সৈয়দ জাহিদ হাসান: বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘সদর বন্ধ, খিড়কি উদলা’। এর অর্থ হলো সামনের দরজা দিয়ে কিছুতেই তোমাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না, কিন্তু তুমি চাইলে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে পারো। ওখানে তোমাকে কেউ আটকাবে না। ইচ্ছে করলেই তুমি সেই পথ দিয়ে খেয়াল-খুশি মতো প্রবেশ ও প্রস্থান করতে পারো। তবে খিড়কি যেহেতু গোপন দ্বার, সেই গোপন দ্বারে গোপন লেনদেন না হলে কারই প্রবেশাধিকার থাকে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে যতগুলো আলোচিত বিষয় আছে মাদক সংক্রান্ত আলোচনা আছে সেগুলোর শীর্ষে। মাদক বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এমনভাবেই ঘাঁটি গেড়েছে যে, তাকে নির্মূল করতে রীতিমতো বন্দুক হাতে নিয়ে নামতে হয়েছে দেশের আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে। বাংলাদেশ সরকারের মাদক-বিরোধী অভিযানের আয়োজনকে মাদকবিরোধী যুদ্ধ বলেই মনে হয় আমার কাছে। এই অভিযানে সরকার সফল হবেন এটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু নিন্দুকের সান্ধ্যভাষার নিন্দাবাণীতে ইতোমধ্যেই সন্দেহ ঢুকে গেছে কতিপয় জনতার মনে। এর মধ্যে আবার ঘি ঢেলে দিয়েছে টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগমের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি। আয়েশা বেগম বলতে চান, একরামুল হক মাদক ব্যবসায়ী না হয়েও পূর্ব পরিকল্পনার সূত্রে নিহত হয়েছে। শুধু আয়েশা বেগমই নন, র্যাব-পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে অন্য যারা নিহত হয়েছেন সেসব নিহতের কোনো কোনো পরিবারও কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশে মাদকবিক্রেতা ও মাদকসেবীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। মাদক পৃথিবীর সবদেশেই কম বেশি প্রচলিত। মানুষ মাদক গ্রহণ করে, তবে সব মানুষই মাদক গ্রহণ করে না। মাদক থেকে মানুষকে ফেরাতে হলে আগে মাদক মুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকার করতে হয়। সেই অঙ্গীকার শুধু আমজনতার একার নয়, আমজনতার সঙ্গে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগেরও অঙ্গীকার হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র যে-রাষ্ট্রে জনতার অঙ্গীকারের কোনোই মূল্য নেই। এখানে এখন সবকিছুই চলে প্রশাসনের মর্জিতে। প্রশাসন যদি চায় মাদক চলবে, তাহলে জনতার শত প্রতিরোধেও মাদক রোধ করা সম্ভব নয়। এবার প্রশাসন চাইলে, কারো পক্ষেই তা প্রতিরোধের সুযোগ নেই। শুধু মাদক নয়, যেকোনো ব্যাপারে জনতার চেয়ে প্রশাসনিক ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাংলাদেশে সবকালে গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে।
৪ মে থেকে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে যেসব ঘটনা ঘটছে তার মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও গণগ্রেফতারই প্রধান। সেই সঙ্গে উদ্ধার হচ্ছে ইয়াবা ও হেরোইন। গাঁজাও পাওয়া যাচ্ছে কোনো কোনো অভিযানে। পিস্তল, শর্টগান, বুলেট এসবও উদ্ধার হচ্ছে মাদকবিক্রেতাদের কাছ থেকে। বাংলাদেশে ইয়াবা ঢুকে মূলত বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা টেকনাফ দিয়ে। সরু ওই সীমান্ত পথ দিয়ে ইয়াবা ঢুকে রক্তের মতো ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশের শরীরে। টেকনাফের পুলিশ প্রশাসন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কোস্ট গার্ডের সম্মানিত সদস্যরা যদি একটু কঠোর হতেন তাহলে কিছুতেই ইয়াবা নামের মাদক বাংলাদেশে এমন ভয়ঙ্কর চেহারায় আত্মপ্রকাশ করতো না। শুরুতেই বলেছিলাম ‘সদর বন্ধ খিড়কি উদলা’র কথা। ব্যাপারটা মূলত সেখানেই। ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলের চালান অবাধে দেশে প্রবেশ করতে দিয়ে দেশের মানুষকে অর্থনৈতিক এবং শারীরিকভাবে পঙ্গু করে আবার তাদের বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করার যে-নাটক প্রশাসন সাজাচ্ছেন এটা কি আদৌ সমর্থনযোগ্য? এ প্রশ্ন নিয়ে প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় মানবাধিকার কর্মী ও প্রতিষ্ঠান তাদের বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে ফল কি হচ্ছে বুঝা মুষ্কিল, তবে বন্দুক যুদ্ধে কিন্তু নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
সরকারের যতগুলো গোয়েন্দা বাহিনী আছে তারা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট তৈরি করেছেন মাদক ব্যবসায়ীদের গড ফাদারের নামে। এই গডফাদারেরা কেউই চুনোপুঁটি প্রজাতির নয়। প্রত্যেকেই রাঘব বোয়াল টাইপের। এদের মধ্যে সংসদ সদস্য, আমলা, পদস্থ কর্মকর্তাসহ নানা মহলের মানুষ আছে। কথিত বন্দুক যুদ্ধে এখন পর্যন্ত যারা মারা গেছে তারা কমবেশি সকলেই খুচরো ব্যবসায়ী বা ছোটখাটো স্থায়ীয় ডিলার। এদের মেরে মাদক-বিরোধী অভিযান সফল হবে বলে মনে হয় না। কারণ নদীতে জোয়ার থাকলে নালা-নর্দমায় পানি থাকবেই। মাদকের প্রবেশ বন্ধ না করে, সীমান্তে কঠোর নজরদারি জোরদার না করে যারা দেশের অভ্যন্তরে বন্দুকযুদ্ধের ফর্মুলা দিয়েছেন সেই ফর্মুলা সফল হবে বলে আমজনতা মনে করে না। হয়তো এতে সাময়িক লাভ হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য ‘মাদকের বিরুদ্ধে বন্দুক’ কিছুতেই কাজ করবে না।
