বাবা-মায়ের দেয়া নাম খন্দকার আহমেদ আলী। ডাকনাম সায়েদ। বর্তমানে অনেকেই তাকে ‘সাইকেল ভাই’ বলেই ডাকে! কিন্তু কেন? পাঠক চলুন, সেটা সাইকেল ভাইয়ের মুখ থেকেই শোনা যাক-
সময়ের কথা’র পাঠকদের জন্য সাইকেল ভাইয়ের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন রুমেল খান
বিশ্বকবি রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের ভেতর/ একটি শিশির বিন্দু।’ জন্ম থেকেই সব মানুষই আসলে ভবঘুরে। তাদের রক্তেই রয়েছে ঘর পালানোর মনোভাব। শিশু বয়সে সবাই ভাবে ঘরটাই বুঝি তার ভূবন। কিন্তু যতই বাড়তে থাকে বয়স, ততই তার ধারণা বদলে যেতে থাকে, মন চায় জ্ঞানের পরিধি আরও সমৃদ্ধ করতে। কুনো ব্যাঙের মতো ঘরের এক কোনে বসে থাকতে ইচ্ছে করেনা মোটেও। এজন্যই হয়তো আমাদের জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।’ তবে একজন কিন্তু নজরুল-রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে ঘর ছাড়েননি। তার ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়ার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন বিশ্বখ্যাত কল্পবিজ্ঞানী লেখক জুল ভার্ন। তাঁর লেখা ‘আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ’ গল্পটি পড়ে কিশোর বয়সে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তক্ষুণি চেয়েছিলেন সেই গল্পের নায়ক ফিলিয়াস ফগের মতো আশি দিনে পৃথিবী ঘুরে আসতে। কিন্তু ওই যে, একটা প্রবাদ আছে না, ‘সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নেই।’ বিশ্বভ্রমণের পথে সবচেয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ালো অর্থ। সেই বয়সেই তিনি উপলব্ধি করলেন নির্মম ও রূঢ় বাস্তব। অর্থ ছাড়া বেশিরভাগ সাধ-আহ্লাদই পূরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাতেও দমবার পাত্র নন তিনি। ঠিক করলেন, পৃথিবী না হোক, নিজের দেশটা তো ইচ্ছে করলেই দেখা যায়। এর জন্য তাকে অবশ্য অপেক্ষা করতে হয়েছে তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মতো অনেক দিন। অবশেষে স্বপ্নপূরণ হয়েছে তার। দেখেছেন সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। পথের ক্লান্তি ভুলেছেন এদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দু’চোখ ভরে অবলোকন করে। একে একে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের ৬৪ জেলাই। তবে ইবনে বতুতার মতো পায়ে হেঁটে নয়। বিশেষ এক বাহনে চেপে। সেটা দ্বিচক্রযান। নিজেকে ‘সাইকেল ট্যুরিস্ট’ হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন। তার ভিজিটিং কার্ডেও তেমনটাই লেখা। জানা গেল, তাকে নাকি সবাই ‘সাইকেল ভাই’ বলে বলে ডাকে! সেটা উপভোগও করেন। বিশ্বভ্রমণ শেষ না করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে নারাজ তিনি। দীর্ঘ সময়ের আলাপনে তার সাইকেল-পর্যটক হওয়া, ভবিষ্যত লক্ষ্য, ব্যক্তিগত জীবন, অভিজ্ঞতা, পরামর্শসহ নানা দিক উঠে এসেছে। চলুন, জানা যাক সেসবের আদ্যোপান্ত-
প্রশ্ন : প্রথমে নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন, তারপর মূল প্রসঙ্গে আসা যাবে।
উত্তর : বাবা-মায়ের দেয়া নামটি হচ্ছে খন্দকার আহমেদ আলী। ডাকনাম সায়েদ। তবে বর্তমানে অবশ্য অনেকেই আমাকে ‘সাইকেল ভাই’ বলেই ডাকে! মায়ের কাছে শুনেছি, আমার জন্মস্থান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৯ আগস্ট, ১৯৭৩ সালে। তবে বাবার সূত্রে আমার জেলা ফরিদপুর। তবে আমি ঢাকা বা ফরিদপুরের নয়, বাংলাদেশের ছেলেÑ এভাবেই নিজের পরিচয় দিতে বেশি ভালোবাসি। বাবা খন্দকার আলাউদ্দিন, পেশায় ছিলেন হিসাব রক্ষক। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ঢাকার হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরিতে। এছাড়া বিভিন্ন জুট মিলেও কাজ করেছেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই নয় বছর হলো। মা বেলা খন্দকার, গৃহবধূ। আমরা তিন ভাই, এক বোন। চারজনের মধ্যে আমার অবস্থান তৃতীয়।
প্রশ্ন : পর্যটক হবার ইচ্ছে কবে থেকে হয় ও কেন?
