মৎস্যকন্যা রহস্য

মৎস্যকন্যা রহস্য

3রণক ইকরাম

মৎস্যকন্যা বা মারমেইড হচ্ছে এক ধরনের জলজপ্রাণী, যার উপরের অংশ নারীর মতো এবং নিচের অংশ একটা মাছের মতো। হাজার বছরের পৃথিবীতে একটি বিশাল প্রশ্ন হচ্ছে এই মৎস্যকন্যা বাস্তবে আছে না-কি নেই। এই প্রশ্নের উত্তর আজো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলের উপকথাতেই এ ধরনের প্রাণীর গল্প প্রচলিত রয়েছে। পৃথিবীর সব আদি সভ্যতায় মারমেইড বা মৎস্যকন্যাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। যেসব অঞ্চলের সভ্যতায় এদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি সেগুলো হচ্ছে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন অর্থাৎ সমগ্র পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ, ভারতীয় উপমহাদেশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, আটলান্টিক মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, ওশেনিয়া ইত্যাদি। সেই প্রাচীনকাল থেকেই মারমেইডদের নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সাহিত্যে এদের সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন হল ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। ছোটবেলার হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের রূপকথার গল্পে পড়া মৎস্যকন্যার কথা সবারই মনে থাকার কথা। ওয়াল্ট ডিজনির বিখ্যাত সৃষ্টি লিটল মারমেইডের গল্পও সবার জানা। এমনকি আধুনিক যুগেও মৎস্যকন্যাদের নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। অনেকেই দাবি করছেন, তারা নাকি মৎস্যকন্যা দেখেছেন। কিন্তু সত্যি কি মৎস্যকন্যা বলতে কিছু আছে?

 

মৎস্যকন্যার আদি রহস্য

অর্ধমানবী অর্ধমাছ মৎসকন্যাদের নিয়ে বিশ্বজুড়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপকথায় মৎসকন্যার নানা বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সব বর্ণনাতেই মৎসকন্যাদের প্রায় একই রকম শেপ বা আকৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। মৎস্যকন্যা নিয়ে প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় প্রাচীন অ্যাসিরিয়াতে ১০০০ খিস্টপূর্বাব্দে। সে অনুসারে দেবী অ্যাটারগাটিস ভুল করে তার মানব প্রেমিককে হত্যা করে ফেলেন। কিন্তু নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায়-দুঃখে পানিতে ঝাঁপ দেন আত্দহত্যা করার জন্য। কিন্তু দেবী অ্যাটারগাটিস এতই সুন্দরী ছিলেন যে সমুদ্র দেবতা পসাইডন তাকে মৃত্যুর রাজ্যে যেতে দিলেন না। তাকে তিনি অর্ধমানবী অর্ধমাছ রূপে নতুন জীবন দান করেন। একই বর্ণনা পাওয়া যায় ব্যাবিলনীয় উপকথায় দেবী ‘ইয়া’কে নিয়েও। গ্রিক উপকথায় এই অ্যাটারগাটিসই আবার ‘আফ্রোদিতি’ নামে পরিচিত। সবগুলো উপকথা অনুসারে মৎস্যকন্যারা সংগীতে ভীষণ পারদর্শী। সুরের মায়াজাল সৃষ্টির মাধ্যমে তারা জাহাজের যাত্রীদের মৃত্যুর দিকে আকর্ষণ করত। তাদের গানের গলা এতই চমৎকার ছিল যে সেই গান নাবিকদের কানে পৌঁছলে নাবিকরা সেই দ্বীপের দিকেই ধাবমান হতো। ফলে সেই জাহাজ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে সবার সলিল সমাধি ঘটত। অ্যাটারগাটিসের মানব প্রেমের অনুকরণে মৎস্যকন্যারা এর পর ডুবে যাওয়া নাবিকদের তাদের প্রেমের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য সাগরের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে তাদের কাছে পৌঁছে যেত। সেখান থেকে মৎস্যকন্যারা পানির নিচে দিয়ে ডুবন্ত নাবিকদের উদ্ধার করে তাদের সাইরেন দ্বীপে নিয়ে আসত। কিন্তু ততক্ষণে সবার মৃত্যু হয়ে যেত। কোনো কোনো উপকথায় এ মৎস্যকন্যারা মানুষের প্রতি ভীষণ বিদ্বেষপূর্ণ আবার কোথাও কোথাও প্রেমময়। তবে যাই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত নাবিকরা মারা যেত।