সরকার যদি সত্যিকার অর্থেই মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে চায়, তাহলে তার উচিত হবে, প্রথমেই গডফাদারদের গ্রেফতার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করে শাস্তি দেওয়া। সেই শাস্তি মৃত্যুদ-ও হতে পারে। রাঘব বোয়ালরা শাস্তি পেলে আধমরাগুলো ভয়ের চোটেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু উল্টো পদ্ধতি অবলম্বন করে খুব একটা লাভ হবে বলে বিশ্লেষকবৃন্দ মনে করছেন না। বর্তমান মাদকবিরোধী অভিযানে দেশের মানুষ খুশি হতে পারতো যদি সেরকম কোনো দৃষ্টান্ত সরকার দেখাতে পারতেন। কিন্তু সরকার এখন খুচরো মানুষ হত্যা ও গণগ্রেফতারের যে মিশন হাতে নিয়েছেন তাতে এ অভিযান একদিন মুখ থুবড়ে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
শুধু বাড়ি বানালেই হয় না, সেই বাড়িতে পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও রাখতে হয়। মাদক নির্মূল করা তখনই সম্ভব হবে যখন মাদকের বিকল্প অন্য কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে পরিমিত অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় উন্মুক্ত করার কথা আড়ালে-আবডালে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন। প্রস্তাবটা ততটা মন্দ নয়। এই প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বাস্তবায়ন করলে মাদক মুক্ত দেশ গড়া কঠিন হবে বলে মনে হয় না। বিশ্বের বহু উন্নত দেশেই প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য পরিমিত অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় উন্মুক্ত করা আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় সুলভে পাওয়া যায়। নেপাল ও ভুটানের কথা না হয় বাদই দিলাম। বাংলাদেশেও যদি প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য তেমন কোনো বিশেষ ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে হাতে-নাতে ফল পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে মদ খাওয়ার জন্য অনেকেরই লাইসেন্স আছে। ঢাকা ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, গুলশান ক্লাবের মতো অসংখ্য ক্লাব আছে বাংলাদেশে। সেসব ক্লাবের নামি দামি সদস্যরাÑ সকলেই সেখানে বসে ‘রুহ আফজা’ পান করেন বিষয়টি কিন্তু তা নয়। উঁচুতলার মানুষ যদি তাদের পছন্দ ও চাহিদামতো মদ্যপান করতে পারেন, তাহলে নিচুতলার মানুষের বেলায় এত নিয়মকানুন কেন? লাইসেন্স করে মদ পানের সুযোগ যদি থাকেই, তবে সেই সুযোগ আরো বিস্তৃত হলে ক্ষতি কি? মদ্যপের মাতলামি তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু ইয়াবাসেবী বা হিরোইন সেবীর পাগলামি সহ্য করা অসম্ভব। আমি প্রায় বছর খানেক আগে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম যার শিরোনাম ছিল ‘গ্রামে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে মাদক।’ সেই লেখায় দেখাবার চেষ্টা করেছিলাম কিভাবে মাদক শহর থেকে গুটি গুটি পায়ে গ্রামে প্রবেশ করছে এবং গ্রামের উঠতি বয়সের তরুণ ও যুবকদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যারা মাদক নেয় তারা ধ্বংস হয়, যারা মাদক দেয় (বিক্রেতা) তারা রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়। বাংলাদেশে এ রকম কোটিপতির সংখ্যা এখন সুপ্রচুর।
শহরের রাজপথের ধারে মাদকসেবীদের মাদক বেচাকেনা ও মাদক সেবনের দৃশ্য চোখে পড়ে না এমন মানুষ শহরে খুব কমই বাস করে। প্রতিটা বিভাগীয় শহরেই এই দৃশ্য সুলভ। প্রশাসন এসব দেখেও, না দেখার ভান করে অবৈধ অর্থলাভের সুযোগ পেয়ে। কোনো কোনো থানা থেকেও কেউ কেউ মাদক কিনে খান বলে শোনা যায়। জেলখানায়ও চলে মাদকের রমরমা ব্যবসা। থানার ওসি সাহেব ও জেলহাজতের কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি মাদকের সঙ্গে জড়িতই না থাকবেন, তাহলে কিভাবে প্রশাসনের অভ্যন্তরে এগুলো চলছে? যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন তাহলে এ প্রশ্নের জবাব দিতে সরকার বাধ্য। কেননা জনতার যেকোনো ন্যায়সঙ্গত প্রশ্নের উত্তর দিতেই সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মাদক অভিযান চলছে, আরো চলুক। তবে এ অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হলে বা সফল না হলে সে দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। মাদকের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক এবং এর সঙ্গে জড়িত আছে সমাজের বহু শক্তিশালী মানুষ। এ ব্যবসা বন্ধ করা হয়তো অসম্ভব, কিন্তু অসম্ভব বলে বসে থাকলে চলবে না, বিকল্প পথ অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। বিকল্প পথ যত সহজ ও সুন্দর হবে, ততই তা জনগণ, সরকার ও দেশের জন্য মঙ্গল।
লেখক : কবি ও কথাশিল্পী।