উত্তর : আসলে ইচ্ছের জন্মটা ঠিক কবে হয়, এটা বলতে পারবো না। এটা আসলে হঠাৎ করেই হয়েছে। একদিন আবিষ্কার করি, যেকোন অচেনা জায়গায় যেতে ভাল লাগে। যা দেখিনি, তার প্রতি দুর্নিবার আকষর্ণ জন্মাচ্ছে। নতুন জায়গায় গেলে আরও ঘুরতে তীব্র ইচ্ছে করে। কেমন যেন নেশার মতো। শৈশব থেকেই আমার বই গল্পের পড়ার অভ্যাস। বানান করে পড়তে শেখার পর থেকেই হাতের কাছে যা-ই পাই, তাই গোগ্রাসে পড়ে ফেলি। একদিন হাতে আসে জুল ভার্নের রচনা সমগ্র। বইটি পড়ে আমার মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। জুল ভার্নের গল্পের নায়করা বিভিন্ন অভিযানে যায়। কখনও আকাশে, কখনও পাহাড়ে, কখনও চাঁদের দেশে, কখনও বা সাগরতলে। তাঁর একটি গল্পের নায়ক ফিলিয়াস ফগ বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ করে। ভাবতাম, এটা কি আদৌ সম্ভব। সম্ভব হলে কিভাবে? আমার পক্ষেও কি এটা সম্ভব? পরে উপলব্ধি করি, এটা ফিলিয়াস ফগের পক্ষে সম্ভব হলেও আমার পক্ষে অসম্ভব। কেননা, গল্পের ফগ ছিলেন বিরাট ধনী ব্যক্তি। বিশ্ব ঘুরতে হলে প্রচুর টাকা দরকার। সেটা ফগের ছিল, কিন্তু আমার নেই। ব্যাপারটা বোঝার পর দারুণ হতাশ হয়ে পড়লাম। মনের সুপ্ত ইচ্ছে কি কোনদিনও বাস্তবে রূপ নেবে না? বিশ্বভ্রমণের মতো সুন্দর এ স্বপ্নসাধ অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যাবে?
প্রশ্ন : তারপর পর্যটক হবার স্বপ্নসাধ পূরণ করলেন কিভাবে?
উত্তর : পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়ে ও টিভি দেখে জানতে পারি সাইক্লিংয়ের কথা। সেই থেকে সাইকেলে ঘুরে সারা বিশ্ব দেখবো বলে মনের মাঝে নতুন করে স্বপ্নের বীজবপন করি। আমার এ স্বপ্নপূরণের অংশীদার হিসেবে পেয়ে যাই এক দূর সম্পর্কের বোন এ্যাঞ্জেলাকে। তার মা আমাকে খুব স্নেহ করেন। তাঁর কাছেই জানতে পারি এ্যাঞ্জেলাও বিশ্বভ্রমণের জন্য আগ্রহী। তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করি। দু’জনে মিলে নানা পরিকল্পনা করি, কিভাবে আমাদের স্বপ্নটাকে সফল করা যায়। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারি বিভিন্ন সাইক্লিং ক্লাবের কথা। এমনই একটি ক্লাবÑ ঢাকা সাইক্লিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আজহারুল ইসলাম মাসুমের কাছে বিশ্বভ্রমণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানতে চান, বাংলাদেশের কয়টা জেলা আমি ঘুরেছি। যখন শুনলেন একটা জেলাও ঘুরিনি, তখন বেশ তাচ্ছিল্যের স্বরেই বলেন, ‘নিজের দেশই দেখেননি, আবার বিশ্বভ্রমণ! শখ কত!’ তার এমন মন্তব্যে দারুণ আহত হলেও এ্যাঞ্জেলা আমাকে বোঝাতে সক্ষম হয়, তিনি ঠিকই বলেছেন, বিশ্বভ্রমণের আগে নিজের দেশটাকে ভালো করে দেখা উচিত। আমি আমার ভুল বুঝতে পারি। বদলে ফেলি পরিকল্পনা। ঠিক করি, আগে বাংলাদেশটা ঘুরবো।
প্রশ্ন : দেশভ্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কিভাবে?
