সততা, সংযম, সভ্যতা কি হারিয়ে যাচ্ছে

সততা, সংযম, সভ্যতা কি হারিয়ে যাচ্ছে

সৈয়দ জাহিদ হাসান: পৃথিবীর বাতাস নানা কারণেই দূষিত হয়ে উঠছে। শুধু পরিবেশদূষণেই পৃথিবীর চরম ক্ষতি হচ্ছে এমন নয়, মানবিক আচরণের দৃশ্যমান ঘাটতিও বিপর্যন্ত করে তুলছে পৃথিবীর পরিবেশ। বিশ্বের ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হয়তো জনসমক্ষে স্বীকার করবেন না, কিন্তু এ কথা মিথ্যা নয় যে, রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার বহির্ভূত কর্মকা- দিন দিন মানুষকে গভীর, গহিন হতাশার মধ্যে নিক্ষেপ করছে। পৃথিবীর সব দেশেই এখন সততা, সংযম ও সভ্যতার বড় অভাব দেখা যাচ্ছে। আজকের পৃথিবীতে মানুষ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে বিজ্ঞানের কল্পনাতীত শক্তি। বিজ্ঞানের শক্তি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রাণপণ চেষ্টা করলেও, মানবিক উন্নতির বেলায় রাষ্ট্রনায়কগণ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন।

রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান কাজই হলো মানবিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষের চেতনার সুপরিবর্তন ঘটানো। চেতনার পরিবর্তন এই কারণে প্রয়োজন যে, আদর্শগতভাবে মানুষ যা আঁকড়ে ধরে সেই লক্ষ্যেই সে এগিয়ে যেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। বিপ্লব-পূর্ব পরিস্থিতিতে তাই বিপ্লবী নেতাগণ এজন্যই শোষিত মানুষের সামনে বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে জনমত গড়ে তোলেন। ইদানীং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে স্বার্থগত বিষয়ে যতটা তৎপর দেখা যায়, চেতনাগত পরিবর্তনে ততটা নিষ্ক্রিয় বলেই মনে হচ্ছে। লোভের পায়ে মাথা নত করে সেবার আদর্শ ভুলতে বসেছে সবাই। দুই একজন নেতা-নেত্রী যে ব্যতিক্রম নেই, তা নয়। তবে ব্যতিক্রমধর্মী নেতা-নেত্রীগণ কখনোই সম্মানের সঙ্গে আলোচনায় আসছেন না। দুঃসংবাদ যত দ্রুত বাতাসে ভেসে আসে, সুসংবাদ কী তত জোরে প্রবাহিত হয়?

সততার শিক্ষা নিয়ে এখন কেউ আর এগিয়ে যেতে চাচ্ছে না। সমাজে যারা সৎ জীবনযাপন করছেন, তারা বেশির ভাগই অর্থহীন, ক্ষমতাহীন এবং অপাংক্তেয়। সততার আদর্শ আঁকড়ে পড়ে থাকা মানুষগুলো বেঁচে থেকেও যেন জীবন্মৃত। নষ্টদের অধিকারে যাওয়া সমাজ কাঠামোর ভেতরে একজন শুদ্ধ চিত্তের মানুষ কতটা অসহায় হয়ে দিনযাপন করে তা আজ আমরা কেউই উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি না। সততা নির্বাসিত করে যারা মিথ্যা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়, তারা কি আসলেই বাঁচার মতো বেঁচে থাকতে পারে?

সততার সঙ্গে সঙ্গে সংযমও আজ আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। সংযম হলো সততার সৌন্দর্য। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে সংযমই সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। পশুদের সমাজে কোনো সংযম থাকে না। সেখানে থাকে পাশবিক শক্তির উদ্দাম আধিপত্য। আধিপত্যবাদীরা কখনোই স্থিতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না। আজ আমাদের চারপাশে আসুরিক শক্তির অস্বাভাবিক উত্থান ঘটেছে। পরমতসহিষ্ণুতা এখন কেবলই অভিধানে আটকে আছে, বাস্তবে এই শব্দটির ব্যবহার একদম নেই বললেই চলে। যেখানে ভিন্নমতের কাউকে সহ্য করা হয় না, সংযমের কোনো চর্চা করা হয় না, সেই সমাজ কী আসলেই মানুষের সমাজ বলে গণ্য হতে পারে?

আজ আমরা প্রতিদিনই অসভ্যতার মহড়া দিচ্ছি। প্রতিদিনই আমরা প্রতারণা করছি সভ্যতার সঙ্গে। তবু মুখে মুখে নিজেদের ‘সভ্য’ বলে প্রচার করতে আমরা লজ্জাবোধ করছি না। এদেশের সরকার জানে, বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের উপার্জন কিছুতেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তিনদিন প্রাণান্ত পরিশ্রম করলেও একজন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ একদিন সুষম খাদ্য কিনে খেতে পারে না। তবু আমরা বলছি ভালো আছি। এভাবে ভালো থাকার অভিনয় মানুষকে আর কত দিন করে যেতে হবে?

মিথ্যা-হাসি ঠোঁটে ঝুঁলিয়ে আমরা সুখী হওয়ার ছলনা করে তৃপ্ত হতে চাচ্ছি। আসলেই কি আমরা সুখে আছি। বিশ্বের এমন কোনো দেশ বোধ আজ আর অবশিষ্ট নেই যারা বলতে পারে, আমরা ‘সভ্য’। যে সমাজে শোষণ আছে, ধর্ষণ আছে, দুর্নীতি আছে, চোরাকারবারি আছেÑ সে সমাজ সভ্য হয় কী করে? পেটের দায়ে চুরি করা আর সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য চুরি করা কী একই অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে? যাদের অনেক আছে, তারা আরো অনেক কিছু হাতিয়ে নিতে ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত। এসব অসভ্যদের নাগপাশ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হবে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমাজ এখন অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে। একরাশ কালো কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে আমাদের স্বপ্ন, আশা, সুন্দর কল্পনা। আমরা বার বার উঠে দাঁড়াতে চাইছি, কিন্তু বার বারই হাঁটু ভেঙে পড়ে যাচ্ছি চোরাবালির গভীর গর্তে। নেতা এখন নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পূরণ করতে পারছে না, আইন-কানুনও নিরাপত্তা দিতে অপারগতা প্রদর্শন করছে। আজ আমাদের নতুন আশায় বুক বাঁধার কোনো কারণ চোখে না-পড়লেও আশায় বুক বাঁধতে হবে। জীবন কখনোই শেষ হয়ে যায় না। যেকোনো জায়গা থেকেই জীবনকে শুরু করা যায়, শুধু একটু উদ্যম থাকা চাই। সততা, সংযম, সভ্যতাই মানুষের মহত্ত্বকে বিকশিত করে। মহত্ত্ব-মনুষ্যত্ব না থাকলে মানুষের মূল্য কিসে? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনÑ ‘সত্য যে কঠিন/কঠিনেরে ভালোবাসিলাম/সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ আজ আমাদের কঠিন সত্যকেই আপন করে নিতে হবে। যদি আমরা মানুষের জন্য মানবিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইÑ তাহলে সত্যকে হাসিমুখে গ্রহণ করার বিকল্প নেই।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.