১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রম বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে বর্বর পাক বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়ার এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে অতি বিরল। এ স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালীকে হারাতে হয়েছে ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণ, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম আর অপরিমিত ধন সম্পদ। তবু এক বুক রক্তের বিনিময়ে বাঙালী পেয়েছে রক্তিম স্বাধীনতা। তাই বাংলার মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর নির্যাতিত ও পরাধীনতার গ্লানিতে দগ্ধ মুক্তিপাগল মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে।
নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত হয়ে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের আবির্ভাব। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে ১৯৭১ সালে বাংলার দামাল ছেলেরা ঝাপিয়ে পড়েছিল দেশমার্তৃকাকে শক্রুমুক্ত করতে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে লাখো বাঙালী আত্মহুতি দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি। ৩০ লাখ বাঙালীর তাজা রক্ত আর অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বর্তমান প্রজন্ম সেভাবে সফল হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে জাতির জনককে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুনরায় পরনির্ভর করার যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল তা অব্যাহত রয়েছে এখনও! মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদররা পদে পদে সে অপতৎপরতাই চালাচ্ছে। তবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় জনগণ আশাবাদী। বিগত নির্বাচনে দেশের জনগণ বিপুল রায় দিয়ে আস্থা রেখেছে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ওপর। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশে মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। যে কারণে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্তরালে থেকে যাওয়া এলাকার জনগণ স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে যে তাদের মূল্যায়ন হবে। এটা ধ্রুব সত্য যে, স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরিয়ে গেলেও জাতি হিসেবে আমরা কাঙ্খিত লক্ষ্যে নোঙর ফেলতে পারিনি। এর অন্যতম মূল কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত মূল্যায়ন না হওয়া এবং দুর্নীতির কালো ছায়া। এখনও অনেক নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকা আছে স্বাধীনতা যুদ্ধে যাদের অবদান অসামান্য। খবরের অন্তরালে থাকা তেমনই এক জনপদ নিয়ে এই প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার রয়েছে গৌরবময় অবদান। মেহেরপুরের আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন এর উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ১৯৭১ সালে কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষও ঝাপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। তেমনি এক জনপদ ঐতিহ্যবাহী দুর্বাচারা। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামের যুবকেরা দেশমাত্রিকার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, চার দশক পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের অম্লান স্মৃতি বহনকারী এলাকাটি এখনও প্রচারের বাইরেই রয়ে গেছে! সরেজমিন এলাকা পরিদর্শন করে ওই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ও প্রবীণদের কাছ থেকে জানা গেছে অনেক অজানা তথ্য। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কুষ্টিয়ার বংশীতলা যুদ্ধ ছিল অন্যতম। যুদ্ধস্থান হওয়ায় সবসময় বংশীতলা আলোচিত হয়েছে বেশি। কিন্তু এর পেছনে ছিল দুর্বাচারা অঞ্চলের যুবকদের অবিস্মরণীয় কীর্তি। মূলত ওই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ যোদ্ধাদের নিয়েই বংশীতলা যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সে সময় বংশীতলা যুদ্ধের সমস্ত কর্মকা- পরিচালিত হয়েছে দুর্বাচারা থেকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ সেপ্টেম্বর পাক সেনারা ভাদালিয়া রোডের বংশীতলা মোড়ে অবস্থান নিলে দুর্বাচারা থেকে পাল্টা আক্রমণে যায় মুক্তিসেনারা। ওই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কমা-ার ছিলেন মির্জা জিয়াউল বারী নোমান। এছাড়া বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক জাহিদ হোসেন জাফর, আবুল কাশেম ও সামসুদ্দিন আহমেদ। বংশীতলা যুদ্ধে যোদ্ধাদের সার্বিকভাবে সহযোগীতা করেছিলেন দুর্বাচারা গ্রামের ছলিম উদ্দিন বিশ্বাস ও তার পরিবার। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও নিরাপদ বাসস্থানের পূর্ণ নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করেছিলেন ছলিম পরিবার। ওই যুদ্ধে ১১ জন শহীদ হয় এবং ২০/২৫ জন আহত হয়। নিহতদের পাঁচজনকে দুর্বাচারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দাফন করা হয় এবং বাকিদের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে সমাহিত করা হয়। এরমধ্যে একজনকে সমাহিত করা হয় কমলাপুর ফুটবল মাঠের পাশে। ৫ সেপ্টেম্বরের ওই যুদ্ধে ১১ জন শহীদ হলেও দুর্বাচারায় ছয়জনকে পাশাপাশি সমাহিত করা হয়। তারা হলেনÑতাজুল ইসলাম, দিদার আলী (বীর প্রতীক), ইয়াকুব আলী, সাবান আলী, আব্দুল মান্নান ও শহিদুল ইসলাম। বাকিদের বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় দাফন করা হয়। বংশীতলা যুদ্ধে পাক বাহিনীর সদস্যের মৃত্যুর খবর আন্তর্জাতিক বেতার বিবিসি এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকায় বংশীতলা যুদ্ধের উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেনÑশহীদ তাজুল ইসলাম, শহীদ শহীদুল ইসলাম, মুন্সী আব্দুর রাজ্জাক, সাবু-বিন-ইসলাম, মোঃ আশরাফুল আলম (নাসির মাস্টার), নাজিম উদ্দিন শেখ, বাজর আলী মল্লিক, আব্দুল ওয়াহেদ কটা, জিয়াউল বারী নোমান, সামসুল হাদী, শহীদ দিদার আলী, খায়রুল ইসলাম বাবু, বদর উদ্দিন, ছলিম উদ্দিন বিশ্বাস, আঃ মান্নান, মানিক কুমার ঘোষ, মহসিন ম-ল, শামসুদ্দিন শেখ, ইউসুফ আলী, উজির আলী, নূর মোহাম্মদ জাপান, আব্দুল হামিদ, তাইজাল আলী খান প্রমুখ।
শহিদুল ইসলাম শহীদ হন ৬ ডিসেম্বর করিমপুর যুদ্ধে। বংশীতলা যুদ্ধের পর বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে করিমপুরে আরেক যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ওই যুদ্ধেও মুক্তিবাহিনী দুর্বাচারা থেকে তাদের মিশন শুরু করে। মুখোমুখি ওই যুদ্ধে শহীদ হন তৎকালীন রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ার্স কলেজের মেধাবী ছাত্র শহীদুল ইসলাম। তাকেও পরে দুর্বাচারা পাঁচ শহীদের পাশে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে এমন অবদান রাখা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো আজ অবহেলার স্বীকার। সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী আক্ষেপ করে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার পরও আমাদের এখানে তেমন কিছুই হয়নি। এখানে কখনোই তেমন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। দুর্বাচারায় কোনরকমে ছয়টি কবর ইট দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। বংশীতলা ও করিমপুরে দু’টি নামফলক টানানো রয়েছে। বিশেষ করে দুর্বাচারার সর্বস্তরের জনগণ, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের আক্ষেপ যেন কেউ দেখার নেই।
