সালতামামি ২০১২ : ঘরে ছিলো না তেমন আলো

সালতামামি ২০১২ : ঘরে ছিলো না তেমন আলো

পার হয়ে গেল আরেকটি বছর। ফুটবলে আন্তর্জাতিক কোন সফল্য নেই। ঘরোয়া ক্রীড়াঙ্গনের বেশিরভাগ হতাশার চিত্র। সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি। স্থানীয় টুর্নামেন্ট আয়োজনও আশাব্যঞ্জক ছিল না। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নতুন কমিটি আটমাসে আহামরি কোন আভাস দিতে পারেনি। কয়েকটি ফেডারেশনে নির্বাচনী জটিলতায় খেলাধুলায় যেমন ছিল স্থবিরতা, তেমনি দায়সারা আয়োজনের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত অর্থ বৈধ করার অপপ্রয়াসও চোখে পড়েছে সবার। সাঁতার, এ্যাথলেটিকস, শূটিং, ব্যাডমিন্টনসহ ছোটবড় বেশিরভাগ ফেডারেশনের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম ছিল না। এক কথায় সমালোচনার পাল্লাই ভারি হবে। ফেডারেশনগুলোর অভিভাবক বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েনের কার্যক্রমও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। লন্ডন অলিম্পিককে সামনে রেখে সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা না থাকায় বাজে ফল নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে এ্যাথলেটদের। অবশ্য সুবিধা লুটেছে অলিম্পিকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। নতুন ক্রীড়াবিদ তুলে আনার কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি তো বটেই, প্রশিক্ষণও ছিল যতসামান্য। গ্রামীণ খেলাধুলার নামে কোটি টাকার লুটপাটের মহোৎসব তো আছেই। তারপরও নিজেদের উদ্যোগে দুই একটি ফেডারেশনের সফলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ফুটবলে যেখানে ব্যর্থতার স্তূপ, সেখানে হকির নজরকাড়া আন্তর্জাতিক সাফল্য সুদিনেরই আভা ছড়িয়েছে।

ফুটবল : দেশের ফুটবলের মান উপরে ওঠার চেয়ে বরং উল্টো দিকে হাঁটছে, জাতীয় দলের সাম্প্রতিক ফলাফলে এটা বলাই যায়। এ বছর ফুটবলে আন্তর্জাতিক সফলতা নেই বললেই চলে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে দিল্লী সাফ ফুটবলের পর অবশ্য আন্তর্জাতিক কোন আসরও পায়নি। জাতীয় দলকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনা ছিল না বাফুফের। সাফের ব্যর্থতার পর কোচ নিকোলা ইলিয়েভস্কির বিদায়ের পর এ পর্যন্ত বিদেশি বা ভাল কোচ নিয়োগ দিতে পারেনি ফেডারেশন। এসবের উর্ধে বেশি আলোচনার বিষয় ছিল নির্বাচন। ৬ মার্চ ফিফা সভাপতি জোসেফ ব্ল্যাটার ২দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি আর্টিফিসিয়াল টার্ফ, ফুটবল একাডেমী ও বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন। এদেশের ফুটবলের উন্নয়নে সহযোগিতার আশ্বাস ছিল তার মুখে। ঢাকার লীগ চালু আর মেসিদের ঢাকায় আনা ছাড়া কাজী সালাউদ্দিন চার বছরে তেমন কিছু দিতে পারেনি। তারপরও এপ্রিলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নতুন প্রত্যাশায় দেশের ফুটবল লিজেন্ডকে আবারও ফুটবল উন্নয়নের জন্য নতুন মেয়াদে নির্বাচিত করেন সংগঠকরা। তবে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সালাউদ্দিন বাফুফে সভাপতি হয়েছেন বাস্তবতার নিরিখে হতাশার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। ৮মাস পার হতে চললেও আসেনি বিদেশি কোচিং স্টাফ। আর সিলেট বিকেএসপিতে ফুটবল একাডেমী তো হাঁকডাকেই সারা। আগস্টে চালু করার কথা থাকলেও নানা অজুহাতে বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, চালু হয়নি। জুলাইয়ের জেলা ফুটবল লীগ গড়িয়েছে ডিসেম্বরে আংশিকভাবে। ফলাফল যাই হোক, কাজী নাবিল আহমেদকে চেয়ারম্যান করে গঠিত ন্যাশনাল টিমস কমিটির ফুটবলারদের ব্যস্ত রাখার পরিকল্পনা ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। আর কিছু বিতর্কিত বিষয় বাদ দিলে প্রীতিম্যাচে নেপাল ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র সান্ত¡নার। অবশ্য থাইল্যান্ডের কাছে ৫-০ গোলে হার ভাবনার কারণ। বয়সভিত্তিক দলের চিত্র আরো খারাপ। বিক্ষিপ্তভাবে বয়সভিত্তিক দল আন্তর্জাতিক আসরে অংশ নিলেও সম্মান বয়ে আনতে পারেনি। অনুর্ধ-২৩ দল নেপালের সাফাল পোখারা কাপের এক ম্যাচ খেলে ও শ্রীলঙ্কার মহিন্দ রাজা পাকসে টুর্নামেন্টে তিন ম্যাচের দুইটিতে হেরে করুণ বিদায় নেয়। নেপালে জুনে এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপের বাছাই আসর থেকে অনুর্ধ-২২ দলের লজ্জাজনক বিদায় ঘটে। দেশজুড়ে অনুর্ধ-১৪ ও ১৮ ট্যালেন্টহান্ট, জাতীয় স্কুল ফুটবল আয়োজনের মাধ্যমে উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রতিভা অন্বেষণের চেষ্টা অনেকটা বিফলে গেছে। প্রায় ছয় কোটি ব্যয় করলেও ঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি বাফুফে।

