…তবু আশরাফুলের আকুতি

…তবু আশরাফুলের আকুতি

final pachaal cover asraful-0

জাহিদুল আলম জয়

 

হিরো থেকে জিরো। মোহাম্মদ আশরাফুলের ক্ষেত্রে এমনই হয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন, এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার অ্যাশ। অধারাবাহিকতার উজ্জ্বল নিদর্শন হওয়ার পরও ক্রিকেটপ্রেমীদের আগ্রহের শীর্ষে থাকতেন তিনি। কিন্তু সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরি হাঁকানো এই তারকার যেন স্বর্গ থেকে পতন হয়েছে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের (বিপিএল) দ্বিতীয় আসরে ম্যাচ পাতানোর দায় স্বীকার করার পর জ্বলজ্বল করা এই তারকার পতন হয়েছে। লোভের হাতছানিতে পা হড়কানো আশরাফুল এখন মর্মযাতনার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। অপরাধ স্বীকার করার পর সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাঁকে। গত ১৩ আগস্ট আশরাফুল নিজে রাজধানীর একটি হোটেলে উপস্থিত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে গঠন করা অভিযোগপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের জানান, ফের ক্রিকেটের রঙিন দুনিয়ায় ফিরতে চান। আর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।

বিপিএলে ম্যাচ ফিক্সিং বা স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনেছে আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী ও নিরাপত্তা ইউনিট (আকসু)। এতে নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে সাত জনের বিরুদ্ধে সরাসরি ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। বিসিবির দুর্নীতি বিরোধী কোড অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আগ পর্যন্ত এই নয় জনের নাম প্রকাশ করা হবে না। এ কারণে আপাতত আশরাফুল বাদে অন্যদের নাম জানা যায়নি। তবে পাপের শাস্তি যে ২৯ বছর বয়সী অ্যাশকে ভোগ করতে হবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। এরপরও নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ক্রিকেটে ফেরার স্বপ্ন দেখছেন আশরাফুল। তাঁর এমন বিশ্বাসের জায়গাটা হচ্ছে, নিজেই বিপিএলের ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ স্বীকার করা। এছাড়া তদন্তের সময় আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ইউনিটকে সর্বাত্মক সহায়তাও করেছেন তিনি। এসব কারণেই বিসিবি বা আইসিসি শাস্তির ক্ষেত্রে তাঁকে কিছুটা ছাড় দেবে বলে আশা করছেন। মনের কোণে লালন করছেন, নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ কাটিয়ে ফের ফিরবেন প্রিয় ক্রিকেট মাঠে। তবে বাস্তবে সেটা সম্ভব হবে কি না তা সেটা নির্ধারিত হবে বিসিবির ট্রাইব্যুনালে।

পাপের স্বীকারোক্তির জন্য যে বড় শাস্তি আসছে তা জানেন সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক আশরাফুল। এরপরও ক্রিকেটে ফিরে আসতে চান তিনি। তবে শাস্তি কমানো নিয়ে কোনো অনুরোধ তিনি করেননি। আশরাফুল বলেন, ‘আমি শাস্তি কমানো নিয়ে কোনো অনুরোধ করিনি। কিন্তু আমি চাই যেন ক্রিকেটে ফিরে আসতে পারি।’ ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে বাংলাদেশের কারা কারা জড়িত তা সাংবাদিকদের বলেননি আশরাফুল। তাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছেন সত্য স্বীকার করতে। এতে তাদের নিজেদের পাশাপাশি ক্রিকেটেরও উপকার হবে বলে মনে করেন অ্যাশ। দোষ স্বীকার করায় কিছুটা ছাড় আশা করতেই পারেন সাবেক টাইগার অধিনায়ক! মুখে সরাসরি না বললেও ক্রিকেটে ফেরার ইচ্ছার কথা বলে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে আশরাফুল বলেন, ‘তদন্ত চলার সময় আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছি। এখন এটা যদি তাঁরা বিবেচনায় নেন, তাহলে আমার মনে হয় শাস্তিটা দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে। তিন বছর পর আমার বয়স হবে ৩২। আর আমার বিশ্বাস, ক্যারিয়ারটা হয়তো শেষ হয়ে যাবে না। এ রকম বয়সে অনেক ক্রিকেটারই খেলেছেন। সনাৎ  জয়সুরিয়া খেলেছেন। শচীন টেন্ডুলকর এখনও খেলছেন।’ শাস্তি হলে আইনজীবীর মাধ্যমে মোকাবিলা করবেন কি না এমন প্রশ্নে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতস সেরা তারকা বলেন, ‘বিসিবির কাছ থেকে আমি তো কোনো আইনজীবী পাব না! আমি ব্যক্তিগতভাবেই আইনজীবী ঠিক করব।’