 

তারা মৎস্যকন্যা দেখেছেন!

মৎস্যকন্যা দেখেছেন এমন মানুষের মধ্যে সবার আগে চলে আসে বিখ্যাত নাবিক কলম্বাসের নাম। ১৪৯৮ সালে আমেরিকা আবিষ্কার করে পৃথিবীর ইতিহাসে আলাদা করে জায়গা করে নেওয়া কলম্বাসের লগবুকেও রয়েছে মৎস্যকন্যার উল্লেখ। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের লগ বুক অনুসারে তিনি যখন ক্যারিবিয়ান দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন নাকি এক অর্ধমানবী অর্ধমাছকে সমুদ্রবেলায় বসে থাকতে দেখেছেন। এটিকে অনেকে উড়িয়ে দিলেও বিশ্বাসীরা একেই মানছেন মৎস্যকন্যাদের অস্তিত্বের সপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ১৮৪৭ সালের কথা। ৮০ বছর বয়স্ক একজন জেলে দাবি করেন তিনি নাকি উপকূল থেকে ২০ গজ দূরে এক মৎস্যকন্যা দেখেছিলেন। তার বর্ণনা অনুসারে মৎস্যকন্যা তখন গলদা চিংড়ির দাড়া দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। তবে খুব বেশিক্ষণ তাকানো যায়নি মৎস্যকন্যার দিকে। যখনই ওই মৎস্যকন্যা বুঝতে পারল কেউ তাকে দেখছে, ওমনি টুপ করে পানির মধ্যে তলিয়ে যায়।

১৮৫৭ সালের জুন মাসের ৪ তারিখ। ব্রিটিশ শিপিং গ্যাজেটে উল্লেখ আছে এক স্কটিশ নাবিক নাকি সাগরের মধ্যে ঢেউয়ের ওপর এক কিশোরীকে বসে থাকতে দেখেছে।

১৮৩৩ সালের আরেকটি ঘটনা। আইল অব ইয়েল এ ছয়জন জেলে নাকি এক মেয়েকে তাদের জালে আটকায়।

তিন ফুট লম্বা ওই মেয়ে নাকি জেলেদের নৌকায় ওঠার পর তিন ঘণ্টা ছিল, সে নাকি জেলেদের সঙ্গে কোনো প্রতিরোধে যায়নি। শুধু আস্তে আস্তে ফোঁপাচ্ছিল।

ওই মেয়ের নাকি কোনো মাছের মতো লেজ ছিল না। কিন্তু তার দেহে সামান্য আঁশ ছিল। জেলেরা মারাত্দক ভয় পেয়ে যায় নৌকা আর সাগরের মধ্যে তারা আর প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে ইশারায় মেয়েটিকে চলে যেতে বলে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি হেনে মেয়েটি নিখুঁত এক ড্রাইভ দিয়ে সাগরে চলে যায়। সাগরে নেমে কিছুক্ষণ পর আবার ওঠে ঢেউয়ের ওপর ভেসে ভেসে তাদের কৃতজ্ঞতা জানায় এবং এক সময় সাগরে হারিয়ে যায়। এ গল্প এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির ন্যাচারাল হিস্ট্রির প্রফেসর ম্যাক্লিহানকে শুনান এডমন্ডসন নামে এক জাহাজের কাপ্তান।

২০০৬ সালে সুনামির পর মালয়েশিয়া সাবা উপকূলে একটি মৃত মৎস্যকন্যা ধরা পড়ে। পরে জানা যায় জুয়ান ক্যাবান নামে এক ফটোগ্রাফার ক্যামেরার কারসাজিতে এটা করে।

 

অস্তিত্বহীন মৎস্যকন্যা!