হকি : নিয়মিত ঘরোয়া টুর্নামেন্টের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সফলতা রয়েছে হকিতে। এশিয়া কাপ হকির বাছাই টুর্নামেন্ট এএইচএফ কাপে টানা দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এপ্রিলে থাইল্যান্ডে আয়োজিত আসরে জিমি-চয়ন-জাহিদরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই সঙ্গে আগামী বছর সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠেয় এশিয়া কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। গ্রুপে সিঙ্গাপুর, চাইনিজ তাইপে, থাইল্যান্ডকে, সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে ও ফাইনালে ৬-৩ গোলে ওমানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ওয়ার্ল্ড হকি লীগের প্রথম পর্বের বৈতরণী পেরিয়ে বাংলাদেশ দল স্থান করে নিয়েছে দ্বিতীয় পর্বে।

সাঁতার : প্রশিক্ষণবিহীন জাতীয় ও বয়সভিত্তিক সাঁতারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কার্যক্রম। সাঁতারুদের মান কমে গেছে। জাতীয় সাঁতারের আগের আসরে ১১টি রেকর্ড হলেও এবার সে ধারাহিকতা ছিল না। প্রতিযোগীর সংখ্যা কম। নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় তিন মাস। তবুও নির্বাচনের উদ্যোগ নেই ফেডারেশন বা এনএসসির।

দাবা : বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে এ যাবতকালের সেরা সাফল্য অর্জন ৩৩তম স্থান, আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ দেয়। আগস্টের শেষে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে প্রতিযোগিতায় যেখানে প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ৩৫ নম্বরে। বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে ষষ্ঠ ও সার্কে প্রথম স্থান দখল করে। অর্জিত হয় ওয়ার্ল্ড সিটিস দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয়ার যোগ্যতা নিয়াজদের। ভারতে পর পর দুটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়নও কম প্রাপ্তি নয়। অক্টোবরে নাগপুরে এনআইটি গ্র্যান্ডমাসআর দাবায় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান অপরাজিত ও অন্ধ্র প্রদেশে ভাইজ্যাক দাবায় গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব শিরোপা জয় করেন। ডিসেম্বরে ভারতে এশিয়া স্কুল দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয় ক্ষুদে দাবাড়– ফাহাদ রহমান। যা ফাহাদের প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য। আগস্টে কলকাতায় আন্তর্জাতিক রেটিং দাবায় মিথিলা প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

মহিলা ক্রীড়া সংস্থা : নির্বাচন, ভবনে তালা, কোর্ট, এ্যাডহক কমিটি এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিল সংস্থাটি। মেয়েদের কোন প্রতিযাগিতা আয়োজন করতে পারেনি। কোনরকম নামসর্বস্ব একটি প্রশিক্ষণ কোর্সই নতুন কমিটির অর্জন বলা যায।

অলিম্পিক : ক্রীড়াঙ্গনে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন। ২৯ নবেম্বর নির্বাচনে নতুন নেতৃত্ব আসলেও কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছে কিছু বিতর্কিত ও অযোগ্য সংগঠক। যাদের নিয়ে স্থানীয়ভাবে খেলাধুলার প্রসারের প্রতিশ্রুতি দেয়া মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা কতটা সফল হবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এ্যাথলেটিক্স : নির্বাচনের প্রত্যাশায় ফেডারেশনটির কার্যক্রম এক প্রকার স্থবির ছিল। দ্বিধাবিভক্ত ফেডারেশনে নামসর্বস্ব ও দায়সারাভাবে দুইটি টুর্নামেন্ট হয়েছে। রেকর্ড তো দূরের কথা, তাতে নতুনত্ব বা প্রতিভার কোন ছোঁয়া ছিল না। ফান্ড হাতিয়ে নিতে মে’তে কোনমতো বয়সভিত্তিক আসর বসানো হয়। জাতীয় আসরেও ছিল একই চিত্র। নতুন কোন এ্যাথলেট উঠে আসেনি।

ব্যাডমিন্টন : খেলাধুলা আয়োজন তো ডুমুরের ফুল, বার বার কোর্টে যেতে হয়েছে ফেডারেশনের নির্বাচন ও কমিটি নিয়ে। আগের গতি আটকে গেছে। বছরের প্রথম দিকে বিগত কমিটি একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করলেও নতুন কমিটি জাতীয় আসরই করতে পারেনি। জুনিয়র টুর্নামেন্ট করেছে মাত্র। সেটাও প্রাইজমানি বাদ দিয়ে মেডেল যুগে প্রত্যাবর্তনে। ফোরামের দৌরাত্ম্যে বিতর্কিত সংগঠকরা আছেন পরিচালকের ভূমিকায়। তবে জাতীয় শাটলারদের নিয়ে ফেডারেশনের বাইরে নিট কনসার্ন গ্রুপ এক লাখ ৬০হাজার টাকা প্রাইজমানির টুর্নামেন্ট করে প্রশংসার দাবি রাখে।

-সুজা উদ্দিন

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.