তোমার বাসনারাশি উঠাপড়া করে,
কেমনে বাহির হবে ভব পারাবারে।
পরান চাহিছে প্রীতি প্রতি ঘরে ঘরে
আত্মপরিচয় লয়ে যাবে প্রতি দ্বারে।
আমার ভাবনা হলো কেন এ ধরণী,
ঘোষণা করেনি আগে তব আগমনী।
এদেশ কহিছে তার আপন কাহিনি,
পুরাতন এত কথা তুমি তো চাহনি।
ঘরে ঘরে হানাহানি চলে স্বার্থ লয়ে,
তোমারে হলো না জানা সত্য পরিচয়ে।
একি হলো মুজিবর! তোমার সন্তান,
তাহাই করিল? যা করেনি পাকিস্তান!
তোমার বাসনা আর তোমার ভাবনা
মুক্তির আস্বাদ তবে কভু কি পাবে না?
উদ্বেগ
মোনায়েম সরকার
নষ্ট নরে শ্রেষ্ঠ ধরা দিলো ছারেখারে
সঠিক যে পথ তাহা কে দেখাতে পারে?
কে দেখাতে পারে বল নতুন স্বপন,
কে পারিবে গড়ে দিতে নতুন ভুবন?
চারদিকে পাতা আছে মরণের ফাঁদ,
কিভাবে বাঁচিবো তাহা ভাবি দিনরাত।
বোমার আঘাতে মরে অবুঝ শিশুরা
আবার আসিতো যদি প্রেমের যিশুরা
প্রেমময় হতো তবে পৃথিবী আবার।
দূর হতো আছে যতো মিছে অবিচার।
আমরা তাকিয়ে আছি আগামীর প্রতি
চুপচাপ বসে আছি মেনে নিয়ে ক্ষতি
এভাবে চলতে দিলে সব হবে শেষ
প্রলয় করবে গ্রাস, সমাজ ও দেশ।
হে বিবেক জেগে ওঠো
চারদিকে এত লাশ, রুধির কি জন্য?
মানুষ কি অবশেষে হয়ে গেল বন্য?
মানুষের পৃথিবী কি সুন্দর হবে না?
যুদ্ধকে থামাতে কি কেউ কথা কবে না?
এত লোভ মানুষের দেখে পাই লজ্জা
চারদিকে হানাহানি যুদ্ধেরই সজ্জা।
আকাশে বিমান উড়ে বোমা পেটে নিয়ে
সেনারা মানুষ মারে রাইফেল দিয়ে
ভয়ানক অসহায় মানুষেরা আজ
ভাবি, কেন চুপচাপ লড়াকু সমাজ?
উদার মানবিকতা মরেছে কি তবে?
হিংস্র মানুষগুলো কবে ভালো হবে?
মানুষকে মানুষের অধিকার দাও,
হে বিবেক জেগে ওঠো, প্রলয় থামাও।
দানবেরা ধ্বংস হোক
আমাদের প্রিয় দেশ, দানবের মুঠোতলে আজ।
পথে পথে পড়ে আছে মানুষের লাশ
পোড়াবাড়ি, তীর্থভূমি সব আজ শ্মশান এখন।
পৃথিবীর কোনোখানে হয়নি যে বীভৎস প্রলয়
সে প্রলয়ে ছিন্নভিন্ন আমার স্বদেশ।
আপন নিবাস ছেড়ে, ছেড়ে দিয়ে পৈতৃকমমতা
কোটি কোটি মানুষ আজ দেশপলাতক।
এমন বীভৎস দিন, এ জীবনে আর দেখিনি।
বৃক্ষের সবুজ পাতা রাইফেলের গুলির আঘাতে আহত
নদীর জলে বীর শহিদের রক্ত মিশে
রংহীন জলও আজ রক্তবর্ণ, ভোরের সূর্যের মতো লাল।
আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন শুরু হয়
তখন প্রকৃতির বুকে বসন্ত ছিল।
রাঙা রাঙা কৃষ্ণচূড়ায় ভরে ছিল দেশের সীমানা,
কোকিলের কুহু ডাকে পলাশের বনে বনে,
ফুলগুলো জেগে ছিল অপার্থিব প্রেমে।
পশ্চিমা দানবের বিকট চিৎকারে
বসন্তের বর্ণীল সৌন্দর্য মিলিয়ে গেল,
স্তব্ধ হয়ে গেল পাখিরা,
ফুলের হৃদয় থেকে ভেসে এলো বারুদের ঘ্রাণ।
যে আমার স্বদেশকে শ্মশান বানায়
কামানের গোলা কিংবা ধারালো বেয়নেট দিয়ে
হত্যা করে শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষ,
সে ধ্বংস হোক, রসাতলে যাক।
তার জন্য আমি আজ উচ্চারণ করি ঘৃণা,