উত্তর : এ্যাঞ্জেলার উৎসাহ-প্রেরণাতে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি। দেশের বিভিন্ন জেলার ম্যাপ সংগ্রহ করি। অনেক সময় নিয়ে তৈরি বিভিন্ন রুটম্যাপ। জমাতে থাকি টাকা। কিনে ফেলি সাইকেল। ২০০৫ সালের মাঝামাঝি এ্যাঞ্জেলাকে জানাই, আমি এবার যাত্রার জন্য তৈরি, তারা যেন আমার জন্য দোয়া করে। এ্যাঞ্জেলা জানায়, সে-ও যাবে আমার সঙ্গে। তার পরিবারের সম্মতি আছে। ওর এক পরিচিত বন্ধু দীপুও ভিড়ে গেল আমাদের সঙ্গে। সঙ্গী হলো আমার বন্ধু ইকবালের ভাগ্নে রানাও।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের সব জেলা ঘুরে কেমন অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন?
উত্তর : অভিজ্ঞতার আরেক নাম শিক্ষা। বাংলাদেশ ঘোরার আগে আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। অনেক মানুষের সঙ্গে মিশে, অনেক রকম পরিস্থিতির মোকাবেলা করে সে অভিজ্ঞতা এখন কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ হয়েছে। যত ভ্রমণ করবো, তত অভিজ্ঞতা হবে। তবে সেটা আরও সমৃদ্ধ হবে বিশ্বভ্রমণ করতে পারলে। যেটা আমার আজন্ম স্বপ্ন।
প্রশ্ন : বিশ্বভ্রমণের উদ্দেশ্য কি শুধুই ঘোরা, না কি অন্য কোন কারণ আছে?
উত্তর : প্রথমে উদ্দেশ্য ছিল নিছক ভ্রমণই। পরে দেশভ্রমণ শেষে উদ্দেশ্যের ধরণটা বদলে যায়। আমরা চাইÑ বিদেশ ভ্রমণে গেলে যেন বিশ্ববাসী জানতে পারেÑ আমাদের দেশ অদক্ষ নিন্ম মজুরির শ্রমিকের দেশ, দুর্ভিক্ষ-খরা-বন্যা পীড়িত বা অবৈধ অভিবাসীদের দেশ নয়, আমাদের দেশ শৌখিন ভ্রমণকারীদের দেশ। এটা আমার জেদ বা স্বপ্ন বলতে পারেন। বিশ্ববাসী আমাদের দেশকে যে নেতিবাচক ভাবে চেনে, সেই ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে চাই বিশ্বভ্রমণ করে। জানি না এ স্বপ্ন সফল হবে কি না।
প্রশ্ন : বিশ্বভ্রমণের পরিকল্পনা কি করে ফেলেছেন? কোন্ দেশ দিয়ে আগে শুরু করবেন?
