মোনায়েম সরকার: জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ৮৩ বছর বয়সে আকস্মিকভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তার মহাপ্রস্থান বাঙালি জাতির জন্য বিষাদের কারণ তো বটেই, সেই সঙ্গে বাঙালিরা একজন সর্বমান্য অভিভাবকহীন হলো। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন কৃতিসন্তান আমাদের সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে মরণ-সাগর পার হয়ে অসীমের যাত্রী হয়েছেন। জামিলুর রেজা চৌধুরী, সাদাত হোসাইন, আনিসুজ্জামান, দেবেশ রায়সহ অন্যান্য যারা আমাদের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত ছিলেন, মৃত্যুর ঝড়ো হাওয়ায় তাদের নিভে যাওয়া আমাদের বিহ্বল করেছে, বেদনার্ত করেছে। মৃত্যু শব্দটি খুবই নির্মম , হাহাকারে ভরা, আমরা যখন সকল দুঃসময় পেছনে ফেলে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম; অপসংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতার শিকল ছিঁড়ে নতুন জীবনের অঙ্গীকারে সবাই ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিলাম এমন সময়ে আলোকবাহকদের অকাল প্রয়াণ কিছুটা হলেও আমাদের সম্মিলিত চলার গতি মন্থর করে দেবে। আমাদের চেতনায় সদ্যপ্রয়াত এইসব মহীয়ান মানুষেরা অমর হয়ে থাকবেন। আমরা চিরদিন এদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করব।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে আমি ‘আনিস ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। বয়সে তিনি আমার চেয়ে আট বছরের বড় হলেও তার সঙ্গে আমি বন্ধুর মতো মিশেছি। বন্ধুর ভালোবাসাই তার কাছ থেকে চিরদিন পেয়েছি। অত্যন্ত সদালাপী, আর মিষ্টিভাষী মানুষ ছিলেন আনিস ভাই। যেকোনো অনুষ্ঠানে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের প্রাণিত করতো, অনুষ্ঠানে ভিন্নমাত্রা যোগ করতো। চারুবাক বক্তা হিসেবে দেশে-বিদেশে তিনি যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
ষাটের দশক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সুবর্ণ সময় ছিল। সে সময়ে সেলিমা আফজালের সূত্রে (আনিস ভাইয়ের ভাগ্নি) আনিস ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত হয়। সেলিমা বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিল। আমরা তখন কাকরাইলে থাকতাম। সেলিমারাও কাকরাইলে বাস করতো বিধায় মাঝে মাঝে ওদের বাসায় যেতাম। সেলিমাদের বাসায়ই আনিস ভাইকে আমি প্রথম দেখি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আপ্লাইড ফিজিক্সে পড়াশুনা করলেও সেলিমাদের সঙ্গে বাংলা প্রচলন সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। ১৯৬৫ সালে বাংলা প্রচলন সমিতির সদস্যরাই প্রথম বাংলা বইয়ের মেলা করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ২০১৫ সালে আমার সত্তরতম জন্মদিন উদ্যাপন অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তৃতায় এই বিষয়টি নিয়ে আনিস ভাই তার স্মৃতি থেকে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা শুনে আমি নিজেই বিস্মিত হয়েছিলাম, আনিস ভাইয়ের স্মৃতি অত্যন্ত প্রখর ছিল। একবার তিনি কোনো কথা শুনলে বা পড়লে তা কখনো ভুলতেন না। তার সাথে অনেক মিটিং-মিছিলে আমি অংশগ্রহণ করেছি। মিটিং শেষে অবসর অনুযায়ী তিনি যখন আমাদের ২৩ চামেলীবাগের বাসায় আসতেন, আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে তার জ্ঞানগর্ভ, বুদ্ধিদীপ্ত আলাপ থেকে উপলব্ধি করতাম আসলেই তিনি জ্ঞানসাধক ছিলেন।
আনিস ভাই যে সর্বজনের আস্থার প্রতীক ছিলেন তার প্রমাণ আমি বহুবার পেয়েছি। কোনো মিটিংয়ের ড্রাফট যখন আনিস ভাইয়ের হাত দিয়ে সম্পাদিত হতো তখন সেই ড্রাফট দেশের সব বুদ্ধিজীবীই একবাক্যে সমর্থন দিত। কবীর চৌধুরী হোক আর সালাউদ্দীন আহমদই হোক আনিস ভাইয়ের ড্রাফট প্রত্যেকেই অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন দিত। আজ অনিস ভাই নেই, কিন্তু তার অসংখ্য স্মৃতি আমাকে এবং আমার মতো আরো অনেককেই আবেগতাড়িত করছে।
আনিস ভাই একসময় আফসোর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮১ সালে একবার তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে আমরা বেশ কয়েকজন দিল্লি সম্মেলনে যোগ দিতে যাই। আমাদের সেই প্রতিনিধি দলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছিলেন। শেখ হাসিনা তখন সবেমাত্র আওয়ামী লীগের রাজনীতির হাল ধরেছেন। তিনি গেস্ট অব অনার হয়ে আনিস ভাইয়ের নেতৃত্বে দিল্লির সেই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। কোনো সভার সভাপতি হওয়ার জন্য কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে আনিস ভাইকে অনুরোধ করলে হাসিমুখেই তিনি সেই অনুরোধ রক্ষা করেছেন। তার হাতে সময় থাকলে শুধু আমি নই, কাউকেই তিনি ফিরিয়ে দিতেন না। ‘না’ এই শব্দটি বলতে সম্ভবত তার রুচিতে বাঁধতো। কোনো শুভ কাজে কখনোই আমি তার মুখ থেকে ‘না’ শব্দটি শুনিনি, হোক সেটা কারো ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান কিংবা জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশের সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শামস কিবরিয়া নির্মম গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুবরণ করলে আমরা একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করি। সেই স্মারক গ্রন্থের নামকরণ কী হবে এটা নিয়ে যখন আমাদের সম্পাদনা পরিষদ চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত তখন আনিস ভাইয়ের শরণাপন্ন হলে তিনি ‘শামস কিবরিয়া : নিরন্তহর প্রেরণা’ নামকরণ করে আমাদের চিন্তামুক্ত করেন।
