বাংলা ও বাঙালির ভবিষ্যৎ

বাংলা ও বাঙালির ভবিষ্যৎ

মোনায়েম সরকার: বাঙালি সংকর-জাতি। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য হাজার হাজার বছর ধরে সবেগে বহমান। প্রাচীন ‘‘বঙ্গ’ জনপদের কথা ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে বর্ণিত হয়েছে। বহু দেশের সম্পদলোভী অধিবাসী বাংলায় এসে লুন্ঠন করেছে, বাঙালির সরলতা ও অতিথিপরায়ণ মনোবৃত্তির সুযোগ নিয়ে তারা বাংলাকে শাসনের নামে শোষণ করেছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বহিরাগতরা এসে তিনভাবে বাংলা ভূখণ্ডের সর্বনাশ করেছে। যথা- ১. তারা এদেশের সম্পদ লুট করেছে, ২. বাংলা ভাষা চিরতরে বাঙালির মুখ থেকে কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করেছে, ৩. বাঙালির হাজার বছরের সম্প্রীতি নষ্ট করে সাম্প্রদায়িক-দ্বন্দ্ব প্রকট করে তুলেছে।

আজও এই তিনটি সর্বনাশা কারণের শেষের দুটি বাঙালিকে তিল তিল করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ও বাঙালির দুর্ভাগ্যের কারণ হলো এদেশ ও দেশের মানুষ না খেয়ে মরে যেতে পারে কিন্তু কখনোই অন্যের সম্পদ কেড়ে খেতে জানে না। বাঙালি দীর্ঘকাল ধরেই শোষিত হয়েছে, কিন্তু বাঙালি কাউকে শোষণ করেছে বলে ইতিহাসে নজির নেই। শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতি শান্তির সঙ্গে বসবাস করতে চায় বলেই, অন্যের সুখ-শান্তির পথে কখনো বিঘ্ন হয় নাই। অথচ বাঙালির সুখ কেড়ে নিতে আজো অনেকেই সুযোগের অপেক্ষায় বসে আছে।

ভারতের সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। একদিন অখ- ভারতভূমিই ছিল বাংলা ও বাঙালির একমাত্র পরিচয়। কালে কালে ছোট ছোট রাজ্যে ভারত ভূমি বিভক্ত হলে, ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রাধান্য বিস্তার করে বসবাস করতে চেষ্টা করে। এর ফলে একেক অঞ্চল একেক ভাষা, মেজাজ ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হওয়ার চেষ্টা করে। বাংলা ও বাঙালিরাও কয়েকটি পাশাপাশি অঞ্চলে আধিপত্য গড়ে তোলে জীবনযাপনের চেষ্টা করে। পুরাতন ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, আর্যরা বাঙালিকে মানুষ বলে মর্যাদা দিতে চায়নি, বাঙালির ভাষাকে এরা ‘পাখির ভাষা’র সাথে তুলনা করেছে। বাঙালিকে মানুষ না-ভেবে ভেবেছে ‘রাক্ষস’, ‘অসুর’ প্রভৃতি।

