ড. মাহফুজ পারভেজ
আজকের কলামের এই ‘হুমায়ূননামা’ মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের কথা নয়; বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট হুমায়ূন আহমেদের প্রসঙ্গে। গতকাল ১৯ জুলাই ছিল তাঁর প্রথম মৃত্যুবাষির্কী। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার জন্য গিয়ে সেখানেই মৃত্যুর না-ফেরার দেশে তিনি মায়াবী প্রস্তান করেন। তাঁর মৃত্যুতে বেদনা ছিল, রহস্য ছিল, প্রশ্ন ছিল। ছিল মানুষের আপ্লুত ভালোবাসা। কোনও সমাজ বা রাজনৈতিক নেতার চেয়ে অধিক ছিল তাঁর মৃত্যুতে ব্যথিত মানুষের সমাবেশ। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক সময়ে জীবনের সমকালের জনপ্রিয়তা মৃত্যুর পরেও দখল করতে তাঁর মতো আর কেউ পেরেছে কি-না জানি না। অন্তত আজকের বাংলাদেশে তো নয়ই। তাঁর মৃত্যু এখনও ছুঁয়ে যায় মানুষের অন্তর।
মহাকালের ‘অনন্ত নক্ষত্র বীথি’র পথে চিরদিনের জন্যে চলে গেছেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ভাটীবাংলার জলমগ্ন হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে ভেসে। অপরূপ জোছনার স্মৃতিতে ভিজে ভিজে ‘শ্রাবণ মেঘের দিনের’ অন্বেষায়। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু এমনই এক চলে যাওয়া, যার অন্য নাম ‘মায়াবী প্রস্থান’। বাংলাদেশের মানুষ আর প্রকৃতির যাবতীয় সত্ত্বাস্পর্শী সেই চিরযাত্রাপথ। ক্ষণিকের এ প্রস্থান কখনোই বিদায় নয়। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ক্যানভাস জুড়ে তিনি আছেন তার অমর লেখনির মাধ্যমে।
গোড়ার দিকে নগন্য সংখ্যক অতি-আঁতেল ধরনের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ছিলেন তাঁর সমালোচক। সমঝদার ছিলেন বৃহত্তর পাঠক শ্রেণী। তিনি পাঠ-বিপ্লবের প্লাবনে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তুচ্ছ বিরোধিতা। পরিণত হয়েছিলেন অখ- বাংলার কথা সাহিত্যের এক ও অনন্য আইকনে। ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ বলতে সত্যি সত্যিই যদি কাউকে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে তিনি অবধারিতভাবে হুমায়ূন আহমেদ। ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তার জাদুকরি ছোঁয়ায় তিনি বাংলা সাহিত্যের মরা গাঙে প্রাণের বন্যা জাগিয়েছেন।
জন্মে ছিলেন হাওর জনপদের উত্তর-পশ্চিম তীরের বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোণায়। বেড়ে ওঠেছিলেন হাওরের পূর্ব পার্শ্বস্থ সিলেটের মীরাবাজারে। তারপর বৃহত্তর বরিশালের শ্যামল পিরোজপুরে এবং বাংলাদেশের আরও কিছু চমৎকার স্থানে। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও উত্তর আমেরিকার নর্থ ডেকোটায়। কর্মসূত্রে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্লকালীন শিক্ষকতার পর বহু বছর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণে পূর্ণকালীন আত্মনিয়োগের প্রয়োজনে এক সময় ছেড়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা। তাঁর জন্যে নিরাপদ পেশা ছেড়ে সাহিত্যাঙ্গনে চলে আসার প্রয়োজন ছিল। কেননা প্রবল পাঠক প্রত্যাশার কারণে তাঁকে অবিরাম লিখতে হয়েছে। একুশের মেলায় তার বই বের হলে একাধিক সংস্করণ হয়েছে। একেকটি সংস্করণ ২০-২৫ হাজারের কম হয় নি। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে হুমায়ূনের একেকটি বই। অটোগ্রাফের ভিড় সামলাতে তাঁর আশে-পাশে নিয়োজিত করা হতো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। তুঙ্গস্পর্শী, বিরল ও অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি।