উত্তর : যদি কোনদিন অর্থ সঙ্কটের সুরাহা হয়, তাহলে বিশ্বভ্রমণের শুরুটা করতে চাই ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান-তুর্কিমেনিস্তান-আর্মেনিয়া-আজারবাইজান তুরস্ক দিয়ে। তুরস্ক দিয়ে ইউরোপ যাওয়া সহজ। কিন্তু ইউরোপিয়ানরা তাতে ভাবতে পারে আমরাও হয়তো অন্যদের মতো অবৈধভাবে ইউরোপ ঢুকে হারিয়ে যাব। তাদের এ ধারণা ভুল প্রমাণ করার জন্য আমরা ঢুকবো লোহিত সাগর পার হয়ে আফ্রিকা মহাদেশে। আফ্রিকা ভ্রমণ শেষ করবো আলজিরিয়া দিয়ে। তারপর যাবো ইউরোপে। ঢাকা থেকে তুরস্ক যাবার রুটম্যাপও তৈরি করে ফেলেছি। তবে ইউরোপের রুটম্যাপ এর আগেই অনেকেই করে ফেলেছে, তাই আমরা সময় নষ্ট করে নতুন করে ম্যাপ তৈরি না করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেগুলো সংগ্রহ করবো। এরপর উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে চলে আসবো রাশিয়া-চীনে, শেষ করবো থাইল্যান্ড-মায়ানমার দিয়ে। মায়ানমার দিয়ে শুরুতেই যেতে পারতাম, কিন্তু দেশটির সামরিক জান্তা ট্যুরিস্টদের প্রবেশের ব্যাপারে খুব কড়া মনোভাব দেখায়। বিশ্বভ্রমণের শেষে আমরা দেশটিতে ঢুকলে তখন তারা হয়তো আমাদের ঢুকতে বাধা দেবে না, কারণ ততদিনে ট্যুরিস্ট হিসেবে আমাদের ব্যাপক পরিচিতি হয়ে যাবে, ফলে জান্তা সরকার আমাদের আটকাতে সাহস পাবে না। এটাই আমাদের বিশ্বভ্রমণের সম্ভাব্য পরিকল্পনা।
প্রশ্ন : বিশ্বভ্রমণ শেষ করতে আনুমানিক কত সময় লাগতে পারে? নিশ্চয়ই ফিলিয়াস ফগের মতো আশি দিন নয়?
উত্তর : আমরা হিসেবে করে দেখেছিÑ পরিস্থিতি, আবহাওয়া, শারীরিক অবস্থা ভেদে তিন থেকে পাঁচ বছর লাগতে পারে।
প্রশ্ন : রাতে বা ঝড়-বৃষ্টির দিনেও কি সাইক্লিং করেন?
উত্তর : ভ্রমণের সময় আমি দিনে তো বটেই, পরিস্থিতি বুঝে রাতেও সাইক্লিং করি। কাজেই ঝড়-বৃষ্টির দিনে নয়, বলা যায় ঝড়ের সময়টাতে আমি সাইক্লিং করি না। ক্ষেত্রবিশেষে হাল্কা বৃষ্টিতে রেইনকোট ছাড়া গ্রীষ্মম-লের এ দেশে সাইক্লিং করার মজাই আলাদা। তবে তীব্র ঝড়ো বাতাসের প্রতিকূলে সেটা কষ্টসাধ্য।
প্রশ্ন : ভ্রমণের সময় রাতে থাকেন কোথায়?
উত্তর : হোটেল, ডিসি অফিসের গেস্ট হাউজ, কিছু না পেলে মসজিদ। বাংলাদেশ ঘনবসতি দেশ হবার কারণে কিছু না কিছু না কিছু পাওয়া যায়ই।
প্রশ্ন : ভ্রমণ করতে গিয়ে কখনও শারীরিকভাবে কি অসুস্থ হয়েছেন? কিংবা দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হয়েছেন?
উত্তর : না, এখন পর্যন্ত এরকম কোন অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে আমার দলের অন্য সদস্যদের অসুস্থ হতে দেখেছি। তবে দুর্ঘটনায় পড়ছি একাধিকবার। একবার পাহাড় থেকে সাইকেলসহ গড়িয়ে পড়েছিলাম। তবে পড়ে গিয়ে যতটা ব্যথা পেয়েছিলাম, তারচেয়ে শতগুণে উৎফুল্ল হয়েছিলাম আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় সাইকেলটি অক্ষত রয়েছে দেখে। কেননা, এটার কিছু হয়ে গেলে আমার ভ্রমণের বারোটা বেজে যেত।
প্রশ্ন : এদেশের কোন্ কোন্ অঞ্চলগুলো ভ্রমণ করে ভাল লেগেছে আপনার? প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ মনে হয়েছে কোন্ স্থানগুলোকে?