আর্য-অনার্য লড়াই দীর্ঘদিন এই মাটিতে চলেছে। এখনো চলছে, তবে এর আকারে-প্রকারে ভিন্নতা রয়েছে। বৈদিক শাস্ত্র আর্যরাই প্রবর্তন করেন। আজ যারা বৈদিক শাস্ত্রের সমর্থক ও অনুসারী তাদের মধ্যে আবার আর্যরক্ত প্রবল হয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আবার তারা বাংলা ও বাঙালিকে কোণঠাসা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে বাঙালির, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমানেরা আশার আলো দেখতে পায়। বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫ সালে যেভাবে হয়েছিল এবং তাতে অবিভক্ত যেই বাংলাকে কল্পনা করা হয়েছিল তা দেখে ভারতবর্ষের হিন্দু নেতাদের হিংসায় জ্বলে উঠার কোনো কথাই ছিল না, অথচ আমরা বারবার লক্ষ্য করলাম ‘বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদ’ সহ্য না-করার স্লোগান দিয়ে ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হিন্দুরা একজোট হয়ে নানামুখী কার্যক্রম চালিয়ে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ মুসলমান অধ্যুষিত ‘বাংলা’ যেন কিছুতেই সাবলম্বী ও সবল হয়ে উঠতে না-পারে এজন্য বাঙালি হিন্দুদের ভেতরে এক রকমের ষড়যন্ত্র দীর্ঘকাল থেকেই চলছিল। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতবর্ষে বাঙালিকে বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদেরকে চিরতরে ধ্বংস করার গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। যারা ইতিহাসের ছাত্র কিংবা ইতিহাস সচেতন তারা জানেন, ভারতের হিন্দুরা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পুরো দোষ মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের নির্দোষ ও দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রকাশ করে থাকে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অখন্ড ভারতবর্ষ দ্বিখাণ্ডিত হলেও বাংলার ভাগ্য কখনোই বাংলার মুসলমানেরা নির্ধারণ করেননি, এটি দিল্লিতে বসেই হিন্দু নেতাদের নানামুখী ষড়যন্ত্রে ভাগ হয় এবং বাঙালি মুসলমানেরা একই সঙ্গে পাকিস্তান ও ভারতের উপনিবেশে পরিণত হয়।

১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা কখনোই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম-ত্রিপুরাকে বাংলার বাইরের কোনো ভূখণ্ড ভাবেননি। তারা ‘বাংলা’ বলতে পশ্চিম বঙ্গ, পূর্ব বঙ্গ, আসাম-ত্রিপুরাসহ বেশ কিছু ভূমি ও সেই ভূমির অধিবাসীদের বুঝেছিলেন। কিন্তু আমরা কি দেখলাম, বাঙালি হিন্দুরা গোপনে গোপনে একজোট হয়ে অখ- বাংলার বিরুদ্ধে মতামত ও ভোট দিয়ে বাংলাকে খ- করার হটকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুসলমান বাঙালিরা যারা পশ্চিম বঙ্গে ও পূর্ব বঙ্গে ছিলেন তারা চাননি অখ- বাংলা ও বাঙালি জাতি খণ্ডিত হোক, তারা যুক্ত বাংলা টিকিয়ে রাখতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হিন্দুদের প্রস্তাব জয়ী হয় এবং চিরদিনের জন্য বাঙালিরা বিভক্তির যাঁতাকলে আটকা পড়ে।

ভারতের ইতিহাসে বাঙালিদের দান অক্ষয় হয়ে থাকবে। এমন কি, বাংলা ভাষার মহিমাও কোনোদিনই বিস্মৃত হতে পারবে না বিশালাকার ভারতভূমি। ভারতবর্ষের যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন হোক তা ধর্মের কিংবা সামাজিক আন্দোলনের ফসল, তার অনেক ক্ষেত্রেই বাঙালিদের রয়েছে বিশাল অর্জন। বৃহৎ ভারতে অসংখ্য ভাষা আছে, আছে অসংখ্য জাতির বসবাস। এই অসংখ্য ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে একমাত্র বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) নোবেল পুরস্কার অর্জন করে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান। বাংলা-বাঙালি তথা ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন, সত্যজিৎ রায়ের (১৯২১-১৯৯২) কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করে বাঙালি পরিচালকই ভারতের জন্য অস্কার বিজয়ের বিরল সম্মান বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। যেই অর্মত্য সেন- অর্থনীতিতে নোবেল জয় করে পুরো পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিও একজন বিশিষ্ট বাঙালি।

বাংলা ও বাঙালিকে অবজ্ঞা করে কিছুতেই ভারতবর্ষের উন্নতি হতে পারে না। পূর্বে যতবার বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে, ততবারই বাঙালি রুখে দিয়েছে, কিন্তু সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিরাও যেন কেমনভাবে নিজেদের গুটিয়ে নিতে চাইছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের বাঙালিরা এই মনোভাব লালন করছে যে, বাংলাদেশের বাইরে হয়তো আর বাংলার অস্তিত্ব খুঁজেই পাওয়া যাবে না। ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ববাদী সরকার যেভাবে বাংলা-বিদ্বেষ ও হিন্দুয়ানি চাপিয়ে দিয়ে বাংলার বুক থেকে বাঙালিত্ব মুছে ফেলার নীলনকশা করেছেÑ তাতে মনে হচ্ছে কলকাতা তথা পশ্চিম বঙ্গ থেকেও বাংলা বিদায়ের ঘণ্টা বাজা শুরু হবে।

