লালন-গুরু সিরাজ সাঁই : ভিন্ন দৃষ্টির পর্যবেক্ষণ

লালন-গুরু সিরাজ সাঁই : ভিন্ন দৃষ্টির পর্যবেক্ষণ

মোনায়েম সরকার: ১০ ফেব্রুয়ারি সকালে বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীন আমাকে ফোন করে বলেন, ‘আজ বাংলা একাডেমিতে গিয়ে একটি বই নিয়ে খুব হৈ চৈ শুনলাম। সৈয়দ জাহিদ হাসান ‘লালন-গুরু সিরাজ সাঁইয়ের গান’ নামের একটি গবেষণাগ্রন্থে নতুন কিসব তথ্য দিয়েছে যা নিয়ে খুব আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আপনি বইটি পড়ে একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখুন।’ ফরিদা পারভীনের সঙ্গে কথা শেষ করে আমি অন্য একটি টেলিফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং ‘লালন-গুরু সিরাজ সাঁইয়ের গান’ বইয়ের কথা রীতিমতো ভুলে যাই। আগে কোনো কিছু এত সহজে ভুলতাম না। আজকাল ভুলে যাই। বয়সের ধর্মই এই। ধীরে ধীরে সবকিছু ভুলিয়ে দিতে থাকে। ১২ ফেব্রুয়ারির ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার পাতায় হঠাৎ একটি বইয়ের আলোচনায় আমার চোখ আটকে যায়। এই বইটির নাম দেখেই আমার ফরিদা পারভীনের কথা মনে পড়ে। মনোযোগ দিয়ে লেখাটি পড়ি। আখতার হুসেন আমার খুবই প্রীতিভাজন। আখতার হুসেনের পা-িত্য ও শ্রমের প্রতি আমার বিশ্বাস সুগভীর। আখতার হুসেনের লেখা সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত বিশ্লেষণধর্মী আলোচনাটি পড়ে সৈয়দ জাহিদ হাসানের ‘লালন-গুরু সিরাজ সাঁইয়ের গান’ নিয়ে আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। এরপরে নাগরিক টিভিতে একদিন দেখি এই বইটি নিয়েই আলোচনা করছেন, ডা. আবদুন নূর তুষার। এরপরে বইটি আগামী প্রকাশনীর ২১ নম্বর প্যাভিলিয়ন থেকে সংগ্রহ করি এবং পাঠ করি।

আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী জনাব ওসমান গনির সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তিনি আমার অনেকগুলো বই প্রকাশ করেছেন। এবারের বইমেলায়ও তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে আমার দুটো গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে। যে বই সাড়া ফেলে সঙ্গত কারণেই সে বই নিয়ে মানুষ একটু আগ্রহী হয়। আমিও আগ্রহ ও কৌতূহলের কারণেই ‘লালন-গুরু সিরাজ সাঁইয়ের গান’ বইটির পাতা উল্টাতে শুরু করি। বইটির ভূমিকা পড়েই আমার মনোযোগ গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। একের পর এক পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে এক পাঠেই বইটি শেষ করি। আমি রাজনীতির মানুষ। আমার প্রিয় বিষয় রাজনীতি। আমার বেশির ভাগ লেখাই রাজনীতি সংক্রান্ত। ভেবেছিলাম সিরাজ সাঁইকে নিয়ে লেখা সৈয়দ জাহিদ হাসানের লেখা আমার মনোযোগ ধরে রাখতে পারবে না। কিন্তু প্রতিটি পৃষ্ঠাতেই যেই বই আকর্ষণ সৃষ্টি করে, পরবর্তী পৃষ্ঠায় নতুন তথ্যের পূর্বাভাস দিয়ে যে বই পাঠককে মানসিকভাবে সজাগ ও কৌতূহলী করে রাখে, সে বই শেষ না করে আর কোনো উপায় থাকে না।

