রোহিঙ্গারা কি কখনো ফিরে যাবে?

রোহিঙ্গারা কি কখনো ফিরে যাবে?

সাফাত জামিল: পৃথিবীর ভাগ্যবিড়ম্বিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বতর্মানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অন্যতম। ধর্মীয় ও জাতিগত ফাটলরেখায় বিভক্ত মিয়ানমারের সামরিক ভূ-রাজনৈতিক কারণ ও নতুন বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন চিন্তার ফসল রোহিংগা সংকট। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে নিরীহ রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, লুট করা হচ্ছে সহায়সম্পদ। প্রাণ বাঁচাতে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা সীমান্তের সব পয়েন্ট দিয়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে ঢুকছে।সরকারি হিসাবমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। গত বছর ২৩ নভেম্বর নেপিডোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও একজন রোহিঙ্গাও রাখাইনে ফিরে যেতে পারেনি। 

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা আগামী ২০ বছরেও মিয়ানমারে ফিরে যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টার। গত ৩রা এপ্রিল ‘হোয়াটস নেক্সট ফর দ্য রোহিঙ্গা?’ (রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী?) শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞ বক্তারা একমত পোষণ করে বলেন, শিগগিরই রোহিঙ্গা সংকট সমাধান হবে না। মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আগ্রহী নয়। বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের জোর করে ফেরত পাঠাবে না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এ ক্ষেত্রে আগ্রহ হারাচ্ছে।
মিয়ানমার তাদের দুঃসাহস দিন দিন বাড়িয়েই চলছে অথচ প্রত্যাশিত কোনও জবাব আমরা দিচ্ছি না। বরং রাখাইনে অভিযানকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হিসেবে মিয়ানমার তুলে ধরতে চাইছে। তবে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে মিয়ানমার। কিন্তু সেটির প্রত্যাশিত অগ্রগতি নেই। উল্টো মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ। 


রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখতে এই এক দেড় বছরে কক্সবাজারে গেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব, ভ্যাটিকানের পোপ, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা। রোহিঙ্গাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনে তাদের চোখ ভিজে উঠলেও মিয়ানমারের নোবেল জয়ী নেত্রী অং সান সু চি’র অবস্থানের খুব বেশি হেরফের হয়নি।


ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গেলো এক বছরে রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে ৬০ হাজার। বর্তমানে গর্ভবতীর সংখ্যা আরো ২০ হাজার। মিয়ানমার এদের তো অন্তত ফিরিয়ে নেবে বলে মনে হয় না। কারণ, এরা জন্মসূত্রেই বাংলাদেশের নাগরিক। ইতোমধ্যে ১০ বা ১১ লাখ রোহিঙ্গার চাপে দুর্ভোগে বাংলাদেশ। নতুন জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গারা এই সংকট আরও বাড়াবে বৈকি! এসব রোহিঙ্গা বন ধ্বংস করছে, অস্ত্র লুট, খুন, ধর্ষণ ও মাদক বেচাকেনা করছে, এইডস ছড়াচ্ছে আর আর গর্ভবতীর সংখ্যা বাড়াচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, এক সাংবাদিককে রোহিঙ্গা নারী বলছেন তার ছয়টি ছেলেমেয়ে কম হয়ে গেছে। তিনি শিগগিরই আরো একটি সন্তান নেবেন। অবশ্য নেওয়ারই কথা। এমন আরাম-আয়েশে থাকা-খাওয়া আর আয় রোজগারের চিন্তা না থাকলে সন্তান নিতে অসুবিধা কোথায়। কিন্তু এসবের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশি মানুষের, বিশেষ করে কক্সবাজার জেলার ওপর। এই প্রভাব পড়ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর। ওরা কম টাকায় কাজ করে বলে স্থানীয় লোকজন কাজও পাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে স্থানীয়রা সেখানে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের বেপরোয়া আচরণ এবং অপরাধ প্রবণতার কারণে এরা যদি দীর্ঘদিন থাকে তবে নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে দেশ।এছাড়া বিভিম্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে। তারা বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে। তারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক ভারসাম্য, শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রাখাইন জনগোষ্ঠী সীমান্তে মাধকদ্রব্য পাচার, অস্ত্র ও মানব পাচার, চোরাচালান, সীমান্তে মাদক উৎপাদনসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজে লিপ্ত রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় অপরাধচক্র তৈরি করে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, জাতিগত নিরাপত্তা, জাতিগত পরিচয় ও আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতার মারত্মক ব্যত্যয় ঘটছে। এছাড়া জঙ্গীবাদের ঝুঁকিও থেকে যায়।


বছর ধরে নানামুখী বৈশ্বিক চাপেও এখনো অনড় মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ মিয়ানমার এখনো নেয়নি। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কার্যত কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে স্বাক্ষরিত চুক্তি এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুকিও রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে নীরব থেকেছেন। রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের উন্নয়নে আনান কমিশন গঠিত হলেও মিয়ানমার সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি বরং সুকি বলেছেন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অধিবাসী নয়। সুকির কথায় এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কখনোই আন্তরিক নয়। টালবাহানা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়াই তাদের মূল লক্ষ্য। তাই বৈশ্বিক চাপ ও মানবিকতার দোহাই কোনোটাই টলাতে পারেনি সুকি ও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের বরফ শীতল কঠিন হৃদয়। তবে থেমে নেই রোহিঙ্গাদের জীবন। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য বাজেট ঘোষণা করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছেন। আগের তুলনায় রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রার মান একটু উন্নত হয়েছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিজস্ব দেশ নয়। রোহিঙ্গাদের নিজস্ব দেশ আছে, ভূখণ্ড আছে। নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা পেলে তারা নিজ দেশে ফিরে যাবে। এই স্বপ্নটা রোহিঙ্গারা নিজেরাও দেখে। নিজ দেশে সবকিছু থাকতে কেউ কখনো পরদেশে শরণার্থী হয়ে থাকতে চায় না। এত কিছুর পরও একটা প্রশ্ন আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কি রাখাইনে আর কোনোদিন ফিরতে পারবে? উত্তরটি আমরা জানি না, এমনকি জানে না ভাগ্য বিড়ম্বিত স্বয়ং রোহিঙ্গারাও।

বাংলাদেশে যে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে এবং যাদের আশ্রয় দিয়ে একটি মানবিক জাতি হিসেবে বাংলাদেশে বিশ্বের কাছ থেকে সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়েছে, সেই শরণার্থীদের আমরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা জোর করে ফেরত পাঠাতে পারব না। আন্তর্জাতিক আইনও তা অনুমোদন করে না। বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তিতেও বলা আছে যে স্বেচ্ছায় যারা ফিরতে চাইবে, তাদেরই মিয়ানমার ফেরত নেবে। খুব সহজ প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে এখন যে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে, তারা কি আদৌ ‘স্বেচ্ছায়’ মিয়ানমারে ফিরতে চাইবে? নাকি একসময় স্থায়ী ভুখন্ডে সার্বভৌমত্বের দাবীতে বাংলাদেশের বিপক্ষেই আন্দোলন করবে?

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Comments are closed.