবই ভয়ংকর- আমরা মাত্র ১৩ জন।’
এলিস মনরোর সেই লেখনীর দ্যুতি ৪৫ বছর জুড়ে মানুষের মাঝে বিস্তৃত। অথচ তিনি ৩৭ বছর বয়স অবধি তা গুপ্তই রাখেন। নির্জন-নিভৃত গ্রামতুল্য উইংহামে জীবন কাটিয়ে একাগ্রমনে লিখে গেছেন। তার গল্পগুলো একই মূলভাবকে ধারন করে এবং পাঠকের কাছে অতি পরিচিত চরিত্রকেই হরেক রকম চমকে উন্মোচিত করেছে।
তার প্রথম প্রকাশিত গল্পগুচ্ছ ‘ডান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস’ ১৯৬৮ সালে গভর্নর জেনারেলের সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করে। একইভাবে ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে অনুরূপ পুরস্কারটি অর্জন করে যথাক্রমে ‘হু ডু ইউ থিঙ্ক ইউ আর?’ এবং ‘দ্য প্রগ্রেস অব লাভ’। এভাবে ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে কানাডার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত গিলার প্রাইজ অর্জন করে ‘দ্য লাভ অব এ গুড ওমেন’ ও ‘রানাওয়ে’।
তবে নোবেল জয়ের পর কানাডিয়ান বার্তা সংস্থা সিপি-কে এলিস মনরো তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমি জানতাম আমাকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে, কিন্তু পুরস্কারটা আমারই ভাগ্যে জুটবে জানা ছিল না’।
এলিস মনরো’র সাহিত্যকর্মের চমৎকারিত্ব হচ্ছে গল্পের নিপুণতা, গভীরতা ও প্রজ্ঞা – যা প্রত্যেক জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকই বাস্তবে তুলে ধরেন, মনে হবে যা কখনো কেউ বলেনি। কানাডায় তার গল্পগুচ্ছ ‘প্যারেনিয়াল’ বা দীর্ঘস্থায়ী ‘বেস্ট সেলার’। অনেকে তাই বলছেন – ‘সাহিত্যে এই নোবেল জয় তাকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করে তুলবে; তিনি এখন কানাডিয়ান আইকন’।
তার অপরাপর বইগুলো হচ্ছে – ১৯৭১: লিভস অব গার্লস অ্যান্ড ওমেন; ১৯৭৪: সামথিং আই হ্যাভ বিন মিনিং টু টেল ইউ; ১৯৮২: দ্য মুনস অব জুপিটার, ১৯৯০: ফ্রেন্ড অব মাই ইয়ুথ; ১৯৯৪: ওপেন সিক্রেটস; ১৯৯৮: দ্য লাভ অব এ গুড ওমেন; ২০০১: হেইটশীপ, ফ্রেন্ডশীপ, কোর্টশীপ, লাভশীপ, ম্যারেজ; ২০০৬: দ্য ভিউ ফ্রম ক্যাসেল রক; ২০০৯: টু মাচ হ্যাপিনেস এবং ২০১২: ডিয়ার লাইফ।
কানাডার অন্টারিও প্রদেশের উইংহ্যামে জন্ম তাঁর। মা ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা এবং বাবা ছিলেন শেয়াল ও বেজি পালক। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে মুনরো ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজম ও ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৫১ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় তাঁর পড়াশোনা আর এগোয়নি। স্বামীর সঙ্গে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি। সেখানে তাঁরা একটি বইয়ের দোকান খোলেন- মুনরো বুকস। এখনো দোকানটি চালু আছে।
মুনরো কৈশোরেই গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সুখী ছায়ার নৃত্য’ (দ্য ড্যান্স অব হ্যাপি শেডস) প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে, যা সে সময় কানাডার পাঠক মহলে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৫০ সাল থেকেই পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা গল্প প্রকাশিত হতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে তিনি তাঁর বিভিন্ন সময়ে লেখা গল্প নিয়ে প্রকাশ করেন গল্পসমগ্র- ‘নারী ও মেয়েদের জীবন’ (লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড উইমেন)। বইটিকে আগামী দিনের গল্পের রূপরেখা (বিল্ডাংস্রোমান) আখ্যা দেন সাহিত্য-সমালোচকরা।
মূলত এলিস মুনরো একজন ছোট গল্পকার। তাঁর স্বচ্ছতাঘেরা ছোটগল্পের জন্য সর্বাধিক প্রশংসিত। কিছু সমালোচক তাঁকে কানাডার চেখভ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বেশির ভাগ সময় তাঁর গল্পের আবহ নির্মিত হয়েছে ছোট ছোট শহরকে কেন্দ্র করে, যেখানে সমাজে গ্রহণযোগ্য অস্তিত্বের জন্য লড়াইয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নৈতিক-দ্বন্দ্ব এবং অনান্তরিক বিরোধাত্মক সমস্যায় জর্জরিত সম্পর্কের বলয় তৈরি হয়। তাঁর লেখায় চিত্রিত হয় দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি।
আগামী ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্টকহোমে এই বিজয়ীকে নোবেল সনদ, স্বর্ণপদক ছাড়াও প্রায় ১৫ লাখ মার্কিন ডলার দেওয়া হবে।
চিরদিন নিজেকে আড়াল করে রাখা এই কানাডিয়ান সাহিত্যিকের নোবেল প্রাপ্তি তাঁকে রাতারাতি পরিণত করেছে কানাডার আইকনে। তাঁকে আরো পরিপূর্ণভাবে বিশ্ব-সাহিত্যের পাঠকদেরও জানার সুযোগের দ্বার উন্মোচিত করে দিলো নোবেল পুরুস্কার।
-রেহানা আক্তার লুনা