এখানে উল্লেখ করতে চাই, বিখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষ যখন ‘মনের মানুষ’ সিনেমাটি নির্মাণ করেন, তখন তাঁর অনুরোধে ঢাকার পাঠক সমাবেশ থেকে ‘লালনসমগ্র’ কিনে নিয়ে কলকাতায় যাই গৌতম ঘোষকে দেওয়ার জন্য। ‘মনের মানুষ’ সিনেমার প্রিমিয়ার শো-তেও গৌতম ঘোষ ও তার স্ত্রীর অনুরোধে আমি উপস্থিত ছিলাম। ফরিদা পারভীন এই সিনেমায় গান করেন এবং বিবি রাসেল পোশাক-সজ্জায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বিবি রাসেল এখানে অভিনয়ও করেন। এরা দুজনেই আমার খুব প্রিয় প্রীতিভাজন। সৈয়দ জাহিদের বইতে বিবির সাক্ষাৎকারটি পড়ে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। কথাটি এজন্যই এখানে উল্লেখ করলাম যে, এই বইতে ‘মনের মানুষ’ সিনেমার প্রসঙ্গটিও উল্লেখ করা হয়েছে।

আমি জানতামই না, লালন-গুরু সিরাজ সাঁইকে নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ নেই এবং সৈয়দ জাহিদ হাসানের লেখা ‘লালন-গুরু সিরাজ সাঁইয়ের গান’ বইটিই এখন পর্যন্ত প্রথম এবং একমাত্র গ্রন্থ। সিরাজ সাঁই লালন ফকিরের দীক্ষাগুরু এবং পালকপিতা ছিলেন। ইদানীং সিরাজ সাঁইকে অস্বীকারের বিষয়টি আমিও কোনো কোনো মানুষের মুখে শুনেছি। সিরাজ প্রসঙ্গ নিয়ে লালনপন্থীদের ভেতরে যে এতটা দ্বন্দ্ব-সংঘাত ঘনীভূত হয়েছিল, সৈয়দ জাহিদ হাসানের তথ্যবহুল এই বইটি না পড়লে জানা হতো না। এই বইটি শুধু যে কিছু তথ্য দিয়েই পাঠককে ভুলিয়ে ফেলেছেন তা-ই নয়, এর সঙ্গে যুক্তির তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন লালনসঙ্গীতের সুরক্ষিত দুর্গে। তিনি অকাট্য সব যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন প্রচলিত ‘লালনসমগ্রগুলো’তে ‘সিরাজ সাঁই’ ভণিতার যে গানগুলো আছে সেগুলো মূলত সিরাজ সাঁইয়ের গান। তাঁর যুক্তি উপস্থাপনের যে কৌশল এবং ভাষা, তাতে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই সৈয়দ জাহিদ এ বিষয়টি নিয়ে লেগে ছিলেন। এ বইটি পাঠ করার পরে কয়েকটি বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল। যেমন, (১) বাংলাদেশে গবেষণাগ্রন্থও পাঠকের দৃষ্টি কাড়ে যদিও সেখানে নতুন আবিষ্কার থাকে। (২) আমাদের লেখকেরা শেকড় সন্ধানী হচ্ছেন। (৩) যুক্তির মাধ্যমে পুরাতন ধারণা চ্যালেঞ্জ করে নতুন চিন্তার সূর্যোদয় ঘটাচ্ছেন।

লালন সাঁইকে নিয়ে দেশ-বিদেশের অনেক খ্যাতিমান গবেষক গবেষণা করেছেন। অনেক প-িত ও প্রাজ্ঞজন ‘লালন সঙ্গীত’ সম্পাদনা করেছেন। সৈয়দ জাহিদ তাঁর এই গবেষণার মাধ্যমে  লালন ফকিরকে যেমন নবদৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন, তেমনি সিরাজ সাঁইয়ের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন। সিরাজ সাঁইকে নিয়ে এতদিন যে বিভ্রান্তি ছিল, আমি মনে করি সেসব বিভ্রান্তি তথ্যবহুল ও যুক্তিপ্রধান এই গ্রন্থটির মাধ্যমে অপসারণ হবে।