বিপিএলের দ্বিতীয় আসরকে বাজিকরদের কালো থাবা থেকে বাঁচাতে আকসুকে তলব করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। ফাইনালের পরদিনই কয়েকটি ম্যাচ এবং ক্রিকেটারসহ কয়েকজনের আচরণ সন্দেহজনক বলে প্রতিবেদন জমা দেয় তারা। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর অধিকতর তদন্তের জন্য আকসুর সঙ্গে চুক্তি করে বিসিবি। আকসুর প্রতিবেদন দেয়ার সময়সীমা বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়। নতুন নাম যোগ হওয়ায় বাড়ে তদন্তের পরিসরও। তদন্তের জন্য অন্তত বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করে আকসুর প্রতিনিধি দল। খোদ আইসিসির বোর্ড সভায়ও অধিকতর তদন্তের পরামর্শ দেয়া হয়। বিসিবি তদন্ত অব্যাহত রাখার কথা জানালে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে আকসু। দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তি দেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। স্বীকারোক্তি দেয়ার পর গত ৪ জুন সব ধরনের ক্রিকেট থেকে আশরাফুলকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করে বিসিবি। ওই দিন ম্যাচ পাতানোয় জড়িত থাকার অভিযোগ স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চান দেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এই সম্পদ।

সীমাহীন সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আগমণ ঘটে মোহাম্মদ আশরাফুলের। ১১ এপ্রিল ২০০১ সালে বুলাওয়াতে স্বাগতিক জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল প্রতিশ্রুতিশীল এই ক্রিকেটারের। করেছিলেন মাত্র ৯ রান। ওয়ানডে অভিষেকে তেমন সুবিধা করতে না পারলেও টেস্ট অভিষেকে বিশ্ববাসীকে রীতিমতো চমকে দিয়েছিলেন সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ক। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে কলম্বোর এসএসসিতে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক হয় আশরাফুলের। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে ২৬ রানে থেমে গেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেছিলেন ১১৪ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস। সেদিন আশরাফুলের বয়স ছিল ১৭ বছর ৬৩ দিন। অনবদ্য ওই সেঞ্চুরি করে সবচেয়ে কম বয়সে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করার অনন্য কীর্তিগাথা রচনা করেছিলেন পুঁচকে অ্যাশ। ভেঙ্গে দিয়েছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৬০-৬১ মৌসুমে পাকিস্তানের মোস্তাক মোহাম্মদের ১৭ বছর ৮২ দিনে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড। সাবেক টাইগার অধিনায়কের রেকর্ডটি এখনও অক্ষুণœ আছে। অভিষেক টেস্টে স্মরণীয় ওই ইনিংস খেলেই লাইমলাইটে পৌঁছে যান তিনি। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুতে দেখানো চমক আর ধরে রাখতে পারেন নি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকেই অধারাবাহিকতার উজ্জ্বলতম নির্দশন হয়ে পড়েন! অভিষেক টেস্টে রেকর্ড সেঞ্চুরি করার পরের টেস্টের দুই ইনিংসে মারেন ‘গোল্ডেন ডাক’। পরের ১১ ইনিংসে পাননি কোন অর্ধশতকের দেখা। ওয়ানডের অবস্থা আরও করুণ। অভিষেক হওয়ার পর ১৪ ইনিংস ছিলেন হাফসেঞ্চুরি বঞ্চিত। যে কারণে সবসময় জাতীয় দলে যাওয়া-আসার মধ্যে থাকতে হয়েছে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম চমকজাগানিয়া এ প্রতিভার।

২০১১ সালের শেষভাগে টেস্ট ও ওয়ানডেতে ব্যর্থ হওয়ার পর আশরাফুলের ক্যারিয়ারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। একসময় মনে হয়েছিল, হয়ত হারিয়েই গেলেন প্রতিভাময় এ তারকা। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল করার সুবাদে শ্রীলঙ্কা সফরের দলে সুযোগ পান। প্রথমে তাঁকে নির্বাচকরা উপেক্ষা করলেও শাহরিয়ার নাফিসের ইনজুরিতে ভাগ্য খুলে আশরাফুলের। যে কারণে দীর্ঘ ১৫ মাস পর টেস্ট ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করেন। গত ৮ মার্চ গল টেস্টের প্রথম ইনিংসে অসাধারণ ব্যাটিং করে নব ফেরাটা স্মরণীয় করেন অ্যাশ। খেলেন ১৯০ রানের নান্দনিক ইনিংস। পাঁচদিনের ক্রিকেটে ভাল করার সুবাদে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের দলেও সুযোগ পান। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু আবারও ব্যর্থ হন তিনি।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এই প্রতিভা ১২ বছরের ক্যারিয়ারে কখনোই ধারাবাহিক সাফল্য পাননি। মাঝেমধ্যে বিস্ফোরক ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে দুর্দান্ত কিছু জয় উপহার দিলেও ধারাবাহিকভাবে সাফল্য দেখাতে পারেন নি। এরপরও তাঁকে নিয়ে প্রত্যাশার কমতি ছিলনা বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। কিন্তু ভক্ত-সমর্থকদের ধোঁকা দিয়ে নিজেকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছেন নিন্দিত আশরাফুল।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.