উত্তর : ৬৪ জেলা ঘুরেছি। এগুলোর মধ্যে তিন পাবর্ত্য জেলার যে প্রাকৃতিক রূপ, তার সঙ্গে বাকি ৬১ জেলার প্রাকৃতিক রূপের অনেক তফাত। তাছাড়া যেকোন অচেনা এলাকায় গিয়ে সেখানকার কোন নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য নজরে এসেছে, তখনই তীব্র ভাল লাগায় আচ্ছন্ন হয়েছি, বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়েছি। তবে প্রতœতাত্তিক স্থান বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও যে জিনিষটি সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে, তা হচ্ছে অচেনা-অজানা মানুষের ভাল ব্যবহার। তারা যেভাবে আমাদের আপন করে নিয়েছে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, এর সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হতে পারে না। প্রাচীনকালে এদেশে ভ্রমণ করে গেছেন ইবনে বতুতা, মার্কো পোলোর মতো পর্যটকরা। তাঁরা এদেশের মানুষ সম্পর্কে যা লিখে গিয়েছিলেন, তার সতত্যা যেন নতুন করে প্রমাণ পেলামÑ তখন তো বটেই, এখনও এদেশের মানুষরা অত্যন্ত সহজ-সরল, মিশুক, অতিথিবৎসল ও আন্তরিক।
প্রশ্ন : কোথাও ঘুরতে যাবার আগে কি সেই এলাকা সম্পর্কে আগাম কোন ধারণা বা তথ্য সংগ্রহ করেন? করলে কিভাবে?
উত্তর : ৬৪ জেলা ঘুরতে যাবার আগে কোন আগাম তথ্য নেইনি। যেটা করেছি, তা হলোÑ এক জেলা থেকে আরেক জেলা যাবো কিভাবে, রুটম্যাপ তৈরি করে রাস্তাগুলো সম্পর্কে ধারণা নেয়া। এ ব্যাপারে পরিচিত কয়েকজন এলজিডি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে তাদের গাইডেন্স নিয়েছি। এক জেলা থেকে যখন আরেক জেলায় যাব, তখন সেই পরবর্তী জেলার পথ-ঘাট সম্পর্কে স্থানীয় মানুষজনদের কাছ থেকে ভাল করে জেনে নিয়েছি। ফলে সমস্যা হয়নি কোন।
প্রশ্ন : ভ্রমণের আগে কি কারও কোন সমালোচনা হজম করতে হয়েছে? ভ্রমণ শেষ করে আসার পর সবাই আপনাকে কিভাবে গ্রহণ করেছে?
উত্তর : ৬৪ জেলা ভ্রমণের আগে একমাত্র এ্যাঞ্জেলা ও দীপু ছাড়া কেউই আমাকে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দেয়নি। যারা শুনেছে আমাদের ভ্রমণ-পরিকল্পনার কথা, তাদের কাছ থেকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ আর ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য, অবহেলা ছাড়া কিছুই পাইনি। তবে ৬৪ জেলা ভ্রমণ শেষ করে যখন ঢাকা ফিরলাম, তখন এদের অনেকেই আমাদের নানাভাবে প্রশংসা করেছে, উৎসাহ দিয়েছে এবং মজার ব্যাপারÑ অনেকেই অনুরোধ করেছে আবারও ভ্রমণে গেলে তাদের যেন সঙ্গে করে নিয়ে যাই! এছাড়া ভ্রমণের সময় দু’-একটি বাজে অভিজ্ঞতা যে হয়নি, তা নয়; কিন্তু ভ্রমণের অপার আনন্দ, অচেনা মানুষদের ভাল ব্যবহার তার কাছে সেটা নিতান্তই গৌণ। এগুলোকে কখনই বড় করে দেখার আকাঙ্খা আগেও ছিল না, নেই এখনও। যারা খারাপ আচরণ করেছে, সেটা তাদের অজ্ঞতা কিংবা নিন্ম রুচির অধিকারী, তাছাড়া তারা সংখ্যায়ও কম। এরা আমাদের জাতি বা সমাজের কোন অংশ নয়। কাজেই এগুলোকে গুরুত্ব দেয়ার কোন মানে নেই।
প্রশ্ন : সাইকেল ট্যুরিস্ট হবেনÑ পরিবারের কাছ কতটা সমর্থন পেয়েছেন?