সৈয়দ জাহিদ তাঁর গ্রন্থে প্রাথমিকভাবে ১০১টি গান উল্লেখ করেছেন ‘সিরাজ সাঁইয়ের গান’ হিসেবে। এ গানগুলো এতদিন লালনের নামে ভুলভাবে প্রচলিত ছিল। এই ভুলভাবে প্রচলিত গানগুলো এতদিন পর্যন্ত কেন কারো মনে প্রশ্ন জাগালো না, সেটাই বড় আশ্চর্য লাগছে। সৈয়দ জাহিদ হাসান দীর্ঘদিন ধরেই বাউল-গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁর ‘লালন-অন্বেষণ’, ‘লালন-বিতর্ক’, ‘বাউলকোষ’ গ্রন্থগুলো খুবই প্রয়োজনীয় এবং প্রশংসার যোগ্য। আমি প্রথম যে অবজ্ঞা নিয়ে সৈয়দ জাহিদ হাসানকে পাঠ করা শুরু করেছিলাম, পাঠশেষে তাকে আমি অন্তরের অভিনন্দন জানাতে বাধ্য হচ্ছি। নিভৃতে, স্বউদ্যোগে, শ্রম স্বীকার করে এখন যারা গ্রন্থ রচনা করছেন, তারাই হবেন আগামী দিনের লেখক। তরুণদের লেখা আজকাল খুব একটা পড়া হয় না। সৈয়দ জাহিদ হাসান তাঁর ‘লালন-গুরু সিরাজ সাঁইয়ের গান’ গ্রন্থের  মাধ্যমে আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। একটি ছোট বইয়ের শক্তিও যে কত ব্যাপক এবং দূরপ্রসারী হতে পারে, ভেঙ্গে দিতে পারে পূর্ববর্তী সব ধারণা, খুলে দিতে পারে গবেষণার নতুন পথ, এই গ্রন্থটি পড়ে তা আবার উপলব্ধি করলাম।

এবারের বইমেলা নিয়ে এখন পর্যন্ত আমি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করিনি। প্রতিদিন বইমেলায় যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও একদিনের বেশি যেতে পারিনি। পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে বইমেলা সংক্রান্ত যে কোনো খবরই আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি। বইমেলায় মানসম্মত বই প্রকাশ না হওয়া, মুদ্রণ-বিভ্রাট, মেলার আয়তন ও নান্দনিকতার বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার প্রবণতা নতুন ঘটনা নয়। যে কোনো বৃহৎ আয়োজনে ত্রুটি থাকতেই পারে। আমি ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে ভাবি না, আমি ভাবি, বইমেলায় সাফল্যগুলো কি? এবারের বইমেলায় বেশ কিছু বই দেখলাম বিভিন্ন স্টলে, যেগুলো দেখে মনে হলো বাংলাদেশের লেখক সমাজ লেখায় যথেষ্ট মনোযোগী এবং বিষয় নির্বাচনে সাবধানী। প্রকাশকগণও বই প্রকাশের ক্ষেত্রে আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করছেন। দেশকে এগিয়ে নিতে লেখকদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা স্বপ্ন সৃষ্টি করেন সাধারণত মানুষের মনে। জনপ্রিয় বই মাত্রই গুরুত্বপূর্ণ বই, বিষয়টি সবক্ষেত্রে ঠিক নয়। এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কে কোন বই সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করবেন তা আমি জানি না। তবে ‘লালন-গুরু সিরাজ সাঁইয়ের গান’ বইটিকে বিশেষ কারণে আমি মনে রাখতে চাই। এ বিষয়টি যদি সত্যিই সমালোচকদের সমালোচনায় উত্তীর্ণ হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে শুধু নয়, বিশ্বে একটি নতুন ঘটনা ঘটবে। লালনদর্শনচর্চাকারীদের আবার নতুন করে গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে। সিরাজ সাঁইকে ফিরিয়ে দিতে হবে যথার্থ সম্মান। একজন পাঠক হিসেবে আমার প্রতিক্রিয়ায় শুধু এটুকুই বলতে চাই, দুই-একটি মুদ্রণ ত্রুটি ছাড়া সৈয়দ জাহিদ হাসানের ‘লালন-গুরু সিরাজ সাঁইয়ের গান’ আসলেই হৈচৈ করার মতো বই। এমন বই আলোচনায় এলে প্রকৃত লেখকরাই উপকৃত হবেন। 

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Comments are closed.