গল্প-উপন্যাস লেখা, নাটক রচনা, চলচ্চিত্র নির্মাণ, যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন তিনি। ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘নন্দিত নরকে’ দিয়ে শুরু। তারপর স্রোতধারার মতো তাঁর সোনালি কলম ছুটে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ‘৭১’, ‘জোসনা ও জননী’। প্রেমের, বিরহের, বেদনার শত শত গল্প-উপন্যাস হুমায়ূন আহমেদের হাত দিয়ে পাঠক চিত্তে স্থায়ী আসন করে রেখেছে।
মনে রাখা দরকার যে, মৃত্যুর কিছু বছর পর, সামাজিক তো বটেই, পারিবারিক অঙ্গনেও অনেকই বিস্মৃত হন। নিদেন পক্ষে কেউ কেউ থেকে যান মোহাফেজখানার প্রায়োন্ধকার প্রকোষ্ঠে কিংবা বিশেষায়িত গবেষণার পাদটীকায় এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিতর্পণে। হুমায়ূন আহমেদের অবস্থান ঠিক কোথায়? মৃত্যুর এক বছর পর সামাজিক জীবনের প্রবহমান ভাব ও চিন্তার তরঙ্গে তিনি কতটুকু আন্দোলিত? তাঁর সাহিত্য ও চলচ্চিত্র সমকালকে পেরিয়ে মহাকালের পথে কতটুকু এগিয়েছে? প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আবেগের ফেনা সরিয়ে বিশ্লেষণের এ রকম নানা কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ, যিনি জনপ্রিয়তা ও লেখক সত্তায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট প্রতিভা।
মৃত্যুর পর হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আবেগ-উচ্ছ্বাস-আনুষ্ঠানিকতা যতটুকু হয়েছে, পর্যালোচনা-মূল্যায়ন-সমীক্ষা ততটুকু হয় নি। প্রকাশকরা তাঁর জাদুকরী ইমেজকে ব্যবসায় যেমনভাবে কাজে লাগিয়েছেন, জনপ্রিয় পত্রিকাগুলোও তেমনিভাবে তাঁর বৈচিত্রপূর্ণ বিষয়সমূহ, ব্যক্তিগত জীবন ইত্যাদিকে উপজীব্য করে হরেক রকমের ফিচার সাজিয়েছে। কেউ কেউ হুমায়ূনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সূত্র ধরে নিজেকে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় করবার প্রয়াসও নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর জীবন, সাহিত্যকীর্তি, চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গে গভীর গবেষণার প্রমাণ এখনও কেউ রাখতে পারেন নি। এর কারণ কি এটাই যে, তাঁর টিনএজ পাঠকেরা রস-কষহীন গবেষণায় আগ্রহী হবেন না, ফলে এমন বই লিখে বিখ্যাত হওয়া যাবে না; ব্যবসাও করা সম্ভব হবে না। যদি তাই ধরে নিই, তারপরেও মানতে হবে যে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি তাঁকে ছাড়া অনুধ্যান করা অসম্ভব। সেইক্ষেত্রেও তো কোনও বিদ্যায়তনিক গবেষক-শিক্ষক-প-িত এগিয়ে আসেন নি। এই অনাগ্রহের কারণ কি হুমায়ূনের জনপ্রিয়তার সামনে নিজেদের হীনমন্যতা, নাকি অন্য কিছু, সেটা জানার অধিকার থেকে আজকে না হলেও একদিন মানুষ প্রশ্ন উত্থাপন করবেই। কারণ হুমায়ূন আহমেদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আকস্মিক বুদ্বুদ মাত্র নন, তিনি মহাকালের নিরিখে অঙ্কিত স্থায়ী অস্তিত্ব। হুমায়ূন নামের মেটাফর। স্বনির্মিত সড়ক। যে সড়ক পথে শিল্প ও সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করে একবিংশ শতকের বাংলাদেশের তারুণ্য। বললে অত্যুক্তি হবে না, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে হুমায়ূনের ছায়ার; তাঁর চেতনা-প্রবাহের সমান্তরালে। হুমায়ূন আহমেদের কোনও বই পড়ে নি, এমন একজনও শিক্ষিত কিশোর-তরুণ-যুবক বাংলাদেশে পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ। এমন ঐন্দ্রজালিক প্রতিভার বিশ্লেষণ যত না হয়েছে, তাঁকে নিয়ে আবেগ-উচ্ছ্বাস হয়েছে ঢের বেশি। ফলে দোষে-গুণে ব্যক্তি হুমায়ূনকে মানুষ যতটুকু চিনেছে, সাহিত্যিক প্রতিভার ‘হুমায়ূন-ব্যক্তিত’¡ ততটুকু বুঝতে