বিএনপি কি অবরুদ্ধ নাকি পরাজিত?

বিএনপি কি অবরুদ্ধ নাকি পরাজিত?

সৈয়দ জাহিদ হাসান: প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কারণে-অকারণে অভিযোগ উত্থাপন করা রাজনৈতিক দলের একটি কৌশল। এই কৌশল সবদেশের রাজনৈতিক দলের মধ্যেই কমবেশি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও প্রতিপক্ষ দলকে কোণঠাসা করার জন্য, জনগণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের রাজনৈতিক নাটক দৃশ্যমান। বর্তমানে এই নাটক আরো জমে উঠেছে বলেই মনে হয়। এর কারণ বিএনপির উপর সরকারি দলের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস মূলত দমনপীড়নের ইতিহাস। পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের উপর স্বৈরাচার পাকিস্তানি সরকার অকথ্য নির্যাতন ও অত্যাচার চালিয়েছে। সেই অত্যাচার-নির্যাতনের হাত থেকে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও বাদ যাননি। পাকিস্তানিরা বাঙালি রাজনীতিবিদদের জেল-জুলুম-হত্যা নির্যাতন করে বারবার বাঙালি রাজনীতিকদের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তান আমলে কারাবরণ করেননি এমন বাঙালি রাজনীতিক খুঁজে পাওয়াই যায় না।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বাংলাদেশকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে সোনার বাংলা গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর সেই স্বপ্ন পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি সপরিবারে ঘাতক কর্তৃক নিহত হন।  দেড় দশক দেশ চালায় অনির্বাচিত, জবরদখলকারী সরকার। অনির্বাচিত সরকারের আমলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। ওই সময় আওয়ামী লীগ বিরোধীরা ভিন্ন প্লাটফর্ম গড়ে তোলে আওয়ামী লীগকে পরাস্ত করার জন্য। সেই ধারা এখনও বাংলাদেশে চলমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূলত দুই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, এক. আওয়ামী লীগ ঘরানা, দুই. আওয়ামী লীগ-বিরোধী ঘরানা। এই দুই ঘরানার বাইরে আর যে রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে তার নাম সুবিধাভোগী ঘরানা। এই সুবিধাভোগীরা সুবিধা নেওয়ার জন্য কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ঘরানায় গিয়ে নির্লজ্জের মতো হাত পাতে। এই ধারা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ প্রবল হয়েছে। সুবিধাভোগী রাজনৈতিক ধারা পেশাদার রাজনৈতিক ধারাকে সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত করে, এখনো করছে। দেশ ও জাতির প্রতি তাদের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, এরা প্রকৃত অর্থেই পেটসর্বস্ব।

বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল (বিএনপি) বর্তমানে দিশেহারার মতো আচরণ  করছে। তাদের আচরণে রাজনৈতিক তৎপরতার চেয়ে সরকারের কাছে দয়া প্রার্থনাই আজকাল বড় হয়ে উঠছে। তাদের দলের প্রধান প্রধান নেতা-নেত্রীর বিবৃতি শুনলে মনে হয় বিএনপিকে বাঁচিয়ে রাখার দায় এখন আওয়ামী লীগের উপরেই। যতই দিন যাচ্ছে ততই বিএনপির জীর্ণ, শীর্ণ, দরিদ্র চেহারা বাংলাদেশের মানুষ অবলোকন করছে। এর কারণ কি? কারণটা মূলত বিএনপির জন্মের সঙ্গেই জড়িত। জিয়াউর রহমান বিএনপি যখন গঠন করেন, তখন তিনি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন না, তার দলে যারা এসে ভিড়ে ছিলেন তারাও রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ ছিলেন না। শত শত সুবিধাভোগীকে নিয়ে জিয়াউর রহমান তার বিএনপি নামক ‘যৌগ দল’ (মিক্সড পার্টি) গঠন করেছিলেন। জিয়ার পরে খালেদা জিয়াও সেই ধারা অব্যাহত রাখেন। খালেদা জিয়ার চেয়ে তার পুত্র তারেক জিয়া আরো এক ডিগ্রি উপরে উঠে গেলেন দুর্বৃত্তপনা আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে। সীমাহীন দুর্নীতি এবং শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য মরিয়া তারেক জিয়া ভেবেছিলেন, বাংলাদেশে তার আসন চিরস্থায়ী। কেউ তাকে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারবে না। একদিন তিনি ক্ষমতায় থেকে যে অলৌকিক অযৌক্তিক, উদ্ধত স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন এখন শুধু তারেক জিয়াকেই নয়, বিএনপিকেও ডুবিয়ে মারছে।