২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি আমাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করলে আনিস ভাইয়ের হাত থেকে আমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ সনদ গ্রহণ করি। আমার সত্তরতম জন্মদিনে তিনিই নিবিড় ভালোবাসায় আমাকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন। আজ যখন পেছন ফিরে সেসব দিনের কথা মনে করি তখন অজান্তেই দুচোখের পাতা বেদনায় সিক্ত হয়ে ওঠে। ভাবতেই পারি না যে আর কখনো আনিস ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে না, কথা হবে না, আড্ডা জমে উঠবে না। বড় অসময়ে চলে গেলেন আমাদের সকলের প্রিয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তার আকস্মিক শূন্যতা মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করবে সমগ্র বাংলাদেশ।
আনিস ভাই সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। একজন সাহিত্যমনস্ক মানুষ হয়েও রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে তার পদচারণা ছিল লক্ষণীয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলে আনিস ভাই ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলেন। মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশের পক্ষে সোচ্চার হতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হলে সেই সংবিধান বাংলায় রূপান্তরের কাজে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেন। কর্মনিষ্ঠ আনিস ভাইকে কোনো কাজের দায়িত্ব দিলে তিনি কখনোই শৈথিল্য প্রকাশ করেননি। অত্যন্ত সুচারুভাবেই তিনি তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। প্রতিটি মানুষকে তার স্বকীয় কর্মই মহান করে তোলে। আনিস ভাইয়ের কর্মই আনিস ভাইয়ের সবচেয়ে বড় পরিচয়। তার কর্মক্ষেত্র এত বিশাল আর বিস্তৃত ছিল যে ভাবলেই বিস্মিত হতে হয়। আনিস ভাই তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন পুরস্কারেই ভূষিত হননি, ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদকেও সম্মানিত হন, যা আমাদের জন্য গৌরবের।
আনিস ভাইয়ের পা-িত্য নিয়ে মূল্যায়ন করার জ্ঞান ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই। আমি তার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ও পাঠক। পাঠক হিসেবে শুধু এটুকুই বলব, তিনি যখন কোনো কিছু বিশ্লেষণ করতেন তখন খুব গভীরে গিয়েই সেই বিষয়টি দেখার চেষ্টা করতেন। তাঁর বিপুলা পৃথিবী, কাল নিরবধি, আমার একাত্তর গ্রন্থগুলো সুখপাঠ্য ও তথ্যবহুল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মুসলিম সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের নিয়ে যে ব্যতিক্রমী গবেষণা ও দৃষ্টিভঙ্গি তা দুই বাংলাতেই বিরল। বাংলা প্রাচীন গদ্যের প্রচলিত ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টি দিয়ে দেখে তিনি যে অভিনব তথ্য প্রদান করেছেন সেটাও একটি মাইলফলক কাজ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ভাষা-আন্দোলন এবং বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে তিনি যেসব প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছেন সেসবের মধ্যেও তাঁর সচেতন মনের নিরপেক্ষ অনুসন্ধান দুর্লক্ষ্য নয়।
আনিস ভাই ইচ্ছে করলেই অনেক সামাজিক ও রাষ্ট্রিক দায় এড়াতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। যখনই বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কালো ঝড় প্রবল হয়ে উঠেছে তখনই তিনি বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছেন সেই ঝড়ের বিরুদ্ধে। রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচারের পক্ষে তার বিবৃতি যেমন আমাদের অবাক করে, তেমনিভাবে বিস্ময় জাগায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে তার সাহসী মতামত। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে তিনি যেমন অগ্রণী ছিলেন, স্বৈরাচারবিরোধী তীব্র আন্দোলনেও তাঁর অসামান্য ভূমিকা ছিল। আপস তার চরিত্রে কখনো স্থান পায়নি। সত্য-ন্যায়ের বাতিঘর হয়ে সবসময় তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পুরোভাগে থেকে। বাঙালি জাতির অভিযাত্রার পথে যেসব আলোকাভিসারী মনীষীপুরুষ আত্মনিবেদন করেছেন অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামান তেমনি একজন মৃত্যুঞ্জয় মহিয়ান। তাঁর অকাল প্রয়ানে গভীর বেদনাবোধ করছি। জয়তু আনিসুজ্জামান।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।