শৈলী-ব্রাইট মেধাবৃত্তি পাওয়া আশরাফুল-এর গল্প

শৈলী-ব্রাইট মেধাবৃত্তি পাওয়া আশরাফুল-এর গল্প

“সারাদিন রাজমিস্ত্রীর সহকারি হিসেবে কাজ করার পর সারারাত রিক্সা চালাই, ভাই। মা-বাবাকে সাথে নিয়ে অভাব অনটনের মধ্যে সংসার চালাতে গিয়ে আর পেরে উঠছি না। তার উপর আবার লেখাপড়ার খরচ, একটু সাহায্য করেন ভাই!”

-কথাগুলো এবারের শৈলী-ব্রাইট মেধাবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হওয়া আশরাফুল ইসলাম-এর।

মো. আশরাফুল ইসলাম হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার বুল্লা ইউনিয়নের সিং গ্রামের বাসিন্দা মো. আছকির মিয়ার ছেলে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে ৪র্থ। শচীন্দ্র কলেজে ডিগ্রী ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত সে। অভাবের সংসারে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করে সে। এসএসসি পাস করার পর হন্য হয়ে চাকরি খোঁজতে থাকে। কিন্তু চাকরি নামের সেই সোনার হরিণের দেখা মেলেনি কোথাও। যৌথ তিন ভাইয়ের অভাবের সংসারে অনেক কষ্টে দুই বোনকে বিয়ে দেয়া হয়। এরপর দুই ভাইকে বিয়ে করিয়ে যখন উন্নতির দিকে, তখনই ফাটল ধরে সংসারে। বিয়ের পর দুই ভাই-ই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মা বাবাকে নিয়ে বেকায়দায় পরে আশরাফুল। খোঁজতে তাকে চাকরি। আর এই দূর্বলতার সুযোগ নেয় তারই এক বন্ধু। সরকারি চাকরি দেয়ার কথা প্রতারণা করে সে (আশরাফুলের বন্ধু)।

গত শনিবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আশরাফুলের হাতে স্কলারশিপের চেক ও ক্রেস্ট তুলে দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ফজলুল জাহিদ পাভেল। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন- অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নুরুল ইসলাম, হবিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাখাওয়াত হোসেন রুবেল, শৈলী ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর মো. বশির আহমেদ, সোনালী ব্যাংক হবিগঞ্জ শাখার প্রিন্সিপল অফিসার ও ট্রাস্টিয়ান সভাপতি তোফায়েল মোস্তফা তরফদার, সাংবাদিক কাজল সরকার, এএম শাহ্ আলমসহ আরও অনেকে।

বর্তমানে আশরাফুল হবিগঞ্জ শহরের ফায়ার সার্ভিস রোড এলাকায় একটি বাসায় রাজমিস্ত্রীর সহকারি হিসেবে কাজ করছে। সেই সাথে শচীন্দ্র কলেজে ডিগ্রী ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত রয়েছে। মা-বাবাকে ভালো রাখতে একটি চাকরিতেই সে সন্তুষ্ট নয়। কঠোর পরিশ্রমি এই যুবক সারাদিন রাজমিস্ত্রীর সহকারি হিসেবে কাজ করার পর আবার রাতভর রিক্সা চালায়।

সকাল ১১টা থেকে রাজমিস্ত্রীর কাজে যেতে হয় তাকে। বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা কাজ করার পর বিকেল ৫টায় একটি টিউশন করায়। পরে কিছুসময় ঘুমিয়ে রাত ১২টার দিকে রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। নিরব রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে তখন গুরুত্বপূর্ণ কাজে রাস্তায় থাকা মানুষজনকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয় তার তিন চাকার রথটি দিয়ে। ভোর ৫টা পর্যন্ত চলে তার রিক্সা চালানো।

দিনরাত পরিশ্রম করা এই যুবকটি মা-বাবাকে সাধ্যমতো ভালো রাখলেও নিজে থাকে একটি চাপ্টা ঘরে। যেখানে রাজমিস্ত্রীর সহকারি হিসেবে কাজ করছে, সেখানেই একটি এক চালার চ্যাপ্টা ঘরে বসবাস করছে সে। কঠোর পরিশ্রমী এই যুবক এখন স্বপ্ন দেখে একটি সরকারি চাকরি করে মা-বাবাকে নিয়ে একত্রে বসবাস করবে।

আশরাফুল বলেন- ‘মা-বাবার সাথে একসঙ্গে বসবাস করতে চাই। কিন্তু আর্থিক অবস্থার কারণে বৃদ্ধ মা-বাবাকে গ্রামে রেখে আসতে হয়েছে। যখন যা প্রয়োজন পরে আমি আমার মা-বাবকে দিয়ে আসি। মায়ের রান্না করতে অনেক কষ্ট হয়, তাই প্রতিমাসে সিলিন্ডার গ্যাস দিয়ে আসি।’

