মাদ্রাসা শিক্ষায় সমস্যা কোথায়?

মাদ্রাসা শিক্ষায় সমস্যা কোথায়?

সাফাত জামিল শুভ: প্রতিবছরই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তীব্র প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেধার স্বীকৃতি পান শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে চমক সৃষ্টি করেছেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। ব্যাপারটি ‘চমক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, কেননা প্রথম হওয়া শিক্ষার্থী মো: জাকারিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসার পাশাপাশি নেতিবাচক তথাপি সাম্প্রদায়িক মনোভাব দেখাচ্ছেন অনেকে।

বেসরকারি প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মেসবাহ কামালের একটি বক্তব্য বেশ আলোচিত হচ্ছে। তিনি অতীতে এক বক্তব্যে বলেছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন উচ্চতর মাদ্রাসায় পরিণত হয়েছে এবং এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় ৬০% এর বেশি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। তাদের ইংরেজি ভিত্তি এত খারাপ, মাদ্রাসায় যে ইংরেজি পড়ে তা ক্লাস ফোরের সমমান। ফলে ইংরেজিতে দক্ষতাবিহীনভাবে তারা এসে ঢাকাসহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে এবং একটা গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে টেনে টেনে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসছে।”

অধ্যাপক মেসবাহ কামালের এ বক্তব্য কতটা গ্রহণযোগ্য তা আলোচনা সাপেক্ষ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি এ ধরণের বক্তব্য আদতে দিতে পারেন কিনা, যেখানে মাদ্রাসা শিক্ষা বাংলাদেশের একটি স্বীকৃত মাধ্যম। তিনি একটি দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে তার বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের একটি স্বীকৃত শিক্ষার মাধ্যমকে জনসম্মুখে স্পষ্টত ছোট করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন চতুর্থ শ্রেণীর ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে মাদ্রাসার ৬০% শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে যেতে পারে। এটি ভর্তি পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট কমিটি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির জন্য বেশ ক্ষতিকর।

অন্যদিকে বারবার ‘মাদ্রাসা শিক্ষার্থী’ শব্দটি টেনে এনে অন্যরুপ দেয়ার অভিপ্রায় দেখেছি অনেক জায়গায়। এর উদ্দেশ্য খুব গভীর, একজন শিক্ষার্থীর মেধাকে নতুন মোড়ক দেয়া, যেন তিনি সেটির যোগ্য নন, যেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মেধাবী হওয়া অস্বাভাবিক। পলিটিক্স অব প্রেজেন্টেশন বা উপস্থাপনার রাজনীতির সুগভীর সাম্প্রদায়িক সংস্করণ।

গণবুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত প্রফেসর ড. সলিমুল্লাহ খান মন্তব্য করেছেন, মাদরাসা শিক্ষাকে শুধু অনুসরণ নয়; বরং পাশ্চাত্যের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় মাদরাসা শিক্ষার পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষা ক্যারিকুলাম প্রণয়ন করছে।

এরকম বাস্তবতায় বাংলাদেশের আরেকটি ঘটনা বেশ আলোচিত হয়েছে। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চুল কেটে দেওয়া শিক্ষকের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করার পরও কেন ওই শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়নি। অথচ এক মাদরাসা শিক্ষকের শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার একদিনের মধ্যেই তাকে গ্রেফতার করা হলো, যেখানে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের কোন অভিযোগও ছিল না। এখানে স্পষ্টত মাদরাসার শিক্ষকদের প্রতি দ্বিমুখী আচরণের ইঙ্গিত।

অন্তত পরিতাপের বিষয়, অনেকেই এ ধারণা পোষণ করেন যে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী মানেই জঙ্গীবাদ কিংবা উগ্রবাদের সাথে সম্পৃক্ত। এখনো সামগ্রিকভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা ও মাদ্রাসায় শিক্ষিত মানুষ নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া চালু রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষাকে অনেকে পশ্চাত্পদ, অনগ্রসর, সেকেলে ও ধর্মান্ধ তৈরির কারখানা বলেন। সমাজের একটা শ্রেণী থেকে সবসময়ই মাদ্রাসাকে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও গোঁড়ামির কেন্দ্র হিসেবে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। অথচ বাংলাদেশ পুলিশের অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিটের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, জঙ্গীবাদে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ৫৬ শতাংশ আসছে সাধারণ শিক্ষা থেকে এবং ২২ শতাংশ মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে।যারা বাংলাদেশের জঙ্গি কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেন – তারা বলছেন, ‘জঙ্গি রিক্রুটকারীরা’ এমন লোকদেরই রিক্রুট করে যারা সাধারণ শিক্ষায় পড়ালেখা করেছে এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে। পুলিশ বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তারা জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে, এবং এসব ব্যক্তিদের অতীত জীবন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখেছেন তারা। এতে তারা দেখেছেন, এদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ রয়েছে যারা সাধারণ শিক্ষা অর্থাৎ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। (বিবিসি রিপোর্ট, ২০১৯)।

সমকালীন বাস্তবতায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ধরনের ‘বর্ণ প্রথা’ বিদ্যমান। যেখানে সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ মাদ্রাসাকে দেখেনে নিম্নবর্ণের শিক্ষামাধ্যম হিসেবে। এরা মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মনে করেন অচ্ছুত ও নিকৃষ্ট জীব হিসেবে। যেমনটা এক সময় উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণরা নিচু বর্ণের তথা শুদ্র সম্প্রদায়ের মানুষদের মনে করত। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতে বাধ্য করছে।

অথচ আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করা অনেকেই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মেধা তালিকার শীর্ষেও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দেখা যায়। এদের অনেকেই বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রায় সব পর্যায়ে সুনামের সঙ্গে চাকরি করছে এমন সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। মাদ্রাসার কারিকুলামের আধুনিকায়ন, আরবি ও ইসলামী বিষয়গুলোর সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়গুলোর সংমিশ্রণ কারণে বাংলা/ইংেরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সাথে তারা প্রতিযোগিতা করতে পারছে। যদিও মাদ্রাসা থেকে পাস করা অনেক শিক্ষার্থী যোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েও সরকারি চাকরি প্রাপ্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন।

মাদ্রাসা শিক্ষা কিংবা ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা না করে একে আধুনিকায়নের মাধ্যমে কিভাবে দেশের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। ‘ইসলামোফোবিয়া’য় আক্রান্ত হয়ে প্রগতিশীল পরিচয় দিতে গিয়ে জনসম্মুখে বিবেচনাহীন কথা বলা, আমরা বুদ্ধিজীবীদের কাছে আসা করিনা। একজন শিক্ষার্থী মাদ্রাসার হোক কিংবা কলেজের, তার মূল্যায়নের ভিত্তি হওয়া উচিত শুধুমাত্র ‘মেধা’, অন্য কিছু না।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.