মৎস্যকন্যাকে কেউ কেউ মৎস্যকুমারী এবং অনেকেই জলপরীও বলে থাকে। সম্ভবত পানিতে এদের দেখা যায় বলে প্রচলিত ধারণার ভিত্তিতে জলপরী নামটা দেওয়া হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

কিন্তু মানুষের অবয়বের মাছ কখনো কল্পনার জগত ছেড়ে বাস্তবে এসে দেখা দেয়নি। এক খবরে টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশান সার্ভিস (এনওএস) সম্প্রতি তাদের ওয়েবসাইটে মৎস্যকন্যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই বলে ঘোষণা দিয়েছে। ডিসকভারি চ্যানেলে প্রচারিত ‘মারমেইডস : দ্য বডি ফাউন্ড’ নামের একটি তথ্যচিত্রভিত্তিক অনুষ্ঠান দেখে এনওএসএর কাছে মারমেইডের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দুজন নাগরিক। জলপরী বিষয়ে আগ্রহ সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বাণিজ্য বিভাগের বিজ্ঞানবিষয়ক এ সংস্থাটি মৎস্যকন্যাদের বাস্তবতার জগত থেকে নির্বাসন দিয়েছে।

বিবিসিকে এনওএসএর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমাদের মৎস্যকন্যা সেবা দেওয়ার মতো কোনো সেবা নেই বা তাদের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণও আমরা পাইনি। কিন্তু মৎস্যকন্যার ধারণা অনুসন্ধানে কি ধরনের গবেষণা চালানো হয়েছে কিংবা আদৌ কোনো গবেষণা চালানো হয়েছে কি না সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ফলে অনেকেই মনে করছেন, মৎস্যকন্যা সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের এই ঘোষণা সত্ত্বেও সাধারণ কৌতূহলী মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে আগ্রহ কমবে না।

 

বাস্তবের তিন মৎস্যকন্যা

তবে কল্পনার নয়, এরা বাস্তবের মৎস্যকন্যা। মাইরেড কেলি ও তার দুই বান্ধবী ফ্রাঙ্কি দুবেরি এবং দেমেলজা হিলয়ার সপ্তাহে ১০ ঘণ্টারও বেশি সময়ের জন্য পুরোদস্তুর মৎস্যকন্যাদের মতো সাগর দাপিয়ে বেড়ান। তবে শখ করে এমন কাণ্ড ঘটাননি তারা। ২০১০ সালে ২৫ বছর বয়সী কেলির ব্রেন টিউমার শনাক্ত হয়। এক বছর পর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমার অপসারণ করার পর ফের টিউমার দেখা দিলে চলতি বছর আবার অস্ত্রোপচার করা হয় তার মাথায়। এখন অনেকটাই সুস্থ কেলি। তবে নিজেকে পুরোপুরি কর্মক্ষম করতে সাঁতারকে শারীরিক অনুশীলন হিসেবে নিয়েছেন। আর প্রতিদিনকার এই কাজে নতুনত্ব আনতে সিলিকনের মৎস্যকন্যার পোশাক পরে সাঁতরান তিনি ও তার বান্ধবীরা। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট কেলি অবশ্য এখন অনেকটাই সুস্থ। পানির নিচে সাঁতার কাটা তার কাছে অনেকটাই ধ্যানের মতো। সেখানকার পরিবেশ বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা, তাই জিনিসটি তার কাছে উপভোগ্য। তিনি অনেকের কাছ থেকে মৎস্যকন্যার পারফর্ম করার জন্য আমন্ত্রণও পেয়েছেন বলে জানান তিনি। তবে তার নাক ও সাইনাসে কেমন প্রভাব পড়বে এটা নিয়ে প্রথম যেদিন পানিতে নামেন সেদিন খুব চিন্তিত ছিলেন কেলি। তার বান্ধবী ২৪ বছর বয়সী ফ্রাঙ্কি দুবেরি এবং ২৫ বছর বয়সী দেমেলজা হিলিয়ারও কেলির এ দীর্ঘ সুস্থতা যাত্রায় তার সঙ্গে রয়েছেন। বাস্তবের মৎস্যকন্যা খেতাবটি ভালোই উপভোগ করেন তারা।