ছবিতে আছেন আশরাফুল ইসলাম (বামে) এবং তার শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেওয়া সঙ্গীতা ভট্টাচার্য (ডানে)।

তারপরও কোন আক্ষেপ নেই জীবনের প্রতি, বরং অসাধারণ সব স্বপ্ন ঘুরপাক খায় তার মনে। কেউ কেউ তাকে প্রায়ই বলত পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের হাল ধরার জন্য, আশরাফুল তা করেনি, অদম্য মনোবল নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছে এখনও অবধি।

– এটাই আমাদের ‘আশরাফুল’-এর গল্প। এটাই ‘আশরাফুলদের’ গল্প। আশরাফুলকে নিয়ে আমাদের এরকম আরও অনেক গল্প আছে। এমনসব দরিদ্র আর মেধাবী মানুষদের পাশে দাঁড়াতে চায় শৈলী ফাউন্ডেশন। সত্যিকার অর্থে, এইসব ছেলেমেয়ের পাশে এসে দাঁড়ানোর পর আমাদেরই দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গেছে। আমরা না, এই অসম্ভব উদ্যমী ছেলেমেয়েগুলোই যেন আমাদের প্রতিনিয়ত আঙ্গুল তুলে দেখাচ্ছে জীবনের নিগৃড় অর্থ।

আশরাফুলের ২০১৯-২০২০ সালের বৃত্তির খরচ বহন করেছেন সঙ্গীতা ভট্টাচার্য, যিনি কানাডার Lethbridge ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে, এখন কানাডার একটি স্বনামধন্য কোম্পানীতে কর্মরত আছেন। সঙ্গীতাদীর প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। এবছর যখন শৈলী-ব্রাইট শিক্ষাবৃত্তি র জন্য স্পন্সর খোঁজা হচ্ছিল, সঙ্গীতাদী তখন এগিয়ে আসলেন একজন মেধাবীর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। আশরাফুলের একবছরের বৃত্তির সমস্ত খরচ বহন করবেন তিনি। শৈলী ফাউন্ডেশন পরিবারের পক্ষ থেকে সঙ্গীতাদী-কে অনেক অনেক ধন্যবাদ, বিশেষ করে মাতৃত্ব-কালিন ছুটিতে থাকাকালীন সময়েও এগিয়ে আসার জন্য । শিক্ষাবৃত্তির পাশাপাশি সকল স্কলারকে দেওয়া হবে মানবিক এবং উচ্চশিক্ষার সহায়তা। স্কলার-এর সুনিদিষ্ট স্বপ্ন বাস্তবায়নে শৈলী ফাউন্ডেশন টিম সবসময় পাশে থাকবে। অল্প কিছু কন্ট্রিবিউশন আমাদের এই মেধাবীদের জন্য কী অসাধারণ ভূমিকা রাখবে, এটা ভাবতেই আমাদের ভাল লাগে। কৃতজ্ঞতা এবছর সকল স্কলারের ‘দায়িত্ব নেওয়া’, অথবা ‘নিতে চাওয়া’ আমাদের প্রত্যেক স্পন্সরকে।

এই মানবিক কাজে আমাদেরকে যে শৈলী প্রতিনিধি এবং কো-অর্ডিনেটর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তিনি ডাচ-বাংলা ব্যাঙ্ক এর রিলেশন ম্যানেজার, আমাদের শ্রদ্ধেয় বশীর আহমেদ ভাই, যাকে ধন্যবাদ দিলেও অনেক ছোট করা হয়ে যাবে। পাশাপাশি, সাংবাদিক কাজল সরকার এর আন্তরিক সহায়তা এবং এই বিষয়টি আমাদের কাছে বিস্তারিতভাবে তুলে নিয়ে আসার ব্যাপারে সহায়তার বিষয়টি শৈলী ফাউন্ডেশন কৃতজ্ঞচিত্তে স্বরণ করে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ফজলুল জাহিদ পাভেল সাহেবকে আমরা আন্তিরক ধন্যবাদ জানাই পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করার জন্য।

গত শনিবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আশরাফুলের হাতে স্কলারশিপের চেক ও ক্রেস্ট তুলে দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ফজলুল জাহিদ পাভেল। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন- অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নুরুল ইসলাম, হবিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাখাওয়াত হোসেন রুবেল, শৈলী ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর মো. বশির আহমেদ, সোনালী ব্যাংক হবিগঞ্জ শাখার প্রিন্সিপল অফিসার ও ট্রাস্টিয়ান সভাপতি তোফায়েল মোস্তফা তরফদার, সাংবাদিক কাজল সরকার, এএম শাহ্ আলমসহ আরও অনেকে।

পাদটীকা: সাংবাদিক কাজল সরকার এর প্রতিবেদন এবং শৈলী ফাউন্ডেশনের এর রিপোর্ট এর সম্মিলন করে এই ছবি এবং বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়েছে।
যোগাযোগ : info@shoilyfoundation.org

বিস্তারিত: http://shoilyfoundation.org/

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Comments are closed.