পারে নি। তাঁর জীবন ও কর্মের বহুমাত্রিক দিক নিয়ে গবেষণার নিরিখে তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন করা এখনও সম্ভব হয় নি। এটা দুঃখজনক যে, তাঁর মতো একজন জনপ্রিয় সাহিত্যিককে বই বিক্রি ও প্রকাশনা-বাণিজ্যের কাজে যতটা ব্যবহার করা হয়েছে; বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান ও অবস্থান সম্পর্কে ততটা গবেষণা হয় নি। ভাবখানা এমন যে, যতদিন বই বিক্রি হবে, ততদিনই হুমায়ূনকে আমাদের দরকার, তারপর নয়। হুমায়ূনের জীবনে এটাও এক নির্মম সত্য যে, শেষ পর্বে তিনি প্রকাশনা জগতের একদল বেনের কবলে পড়েছিলেন। যারা হুমায়ূনের শত শত গ্রন্থ প্রকাশ করলেও হুমায়ূনের মূল্যায়ন বা গবেষণাভিত্তিক কোনও একাডেমিক মূল্যায়ন-প্রবন্ধ-পুস্তক প্রকাশ করে নি এবং এসব প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত অনুভব করার দরকার মনে করে না। হুমায়ূনের দুর্ভাগ্য যে, তিনি শুধু দিয়েই গেলেন; পেলেন খুবই কম। অর্থ-বিত্ত কিছুটা পেলেও সাহিত্যিক স্বীকৃতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহাসিক ময়দানে তাঁর যোগ্য জায়গাটি তিনি এখনও পান নি।
হুমায়ূন আহমেদের মেধা, পড়াশোনা, আগ্রহবৈচিত্র শুরু থেকেই নির্মাণ করতে পেরেছিল এমন এক ভাষা ও জগত, যা শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত মানুষকে আবার নতুন উৎসাহে ও প্রবল বেগে টেনে নিয়ে গিয়েছিল টেলিভিশনের পর্দায়, সিনেমা হলে, বইয়ের পাতায়। আধুনিক মানবজীবনের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক সংগ্রামশীলতা, সঙ্কট, আশা ও বেদনার নিজস্ব ভূগোলে মানবিক উত্তরণের একটি মহৎ উপলব্ধি ও বোধের অতি সূক্ষও নকশা তিনি এঁকেছেন তাঁর প্রায়-সকল কাজেই। জাতির ইতিহাসবোধের সঙ্গে ব্যক্তিচেতনার সংশ্লেষে তাঁর হাতে নির্মিত হয়েছে যে সামাজিক ভাষ্য, বাঘা রাজনীতিবিদ ও দুঁদে সামাজিকগণও সেটা তুলে ধরতে পারেন নি। মানুষের দুঃখবিলাসের মেকি জীবন-যাপনের ধীরগতি ধূসরতা ও মেলানকলিয়ার আত্মধ্বংসী হতাশার জায়গাটিকে তিনি অপার্থিক আশাবাদ ও আনন্দে জারিত করেছেন। বাংলাদেশের মানুষকে, আধুনিক মননকে তিনি যেভাবে বুঝেছেন, যেভাবে আন্তরিক ভালোবেসেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে এবং চিরায়ত বাংলার লোক-লোকান্তরের ভাব-সম্পদকে, সেটারই নান্দনিক প্রকাশ মূর্ত হয়েছে তাঁর নাটকে, চলচ্চিত্রে, গল্পে, উপন্যাসে। তিনি কদাচ নকল, সাজানো, গন্তব্যহীন পথে হাঁটেন নি। দুঃখের গভীর-গহন থেকে আবিষ্কার করেছেন অনাবিল উচ্ছ্বাস। শাণিত বুদ্ধির ঝলক, কৌতুক, গাম্ভীর্য, সংলাপের দীপ্তি, শব্দসম্ভার, কাহিনীর বহুমাত্রিক চমক হুমায়ূনের ছবি বা বইকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তাঁর কোনও সৃজনই কখনও দর্শকদের বিরক্তির কারণ হয় নি। তাঁর ছবি না-দেখে ওঠে গেছে বা বই শেষ না করে রেখে দিয়েছে,এমন ঘটনা বিরল। সেটা ‘ঘেটুপুত্র’ বা ইতিহাসের ‘বাদশাহ নামদার’ বা মনোজাগতিক সমীক্ষণের ‘কবি’ কিংবা ‘মেঘ বলেছে যাবো যাবো’, যে কাজই হোক। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের আধুনিক প্রকাশনাকে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন হুমায়ূন আহমেদ। ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তার আইকনে পরিণত হন তিনি উভয় বাংলায়। মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সমকক্ষ নন হুমায়ূন আহমেদ, তবে মানবিক সম্পর্কের উপর নির্মিত-লিখিত সীমায়িত পরিসরে তাঁর ভাষ্য বিশিষ্টতায় চিহ্ণিত হয়ে থাকবে।
কবি-লেখক-গবেষক। অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
mahfuzparvez@gmail.com