উত্তর : মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার পরিবারের সদস্যরা আমার সাইকেল ট্যুরিস্ট হবার জন্য কোন উৎসাহ বা বাধাÑ কোনটাই দেননি। কেননা, তারা আমাকে ভালমতোই জানেন আমি কতটা জেদি। মাথার মধ্যে কোন কিছু ঢুকলে সেটার শেষ না দেখে ছাড়ি না। তবে তার মানে এই নয়, আমি যা খুশি তা-ই করে বেড়াই।
প্রশ্ন : ভ্রমণ ছাড়া যখন চলাফেরা করেন, তখন নিশ্চয়ই বাস, রিকশা বা অটো রিক্সা ব্যবহার করেন?
উত্তর : মোটেও না! ভ্রমণ ছাড়াও যখন যেখানে যাই, আমার সঙ্গী থাকে সাইকেল। বলতে পারেন, পায়ের বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছি সাইকেলটাকে। ৬৪ জেলা ঘুরে আসার পর কয়েকবার ছোটখাট কিছু ট্যুর করেছি (পাঁচ-ছয় জেলা ভ্রমণ) বন্ধুদের উৎসাহ দিতে। তখন আমার সঙ্গী হয়েছে চাকরিজীবি সংগঠনের শোভন, ডাচবাংলা ব্যাংকের ইঞ্জিনিয়ার বাতেন, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র শিক্ষার্থী রেজাউল করিমসহ আরও অনেকেই।
প্রশ্ন : ট্যুরের কোন মজার, বিব্রতকর বা স্মরণীয় ঘটনা থাকলে বলুন।
উত্তর : কারোর অজ্ঞতা যে অন্যদের কাছে মজার বিষয় হয়ে উঠতে পারে, তেমন একটি ঘটনার কথা বলি। লক্ষèীপুর থেকে নোয়াখালী যাবো আমরা চারজন। কখন যে নোয়াখালী প্রবেশ করেছি, টের পাইনি। পথে থেমে থেমে যাকে যতই জিগ্যেষ করি নোয়াখালীর সদর কোন্ দিকে, ততই তারা বলে, ‘ও, মাইজদী যাবেন। এই দিকে।’ ভারী দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কি ব্যাপার, এই এলাকার মানুষগুলো এমন কেন? যেতে চাই এক জায়গায়, অথচ পাঠাতে চায় অন্য জায়গায়! কি মুশকিল! দিন শেষে নিজেদের ভুল ধরা পড়লো। আর আমরা তো হাসতে হাসতে অস্থির! ভুলটা হলো বাংলাদেশের অন্য সব জেলার মতো নোয়াখালীর পার্থক্য হলো এখানে জেলার নামে সদর কোন সদর নেই, আছে মাইজদীর নামে। লোকজন আমাদের ঠিকই বলেছিল, আমরাই ছিলাম মদন! তারা নয়, আমরাই হাসির খোরাক হয়েছিলাম তাদের।
প্রশ্ন : কোন ট্যুর সংগঠন তৈরি করতে চান, যাতে আপনার মতো আরও ভ্রমণপিপাসুরা এ সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের ভ্রমণের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পারেন?
উত্তর : সংগঠন তৈরি করা কোন ব্যাপার নয়। ব্যাপার হলো এটাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা। আমি যদি এর পেছনে সময় দিতে না পারি, তাহলে সংগঠন করে লাভ কি? বরং আমি কোন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে তাদের কাছে আমার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই, যাতে তারা উপকৃত হতে পারে।