কলকাতা কোনো সাধারণ শহর নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বাধীন ভারতবর্ষের অসামান্য ঋণ। সুতানুটি, ডিহি কলকাতা ও গোবিন্দপুর- এই তিনটি গ্রাম নিয়েই কলকাতা শহরটি গড়ে ওঠে। ১৭শ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত এই গ্রামগুলির শাসন কর্তা ছিলেন মুঘল সম্রাটের অধীনস্থ বাংলার নবাবেরা। ১৬৯০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের কাছ থেকে বাংলার বাণিজ্য সনদ লাভ করে। এরপর কোম্পানির লোকেরা কলকাতায় একটি দুর্গবেষ্টিত বাণিজ্য কুঠি তৈরি করে। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজদ্দৌলা কলকাতা জয় করেছিলেন, কিন্তু পরের বছরই ১৭৫৭ সালে কোম্পানির লোকেরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কলকাতা আবার দখল করেন নেন। ব্রিটিশ রাজত্বের সময় ১৭৭৩ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা ভারতের রাজধানী ছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার বলা হয় কলকাতাকে। এই কলকাতা  মূলত বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা। এই এলাকা থেকে একই সঙ্গে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলার নবজাগরণ সূচিত হয়। রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা (১৮২৯) বাতিল থেকে শুরু করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিধবা বিবাহ আইন (১৮৪৬) পাশ করা পর্যন্ত এসব জীবনমুখী আন্দোলন ও সমাজসংস্কার যারা করেছেন, তারা প্রত্যেকেই ছিলেন বাঙালি সন্তান।

ভারতবাসীর মনে রাখা দরকার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যত মানুষ শহিদ হয়েছেন তার অর্ধেক বাঙালি। দিল্লির গেটে ৯২,৩২৬ জন বীর শহিদের নাম খোদিত আছে। সেখানে ৬০ হাজারের অধিক নামই মুসলমানদের। ভারত রাষ্ট্র স্বাধীন করার জন্য যে বাঙালিদের রয়েছে এতসব অবদান আজ সেই কলকাতা থেকে যখন বাংলাকে উচ্ছেদ করে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে, তি কি কখনোই মেনে নেবে পশ্চিম বঙ্গের মানুষ? কিছুতেই শিবসেনাদের উন্মাদনা মেনে নেওয়া ঠিক হবে না। ভারতের বাঙালিরা যদি বাঙালিত্ব মুছে ফেলে অন্য কোনো জাতিতে মিশে যেতে চায় সেটি একান্তই তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনেতিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চাপিয়ে দিয়ে বাঙালিকে ও বাংলাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হলে বাঙালিরা তা মেনে নেবে না।

বাঙালি জাতি কখনোই কারো কাছে মাথা নত করেনি। এ জাতির পিঠে অনেক জাতির চাবুকের আঘাত এখনো রক্তজবার মতো ফুটে আছে। তবু দুর্জয় বাঙালি সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সদর্পে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর। রাজনৈতিক কারণে বাঙালিকে ও বাংলা ভাষাকে বারবার হত্যা করার প্রবণতা অতীতেও আমরা দেখেছি, বর্তমানে দেখছি হয়তো ভবিষ্যতেও এসব ষড়যন্ত্র আরও দেখবো। কিন্তু এত কিছুর পরেও বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে বলে মনে হয় না। ভারতবর্ষ একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। সেখানে বাঙালিরা বসবাস করলেও ভারত বাঙালি রাষ্ট্র নয়। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যে রাষ্ট্র বাঙালিদের অধিকার বজায় রাখতে বদ্ধ পরিকর।

হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার যতই চেষ্টা করুক ভারতে বাংলা ও বাঙালিকে অবদমন করার, কিন্তু এটা তাদের মনে রাখা দরকার, বাঙালি জেগে উঠলে কেউ তাদের অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। একদিন ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের যে দাবি উঠেছিলÑ আবার যদি ভারতে জাতিবিদ্বেষের কারণে বিভিন্ন জাতি ও ভাষা-ভাষী মানুষের মধ্যে পৃথক পৃথক রাষ্ট্রগঠনের দাবি ওঠে সেদিন ভারতের কি অবস্থা হবে- ভেঙে ভেঙে তারা কত টুকরো হবে- সেটা ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব করা দরকার। আজ পৃথিবীতে ভাষা ভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রবণতা মানুষের মধ্যে প্রকট হচ্ছে। এই প্রবণতায় যদি হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধি ঘি-ঢেলে বিক্ষোভের আগুন আরো উসকে দেয়, তাহলে ভারতবাসীর জন্য তা হবে সর্বনাশের কারণ। বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলা ভাষার অবাধ বিচরণ ভূমি। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে- ততদিন বাঙালির ও বাংলা ভাষার বিনাশ সম্ভব নয়।  

বাংলা ভাষার প্রথম অসাম্প্রদায়িক কবি, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যকামী, স্বাধীনতা-সংগ্রামী কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেনÑ বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে-“‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা  অসাধ্য সাধন করবে। সেদিন একা বাঙালিই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে। বাঙালির মতো জ্ঞান-শক্তি ও প্রেম-শক্তি (ব্রেন সেন্টার ও হার্ট-সেন্টার) এশিয়ায় কেন, বুঝি পৃথিবীতে কোন জাতির নেই। … বাংলার মাটি নিত্য-উর্বর। এই মাটিতে নিত্য সোনা ফলে। এত ধান আর কোন দেশে ফলে না। পাট শুধু একা বাংলার। পৃথিবীর আর কোন দেশে পাট উৎপন্ন হয় না। এত ফুল, এত পাখি, এত গান, এত সুর, এত কুঞ্জ, এত ছায়া, এত মায়া আর কোথাও নেই। এত আনন্দ, এত হুল্লোড়, আত্মীয়তাবোধ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এত ধর্মবোধ, আল্লাহ, ভগবানের উপাসনা, উপবাস-উৎসব পৃথিবীর আর কোথাও নেই। … বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও :

     “এই পবিত্র বাংলাদেশ

          বাঙালির” আমাদের।

     দিয়া ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’

     তাড়াব আমরা, করি না ভয়

     যত পরদেশী দস্যু ডাকাত

          ‘রামা’দের ‘গামা’দের।”

বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।”

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের কথা সত্যি হয়ে আজ শুধু বাংলার আকাশে-বাতাসেই নয়, সারা পৃথিবীতেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁরই আন্দোলনের ফসল ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’কে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ পরিণত করেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে ইউনেস্কোসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ও বাংলাকে সম্মান জানানোর জন্য নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুভ মুহূর্তে বাঙালিদের জন্য এটাও এক বিরল সম্মানের বিষয় বলেই আমি মনে করি।

সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন পুরো পৃথিবীতে বাঙালি ও বাংলা ভাষাই প্রতিনিধিত্ব করবে, কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত যদি তার অভ্যন্তরে থাকা বাঙালিদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে এবং সেই কারণে যদি সমস্ত বাঙালি এক হয়ে এক বা একাধিক অসাম্প্রদায়িক, বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়- তখন ভারতের অবস্থা কী হবে তা একটু ভেবে দেখা উচিত।

ঘুমন্ত সিংহ ক্ষেপিয়ে তোলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বাঙালির সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, ইতিহাস-ঐতিহ্য বিলীন করার ষড়যন্ত্র থেকে যদি কোনো সাম্প্রদায়িক শাসকচক্র বিরত না থাকেন, তাহলে বাঙালির নতুন বিদ্রোহ, নতুন রাষ্ট্রগঠনের আয়োজন উপভোগ করার জন্য আমি তাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার সুপামর্শ রাখতে চাই। বাঙালি হার না-মানা লড়াকু জাতি, এটা পৃথিবীর সবারই মনে রাখা দরকার।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.