পৃথিবীর সবদেশেই বিরোধী পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে ক্ষমতাসীন সরকার। এই চেষ্টা যে যত সূক্ষ্মভাবে করতে পারে সে তত সফল হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অ্যান্টি আওয়ামী লীগ যারা আছেন, তারাও এখন সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করছেন (সুবিধাভোগীদের কথা না হয় বাদই দিলাম)। এর প্রমাণ হিসেবে বিগত ইউপি নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের ইউপি নির্বাচনে বিএনপির কোমর ভেঙ্গে গেছে।  ইউনিয়ন পর্যায়ে বিএনপি এতটাই বেহাল যে তাকে সুস্থ করা অনেকটাই অসম্ভব। শুধু বিভাগীয় শহরের শক্তি দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল টিকে থাকতে পারে না, এ জন্য দরকার গ্রামীণ জনতার দুর্বার শক্তি। গ্রামীণ পর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সকলেই এখন (দুই-একজন বাদে) নৌকার মাঝি বা দাঁড়ী হতে ব্যস্ত। সুবিধাভোগীদের দিয়ে জিয়া একদিন বিএনপি গড়েছিলেন, আজ সুবিধাভোগীরাই বিএনপিকে ডুবাচ্ছে। বালির বাঁধ সামান্য জোয়ারেই ভেঙ্গে যায়, জলোচ্ছ্বাস কি তা মানিয়ে রাখতে পারে?

আজ বিএনপি মাঠে-ঘাটে কোথাও নেই। এমনকি চায়ের কাপের আলোচনা থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির কর্মীরাও এখন উপলব্ধি করছে শেখ হাসিনা যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, উন্নয়ন করছে, দেশ এভাবেই চলুক। উন্নত হোক বাংলাদেশ। কি কারণে যেন সবাই মনে করছে আগামী নির্বাচনেও (২০১৮) আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহণ বাংলাদেশের কোনো দলের পক্ষেই ঠেকানা সম্ভব নয়, ঠেকিয়ে কোনো লাভও নেই। জনগণ এখন আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে এমনভাবে নিয়েছে যে, এদের হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ। ক্ষমতার পালাবদল মানে আবারও রক্তপাত, হরতাল, বোমাবাজি, সন্ত্রাস। সুতরাং যারা আছে তারাই ভালো। আম-জনতার এই রকম মনোভঙ্গি বিএনপির জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। এজন্যই রাজপথে বিএনপির মিছিল কর্মীশূন্য, খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে ও থাকতে হয় নিরুপায় হয়ে, দলীয় নেতারা শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেই রাজনীতিতে ব্যস্ত।

খালেদা জিয়ার জেলবন্দী জীবন আজ বাংলাদেশের মানুষকে একটি মেসেজই দিচ্ছে সেটি হলো, বিএনপি অবরুদ্ধ নয়, রাজনৈতিকভাবে পরাজিত। জেল-জুলুম-মৃত্যু- তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির অন্যতম শর্ত। যারা রাজনীতি করবেন তাদের এসব মেনেই রাজনীতি করতে হয়। সরকারবিরোধী শক্তিকে ষড়যন্ত্র করার সুযোগ দিবেন, ভাঙচুর করার অধিকার দেবেন, যাচ্ছে তাই বলার ও করার স্বাধীনতা দিবেন- এমনটা ভাবা আসলেই কি রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা নয়? রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করা উচিত। শক্তিহীন, দুর্বল, মুমূর্ষু বিএনপির পক্ষে এখন কিছুতেই আওয়ামী লীগের শক্তিকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ বহুবার রাজপথে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে বিএনপিকে নাজেহাল করেছে, এমনকি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয়ী বিএনপিকে টেনে হিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছে। রাজপথে আওয়ামী লীগের শক্তি প্রদর্শন নতুন কিছু নয়। জেল-জুলুম-গুলি-মৃত্যু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভয় পায় না, কিন্তু বিএনপির আরামপ্রিয় সুবিধাবাভোগী নেতাকর্মীরা ভয় পায়। তারেক জিয়া ভেবেছিলো, জঙ্গি উত্থানে মদদ দিয়ে, প্রতিপক্ষকে বিনাশ করে চিরদিন বিএনপি বাংলাদেশ শাসন করবে, কিন্তু বিধি বাম। রাজনৈতিকভাবে পরাজিত বিএনপি এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বৃত্ত থেকে এতটাই দূরে সরে গেছে যে, তার সসম্মান প্রত্যাবর্তন এখন অনেকটাই দুরাশা। মানসিক দেন্য পরিহার করে, সাংগঠনিক শক্তিকে নতুনভাবে বিন্যাস করে, জামায়াতপ্রীতি বাদ দিয়ে ফের যদি বিএনপি সংগঠিত না-হয়, তাহলে বিএনপি অদূর ভবিষতে আওয়ামী লীগের পেটে চালান হয়ে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতি সেই কথারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।   

লেখক : কবি ও কথাশিল্পী।

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.