ক্যান্সার যখন লিভারে

ক্যান্সার যখন লিভারে

ক্যান্সার একটি ভয়াবহ ঘাতকব্যাধি। সে যে কোনো ধরণেরই ক্যান্সার হোক না কেনো। আমরা এ পর্যায়ে তুলে ধরছি লিভার ক্যান্সারের ওপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আলোচনা ও পরামর্শ-

images[2]

লিভার কী: লিভার মানব দেহের অতি গরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। বাংলায় যাকে আমরা কলিজা বলি। লিভারের অবস্থান হচ্ছে পেটের উপর ভাগের ডানদিকে। এর ওজন প্রায় দেড় কেজির মত। লিভার দেহের সব প্রকার খাদ্যে মেটাবিলিজম-এ সাহায্য করে। আমরা প্রতিদিন যে খাদ্য গ্রহণ করি তা লিভারের মাধ্যমে শরীরের অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গে সরবরাহ হয়।

 

লিভার ক্যান্সার: লিভার ক্যান্সার সাধারণত দুই ধরণের হয়ে থাকে। একটি প্রাইমারি ক্যান্সার ও অন্যটি সেকেন্ডরি ক্যান্সার। প্রাইমারি লিভার ক্যান্সার লিভার সেল থেকে উৎপত্তি হয়। ক্যান্সার শরীরের অন্য কোন অঙ্গ বা অন্ত্র যেমন-পাকস্থলী, ক্ষুদ্র বা বৃহৎ অন্ত্র, কিডনি ও ফুসফুস থেকে লিভারে ছড়িয়ে পড়লে তাকে সেকেন্ডারি ক্যান্সার বলে।

 

লিভার ক্যান্সা কেন হয়: আমাদের দেশে লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ হচ্ছে: হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে এ দেশে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত শতকরা ৭০ জন রোগীই হেপাটাইটিস জনিত রোগে ভূগছে। এর পরেই রয়েছে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ও ফ্যাটি লিভারের অবস্থান। পাশাপাশি রয়েছে এলকোহল, মাঝে মাঝে অটোইমিউন হেপাটাইটিসের মত অখ্যাত রোগগুলোতে রয়েছেই। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে ভুগছেন, এমন শতকরা ৫ জন লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। আর হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ও ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটি যথাক্রমে ২০ ও ৩০ জন। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের এ রোগে আক্রান্ত হবার আশংকা বেশি। তবে চিকিৎসা করতে গিয়ে আমরা শিশুদের মধ্যেও হেপাটাইটিস বি জনিত লিভার ক্যান্সার খুঁজে পাই।

 

লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ: যে কোনো বয়সের মানুষই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের ৪ থেকে ৬ গুণ বেশি। সাধারণত: ক্যান্সার হবার আগে লিভার সিরোসিস দেখা দেয়। তবে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। এ রোগে আক্রান্তরা প্রায়ই পেটের ডান পাশে উপরের দিকে অথবা বুকের ঠিক নিচে মাঝ বরাবর ব্যথা অনুভব করেন। যার তীব্রতা রোগীভেদে বিভিন্ন রকম। সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়া, পেট ফাঁপা, ওজন কমে যাওয়ার সাথে হালকা জ্বর জ্বরভাব এরোগের অন্যতম লক্ষণ। লিভার ক্যান্সার রোগীদের প্রায়ই জন্ডিস থাকে না, থাকলেও তা খুব অল্প। খাওয়ার অরুচি, অতিরিক্ত গ্যাস কিংবা কষা পায়খানার কমপেস্নন থাকতে পারে। আবার কখনো দেখা দেয় ডায়রিয়া। পেটে পানি থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে।

liver[1]

লিভ্যার ক্যান্সার নির্ণয়: লিভার ক্যান্সার নির্ণয়ের সহজ উপায় হচ্ছে একটি নির্ভরযোগ্য আল্ট্রাসনোগ্রাম। তবে কখনো কখনো সিটি স্ক্যানেরও প্রয়োজন হতে পারে। রক্তের অঋচ পরীক্ষাটি লিভার ক্যান্সারের একটি মোটামুটি নির্ভরযোগ্য টিউমার মার্কার। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত যে কোনো মানুষেরই উচিৎ প্রতি ৬ মাসে একবার এএফপি ও আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করানো। তবে লিভার ক্যান্সারের ডায়াগনোসিস নিশ্চিত হতে হলে আল্ট্রাসনোগ্রাম গাইডেড এফএনএসি অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে, অভিজ্ঞ হাতে করা এ পরীক্ষার সাফল্যের হারও প্রায় শতভাগ।

 

চিকিৎসা পদ্ধতি:  লিভার ক্যান্সারের রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো হচ্ছে- কেমোথেরাপি, টিউমার অ্যাবলেশন, রিসেকশন ও লিভার প্রতিস্থাপন। ফাইভ ফ্লরোইউরাসিল, ডক্সেরুবিসিন আর টেমোক্সিফেনের মত কোমোথেরাপির ওষুধগুলো দীর্ঘদিন থেকে মন্দের ভালো হিসেবে লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহূত হয়ে আসছে। যদিও এদের কার্যকারিতা তেমন সুখকর নয়। বেশ ক’বছর থেকে বাজারে আছে কেপসসিটাবিন।

images[1]

সম্প্রতি এ তালিকায় যোগ হয়েছে-সুরাফেনিব। এ ওষুধ দুটি মুখে খেতে হয় বিধায় রোগীকে হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন পড়ে না। এর পাশর্্বপ্রতিক্রিয়াও খুবই কম। আগের ওষুধের তুলনায় কার্যকারিতাও বেশি। তবে সমস্যা হচ্ছে-এ ওষুধগুলো বেশ দামী। পাশাপাশি সুরাফেনিব বাংলাদেশে খুব বেশি সহজলভ্যও নয়।

 

এছাড়াও লিভার ক্যান্সারের আশাব্যঞ্জক দু’টো চিকিৎসা পদ্ধতি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন ও পারকিউটেনিয়াস অ্যালকোহল ইঞ্জেকশন। এদুটো পদ্ধতির বেসিক একই। উভয় ক্ষেত্রেই ক্যান্সারকে দেহের বাইরে থেকে গাইডেড প্রবের মাধ্যমে পুড়িয়ে ছোট করে আনা হয়। এর মধ্যে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনে আউটকাম পার কিউটেনিয়াস অ্যালকোহল ইঞ্জেকশনের তুলনায় সামান্য ভাল হলেও এর সীমাবদ্ধতা অনেকগুণ বেশি। প্রথমত এটি সাত থেকে আট গুণ বেশি দামী। দ্বিতীয়ত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনের জন্য যেসব বিশেষায়িত যন্ত্রপাতির প্রয়োজন পড়ে, তা খুবই দামী এবং আমাদের দেশে দুর্লভ। টিউমারের সাইজ খুব বড় না হলে আর রোগীর শারীরিক অবস্থা সব মিলিয়ে ভাল থাকলে অপারেশন করে টিউমার ফেলে দেয়া খুবই কার্যকর। আর এজন্য প্রয়োজনীয় কুসা মেশিন, দক্ষ হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন আমাদের দেশে আছেন।

-অধ্যাপক জুলফিকার রহমান খান, লিভার, প্যানক্রিয়েটিক, বিলিয়ারী এবং ল্যাপারোস্কপিক সার্জন

-ডা: মামুন-আল-মাহতাব (স্বপ্নীল), লিভার, পরিপাকতন্ত্র ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ

সৌজন্য : দৈনিক ইত্তেফাক।

 

 

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.