আমার ঘৃণা আমৃত্যু তাকে পোড়াবেই।
আমি যদি বঙ্গজননীর দধীচি সন্তান হই,
তাহলে মনে রেখ,
আমার হাড় দিয়েই তোমাদের মৃত্যু নিশ্চিত হবে।
দুর্জয় সন্তান
ভাবছো ঘাতক তোমার হাতে,
তুলে দিবো দেশ
এই স্বপ্ন দেখার তোমার
দিন হয়েছে শেষ।
তোমার হাতে চাবুক খেয়ে
কাটবে না আর দিন,
ভাঙবো আমি শিকল, কারা
হবো আজ স্বাধীন।
আমার ঘামে ফসল ফলে,
সেই ফসলের দামে
তোমার বাড়ি দালান তোলো
তুমি তোমার নামে।
ভাবছো আমি বোকা-সোকা
এসব বুঝি কম
একাত্তরে টের পাওয়াবো
আমি কেমন যম।
এতটা দিন নীরব ছিলাম,
তাই তুলিনি হাত
এবার আমি করবো তোমায়
ভয়ঙ্কর আঘাত।
সেই আঘাতে মরবে তুমি
যাবে তোমার প্রাণ
মনে রেখো বীর বাঙালি
দুর্জয় সন্তান।
এক খোকা প্রিয় নাম
আক্রান্ত স্বদেশ থেকে তাড়া খেয়ে যখন আমি কলকাতায় গৃহহীন
তখন আপনি সহায় হলেন ডক্টর সত্যেন বোস।
রসিক মুজতবা আলীকেও পেয়েছিলাম কলকাতার শরণার্থী জীবনে
লোকায়ত দর্শনের দেবীপ্রসাদ, দুর্দিনের দোসর দিলীপ বোসকেও
পাই একাত্তরের অগ্নিঝরা মুহূর্তে।
বিপ্লবী ইলামিত্র আপনার অবিনাশী সাহচার্য,
রমেনদার আদরমাখা পরশ একাত্তরেরই পেয়েছিলাম আমি
প্রিয় জ্যোতিবসু, আপনার জ্যোতির্ময় দৃঢ়তায় আমি
মুগ্ধ হয়েছিলাম একাত্তরের অনিকেত জীবনেই।
কত মুখ মনে পড়ে আজ, কত কথা ভেসে ওঠে স্মৃতির পাতায়
কমরেড প্রমথ দাশগুপ্ত, লাল সালাম আপনাকে,
কমরেড ভবানী সেন আপনিও বাংলাদেশের অকৃত্রিম
বন্ধু ছিলেন একাত্তরে।
শচীন্দ্রলাল সিনহা আপনাকেও মনে পড়ে।
মনে পড়ে মহারাজদা ও দীলিপ চক্রবর্তী আপনাকেও
মানুষ কিভাবে মহামানব হয়ে ওঠে আপনার কাছ থেকে
না শিখলে আমার এই মানবিক শিক্ষা কখনোই পূর্ণ হতো না।
কিছু কিছু মানুষ থাকে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো।
প্রিয়তম তাজউদ্দীনÑ আপনারা চারজন ছিলেন
বাংলার আকাশের চার অনির্বাণ নক্ষত্র।
ঘাতকেরা আপনাদের হত্যা করতে পারে
কিন্তু আপনাদের স্বপ্নকে ওরা হত্যা করতে পারে না।
আপনারাই বাংলাদেশ, আপনাদের স্বপ্ন ছুঁয়ে শপথ করছি
প্রয়োজনে জীবন দেবো তবু মাতৃমাটির অপমান সইবো না
পরাধীন স্বদেশকে মুক্ত না করে কিছুতেই ঘরে ফিরবো না।
আমাদের স্লোগান
এমন স্লোগানমুখর দিন আর কখনো আসবে না
বাঙালি জাতির জীবনে।
ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে উদ্ধত লাল মোরগের মতো,
কতদিন তেজী কণ্ঠে বলেছি,
‘পূর্ব-পশ্চিম এক আওয়াজ, খতম করো আইয়ুব রাজ’;
কতদিন সহযোদ্ধাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেছি
‘আইয়ুব মোনেম ভাই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।’
সেদিন আমরা ওইসব ঘাতকদের ফাঁসি দিতে না পারলেও
তাদের অনুগত দস্যুবাহিনীকে ঠিকই আমরা জাহান্নামে পাঠিয়েছিলাম।
আমাদের প্রিয় স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’।
ওটাই ছিল বিজয়ের বীজমন্ত্র।
‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা।’
এই দুর্মর স্লোগানও ছিল আমাদের শক্তির প্রেরণা।
যেদিন মিছিলে স্লোগান দিতে পারতাম না,
সেদিন ভীষণ অসহায় মনে হতো,
মনে হতো এদেহে প্রাণ নেই, হৃৎপিন্ডে নেই রক্তপ্রবাহ।
যে যৌবন জনসমুদ্রে স্লোগান দিতে জানে না,
কণ্ঠে কণ্ঠে ছড়াতে জানে না মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিবাণী
সেই উষর যৌবন আমরা চাই না।
এক-একটি স্লোগান কখনো কখনো হয় একটি জাতির মুক্তির মহাকাব্য।
একাত্তরে কোটি কণ্ঠে আমরা মুক্তির সেই মহাকাব্যই রচনা করেছিলাম।
একাত্তরে মুক্তি,
এই পবিত্র মৃত্তিকার হৃদয় ছুঁয়ে
যত ইচ্ছে রক্ত¯্রােত বয়ে যাক,
যারা ভীরু কাপুরুষ, কাল নাগ
তারা সবাই ঢুকে যাক গহ্বরে
আমি মুক্তিআকাক্সক্ষী বাঙালি সিংহ
তুচ্ছ মাকড়সার সূক্ষ্ম জালে
বন্দি থাকার জন্য আমার জন্ম হয়নি।
চারদিকে আজ অসংখ্য রাহু
অক্টোপাসের মতো বাহু মেলে
আজ তারা খুবলে খেতে চায় প্রিয় বাংলাদেশ।
ওরা জানে না,
চিতাভস্মের ভেতর থেকেও বাংলাদেশ
আবার নতুন করে জন্ম নিতে জানে।
আমাদের পূর্বপুরুষ সূর্যসেন,
প্রীতিলতা কিংবা কল্পনা যোশীরা যে মাটিতে
অস্ত্র তুলে নেয়,
কার সাধ্য সে মাটিকে পদানত রাখবে?
যে মাটির গভীরে আছে
তরুণ বিপ্লবী ক্ষুদিরামের রুধিরÑ
বিনয়-বাদল-দীনেশেরা যেখানে
প্রমিথিউ হয়ে জন্ম নেয়Ñ
বাঘা যতীন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে
অনির্বাণ অনুপ্রেরণা হয়ে,
সে মাটি স্বাধীন হবেই।
বজ্রকণ্ঠে মুক্তির বাণী উচ্চারণ করেছেন,
নরপুক্সগব, অকুতোভয় শেখ মুজিব
নরপশুদের বলি দিয়ে
তাদের রক্তেই হবে এবার বাংলাদেশের মুক্তি।
গেরিলার স্বগতোক্তি
মোনায়েম সরকার
শ্বাপদেরা আজ ঘিরে রেখেছে আমার দেশ
পরাধীন দেশকে শ্বাপদের থাবা থেকে মুক্ত না করে
কিছুতেই আমি ঘরে ফিরবো না।
আমি আজ মৃত্যুকে ভয় ভাই না।
জীবন এখন আমার কাছে তত প্রিয় নয়,
যতটা প্রিয় মৃত্যুর দারুণ ইশারা।
যৌবনের সোনালি মুহূর্তে আজ আমি ফেরার গেরিলা
অস্ত্র আর গ্রেনেট এখন আমার খেলার সাথী।
যদি আমাকে ঘরে যেতে বলো
তাহলে আমি বলবো,
আগে আমার প্রিয় স্বদেশকে মুক্ত করে দাও।
যদি আমাকে শান্ত হতে বলো
তাহলে আমি বলবো
আগে ওই দানবদের ধ্বংস করো।
দেশকে অনিরাপদ রেখে
কিছুতেই ঘরে ফিরবো না আমি।
হে আমার দেশ,
হৃৎপি-ের রক্ত দিয়ে তোমার কপালে
টিপ পরাবো বলে,
অসুরের মুখোমুকি আমি।
তোমাকে শত্রুর হাতে বন্দী রেখে
আমাকে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান কোরো না।
দুর্মর বাংলাদেশ
মোনায়েম সরকার
ভয় কেন পাও দেশ?
বুকের রক্ত আজ এখনো
হয়নি তো সব শেষ।
তোমায় স্বাধীন না করে কি
ফিরতে পারি ঘরে,
কেন আমায় পিছু ডাকো
অমন আর্তস্বরে।
দস্যুগুলো যদি তোমার
বুক থেকে না যায়Ñ
কেমন করে ফিরবো আমি
তোমার আঙিনায়?