 

সর্বনাশী লোরেলাই

অধিবাসীর সংখ্যা ১ হাজার। সেখানকার রাইনের তীর প্রধানত জাহাজ ঘাট বা জেটি হিসেবেই ব্যবহৃত। এখান থেকেই ছোট ছোট জাহাজ প্রতিদিন পর্যটকদের নিয়ে যায় সেই বিখ্যাত পাথুরে খাড়া পাহাড়। দেখতে যা ‘মৎস্যকন্যা লোরেলাই’ নামে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে প্রায় ২০ মিলিয়ন বা দুই কোটি পর্যটক আসেন এই ‘মিডল রাইন ভ্যালি’তে, লোরেলাই দেখার জন্য দিনের ভ্রমণে পাড়ি জমান তারা। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ‘লোরেলাই’-এর গল্প জানেন। ২০০২ সাল থেকে লোরেলাই ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত। এই সেই পাহাড।যেখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সর্বনাশী মৎস্যকন্যা লোরেলাই সূর্যস্নাত দিনে জাহাজের ডেকে আইস বা ঠাণ্ডা পানীয় নিয়ে বসে পর্যটকরা আনন্দময় পরিবেশে উপভোগ করেন ধীরে ধীরে সরে যাওয়া নদীর পাড়ের অপরূপ দৃশ্য? পুরনো দুর্গ বা কাসেল, কাঠের ঘর, সবুজে ঘেরা বনান্তর আর সরস সবুজ আঙ্গুর খেত বা ভিনিয়ার্ড। প্রায় দেড় ঘণ্টা নৌপথ পাড়ি দিয়ে রাইনের মতোই একটি পাহাড়। এই পাহাড় এবড়োথেবড়ো প্রস্তরময় উঁচু। খুব চোখে পড়ার মতো কিছু নয়। কিন্তু রাইনের মতোই একে ঘিরে রেখেছে কাল্পনিক, পৌরাণিক এবং কাব্য কাহিনী, যা ছড়িয়ে পড়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপার অবধি। ১৮০১ সালে রোমান্টিক ধারার কবি ও লেখক ক্লেমন্স ব্রিন্টানো তার বিয়োগান্তক কাহিনীতে লোরেলাইকে এক জাদুকরী নারীর রূপ দিয়েছিলেন। এই পাহাড়ের কাছেই ছোট্ট একটি এলাকা বাখারাখে ছিল তার বাস। যে কোনো পুরুষই মুগ্ধ হয়ে যেত তার রূপে। এক বিশপ তাকে মঠে নিয়ে আসার আদেশ করেন। যাওয়ার পথেই শেষবারের মতো একবার দেখতে চায় তার ভালোবাসার স্থান। উঠে আসে এই পাহাড়ে। মৃদু গানের সঙ্গে উড়ছিল তার সোনালি চুল। তারপর সেই উঁচু থেকেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাইনের বুকে। লোরেলাই খ্যাত পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা রাইন। লোকগাথায় আছে একটি ভ্রাম্যমাণ জাহাজের নাবিকেরা মুগ্ধ চোখে উপরে তাকিয়ে দেখছিল দাঁড়িয়ে থাকা ‘লোরেলাই’-এর সেই অপরূপ রূপ। পথভ্রষ্ট জাহাজ ধাক্কা খায় পানির তলার কঠিন পাথুরে শিলায়। বিধ্বস্ত হয় জাহাজ।

 

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.