করিমপুর যুদ্ধে শহীদ হওয়া শহীদুল ইসলাম ছিলেন অত্র এলাকার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। তৎকালীন সময়ে রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ার্স কলেজে ইলেকট্রিক্যাল তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। বর্তমানে যা রাজশাহী প্রোকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) নামে পরিচিত। উজানগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম ছলিম উদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে শহীদুল ছিলেন অতি মেধাবী একজন ছাত্র। ওই সময়ে এএসসি ও এইচএসি উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নে পাড়ি জমান রাজশাহী। কিন্তু দেশমাতৃকার প্রয়োজনে কলম ছেড়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেন দেশপ্রেমের হাতিয়ার। ৬ ডিসেম্বর অকুতভয় এ বীর সন্তান পাক হানাদারদের নিশৃংসতার শিকার হন। এ ব্যাপারে বলতে গিয়ে শহীদুল ইসলামের ছোট ভাই, সহযোদ্ধা ও উজানগ্রাম ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান সাবু-বিন-ইসলাম অশ্রুসজল কণ্ঠে বলেন, ‘এই কষ্ট ভোলার নয়। আমার সামনে ভাইকে গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। আর আমাকে আটক করে বিত্তিপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে যায়। শহীদ ভাইকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমার বাবার। তার ইচ্ছা ছিল, নামী ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে শহীদ। ভাইয়ার মেধার কথা সবাই জানত। রাজশাহীতে ভাইয়ার ব্যাজে সবচাইতে মেধাবী ছিলেন তিনি। যে কারণে শহীদ হওয়ার পর ভাইয়ার নামে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের নামকরণ করা হয়।’ অর্থাৎ বর্তমান রুয়েট ক্যাম্পাসের শহীদুল ইসলাম হল। মুক্তিযোদ্ধা সাবু-বিন-ইসলাম হতাশা আর ক্রোধের সুরে আরও বলেন, ‘আমরা নিঃশার্তভাবে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। কিন্তু এখন আমাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই! অন্যান্য কিছুর ন্যায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা আজ বঞ্চিত আর অপমাণিত। মনে অনেক ব্যথা, কষ্ট। এ অবস্থা দেখার জন্য যুদ্ধ করিনি। ভন্ড মুক্তিযোদ্ধারের ভীড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এতটাই অসহায় যে, এখন আর আমি মুক্তিযোদ্ধাদের কোন অনুষ্ঠানে যায় না। কারণ নিজেরই লজ্জা লাগে, ঘৃণা হয়।’ বীর এ মুক্তিযোদ্ধার নিজের জন্য কিছুই চাওয়া নেই। তবে তিনি এখনও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, দুর্বাচারায় ছয়জন শহীদের কবরের স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হবে।
বংশীতলা যুদ্ধে শহীদ হন দুর্বাচারার আরেক কৃতী সন্তান তাজুল ইসলাম। তৎকালীন সময়ে অনার্স পড়–য়া এ ছাত্র সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর হাতের হলুদ থাকা অবস্থাতেই ভারতে ট্রেনিংয়ে যান। সেখান থেকে এসে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। শহীদ তাজুলের বাবা করিম শেখ বলেন, ‘তাজুল ছিল পরপোকারী। অন্যের উপকার করাই যেন ওর নেশা ছিল। দুঃসাহসী তাজু বংশীতলা যুদ্ধে একাই শায়েস্তা করেন এক পাক সেনাকে। ওর শক্তির কাছে হার মেনে শত্রুরা পেছন থেকে গুলি করে কাপুরুষের মত ওকে হত্যা করে।’ ৮০ বছর বয়সী তাজুর বাবা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘দেশের জন্য ছেলে জীবন দিয়েছে এটা ভাবলে গর্ব লাগে। কিন্তু কি পেয়েছি আমরা? ছেলের কবরটিই যথাযথভাবে বাঁধানো হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর কত সরকারই তো গেল আসল। কিন্তু কেউ এদিকে দৃষ্টি দেয়না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, যেন কবরগুলো ভালমতো বাধানোর ব্যবস্থা করা হয় এবং সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়।’ তাজুলের বড়ভাবী জাহানারা বেগম এবং বোন মেহেরুন নেছা হাউমাউ করে কাঁদতে বলেন, ‘ও সবসময় অন্যের চিন্তা করত। ছোটদের আদর করত। আমাদের সঙ্গে মজা করত। এত প্রাণোচ্ছ্বল ছেলেকে ওরা কাপুরুষের মতো হত্যা করে। এখনও বিশ্বাস করতে পারিনা, তাজু নেই।’ যুদ্ধস্থান থেকে তাজুর লাশ কাধে বহন করে নিয়ে আসার তাজুর মামা তোব্বার মোল্লার কাছে ঘটনার বর্ণনা শুনতে চাইতেই শিশুর মতো কেঁদে ওঠেন তিনি।
অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাই যে অন্তরালে রয়ে গেছেন; অনাহারে, অর্ধাহারে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তার বাস্তব নিদর্শন মুক্তিযোদ্ধা বাজর আলী মল্লিক। ৭৮ বছর বয়সী এই দেশপ্রেমিক বর্তমানের সুপরিচিত অনেক মুক্তিযোদ্ধার চেয়েই যুদ্ধে অবদান বেশি রেখেছিলেন, এমন দাবী এলাকার মুরব্বীদের। প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আজ তিনি বৃদ্ধ বয়সে জীবন যুদ্ধে লিপ্ত। দু’মুঠো অন্নের জন্য শহীদদের কবরের পাশেই ছ্ট্টো একটি দোকান দিয়েছেন। দুই ছেলে নিজেদের সংসার চালাতেই হিমশিম খান। একারণে বাবাকে আর দেখা হয়ে ওঠেনা। বাধ্য হয়ে বৃদ্ধ বাবা এখন মুদি দোকানদার। দুর্বাচারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিষ্পাপ ছাত্র-ছাত্রীরাই তার খোদ্দের। যুদ্ধের স্মৃতি জানতে চাইলে জীবনের শেষ ধাপে উপনীত হওয়া এই বৃদ্ধ বলেন, ‘কি আর কব নাতি। মেলা সম্বাদিকই (সাংবাদিক) তো আসে আর যায়। কিছ্ ুহয়না তো।’ যুদ্ধ না করেই অনেকে তদবির জোরে সার্টিফিকেট জোগাড় করে দেদারচে ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ বিভিন্নসময় দারে দারে ঘুরেও কোনরকম সুযোগ-সুবিধা পাননি বৃদ্ধ এই মুক্তিযোদ্ধা। কণ্ঠে এই না পাওয়ার আপসোস থাকলেও শেষ ইচ্ছা হিসেবে তিনিও দুর্বাচারায় শহীদদের কবরের স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ দেখে যাওয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেন।
দেশ শত্রুমুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার পরও দীর্ঘদিন দুর্বাচারায় ছয় শহীদের সমাধিস্থল ছিল অরক্ষিত। অবশেষে ১৯৯৫ সালে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নাসিম উদ্দিন আহমেদ ও তৎকালীন উজানগ্রাম ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মরহুম শমসের আলী মোল্লার প্রচেষ্টায় কবরের উন্নয়ন কাজ হয়। যে প্রকল্পের নাম ‘রক্তঋণ-১’। ওই প্রকল্পের আওতায় চারিদিকে ইট দিয়ে বাধাই করে প্রত্যেকের কবরের সামনে নামফলক দেয়া হয়। এরপর আর কোন উন্নয়ন কাজ হয়নি। দেড়যুগ অতিবাহিত হলেও এখনও ওই প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। এ নিয়ে হতাশ কমান্ডার নাসিম উদ্দিন আহমেদ। তিনি অকপটে বলেন, ‘দুর্বাচারা মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজ্জ্বল স্বাক্ষী। এখানে দুইটা যুদ্ধের (বংশীতলা-করিমপুর) শহীদদের কবরস্থান। অথচ এখানে তেমন কিছুই হয়নি। জায়গাটি অবহেলিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘১৯৯৫ সালে রক্তঋণ-১ প্রকল্পের আওতায় দুর্বাচারায় কাজ শুরু করি। তৎকালীন সংসদ সদস্য, জেলার প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু অর্থাভাব ও নানা কারণে কাজ শেষ করা যায়নি।’ কুষ্টিয়া জেলা কমান্ডার আরও বলেন, ‘কবরস্থানটির ডিজাইন অনেক ব্যয়বহুল। এটা সম্পন্ন করতে অন্ততপক্ষে আরও ১১ লাখ টাকা প্রয়োজন। তবে আমি বিশ্বাস করি ও আশাবাদী কাজ শেষ করতে।’ মহতী এ কাজের জন্য তিনি কুষ্টিয়ার শিল্পপতীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি বিশিষ্ট শিল্পপতি আলহাজ্ব মজিবুর রহমান ও ড. আলাউদ্দিন আহমেদের নাম উল্লেখ করেন। দুর্বাচারা কবরস্থানের ডিজাইন প্রসঙ্গে নাসিম উদ্দিন বলেন, এটি যশোর ক্যান্টনমেন্টের মনোহরপুরের আদলে করা। নতুন করে কাজ শুরু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যশোর ক্যান্টমেন্টের জিওসি’র সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা আছে, দুর্বাচারায় মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থানের অসমাপ্ত কাজ শেষ করা।
দুর্বাচারায় মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থলে প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বরের আগে শুধু চুনকালি করেই দায়িত্ব শেষ! এলাকাবাসীর দাবী, এখানে যেন স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মহান স্মৃতি বহনকারী এ জায়গায় (দুর্বাচারা) যদি সরকারীভাবে কোন স্থাপনা করা হয় তাহলে জায়গাটি পরিণত হতে পারে ঐতিহাসিক স্থানে।
zajoy1@gmail.com