আমার দেশের সকল নদী
রক্তে যদি ভরে,
তবু তোমায় করবো স্বাধীন,
ফিরবো তবে ঘরে।
ঘুমাও তুমি নির্ভয়ে দেশ
আমরা আছি জেগে,
বৈরীকে বধ করবো মোরা
বিদ্রোহী আবেগে।
আসুক দেখি আসবে কারা
এত সাহস কার।
আঁচল ধরে টানবে আমার
ন¤্র বাংলা মার।
চলুক গুলি, ফাটুক গ্রেনেড
ভয় কেন মা পাও,
তোমার ছেলে থাকবো জেগে
নির্ভয়ে ঘুমাও।
বকুলের তরে
জোয়াড়ের জল থৈ থৈ, প্লাবনে ভাসিছে দু’কূল,
আয়রেÑ সোনার ছেলে, আমার বকুল।
আমারি গাঁও খানি পড়িয়াছে সোনার বসন,
মনে হয় যেন গাঁও নয়, সে মোর বকুলে দু’নয়ন।
ডাগর চোখে গাঁ থেকে দুর গায়ের স্বপ্ন মাখা,
স্বরসের যাদুমাখা চোখের তাঁরায় লক্ষ্য ছবি আঁকা।
সোনার ছেলে বকুল আমার,
বাঁচিয়ে রেখেছে সবার তরে যিনিÑ ‘বঙ্গবন্ধু’ সবার।
একটি দেশ একটি জাতি মহান;
হয়ে আছে চির অম্লান।
সোনার ছেলে বকুলের মাঝে
শত সুখ সবুজের ছোঁয়া খোঁজে।
আমার বকুলের মাঝে আছে দেশ,
দেশের মাঝে বকুল, সেরা ও শেষ।
আমার সবুজ মায়ার বাঁধনে দোলে
বকুল আয়রে হৃদি মাঝারে, আয়রে,
আমার কোলে।
০৭.০২.২০১৭
আরবার ফিরে এসো মহামনীষীরা
মোনায়েম সরকার
এসো রবীন্দ্র, এসো নজরুল
ফের মানুষের মাঝে।
তোমাদের আজ বড় প্রয়োজন
ভ্রষ্ট এই সমাজে।
কার্ল মার্কস ফের শোনাও আবার
সাম্যের মহাবাণী
লেনিন এসে চূর্ণ করো
শোষিতের যত গ্লানি।
মাইকেল এসো বিপুল বিশাল
প্রতিভা নিয়ে ফের
রামকৃষ্ণ ঘোচাও ব্যথা
বঞ্চিত ব্যথিতের।
সুভাষ তোমায় স্মরণ করি
ভাঙতে রুদ্ধ দ্বার
বিবেকানন্দ করো করো তুমি
পতিতকে উদ্ধার।
কোথা রোঁমা রোলা, লিও টলস্টয়
বিদ্রোহী চে গুয়েভারা
পৃথিবী আজকে দখলে নিয়াছে
লোভী যত দানবেরা।
মানবতা আজ পথে পথে কাঁদে
চোখ ভরা তার জলÑ
কে দিকে আশা, কে দিবে ভাষা
কে দিবে তারে বল।
বিদ্যাসাগর তোমাকে স্মরি
সঙ্গে রামমোহন
মহাত্মা গান্ধি তোমাকেও আজ
বড় বেশি প্রয়োজন।
দুঃসাহসী ফিদেল ক্যাস্ট্রো
হো চে মিন জানো নাকি
তোমাদের গড়া স্বপ্নভুবন
আঁধারে গিয়েছে ঢাকি।
দেখছো না ওই আরব বিশ্বে
ঘরে ঘরে হাহাকার,
পশ্চিমারা জ্বালায় আগুন
নেভায় সাধ্য কার।
ধর্মের নামে হানাহানি আজ
যুদ্ধ পৃথিবীময়।
আজ ধরণীতে হয়ে চলেছে
মানুষের পরাজয়।
ইউরোপ বলো, আফ্রিকা বলো
এশিয়া বা আমেরিকা
সবখানে আজ ছড়িয়ে রয়েছে
যুদ্ধের বিভীষিকা।
শান্তির দূত হে মহামানব
আর কত হবো নিঃস্ব
তোমাদের কাছে প্রার্থনা করি
মানবিক এক বিশ্ব।
বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান
টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে এসে গাও
মানুষের জয়গান।