গো য়ে ন্দা

গো য়ে ন্দা

14[1]

 করলডেঙ্গা গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশটা খুবই সুন্দর। পূর্বদিকে সন্যাসী পাহাড়মালা, পশ্চিম দিকে ধূ ধূ বিল সংলগ্ন উত্তর ভূর্ষি গ্রাম, উত্তর দিকে ধোরলা আর কানুনগোপাড়া গ্রাম দুটি আর দক্ষিণে তালুকদার পাড়া যা থেকে কিছুটা দূরে কেলিশহর গ্রাম।

সন্যাসী পাহাড়ের পাদদেশে বিখ্যাত শাহ কালান্দর আওলিয়ার মাজার শরীফ। পাহাড়ের চূড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে উল্লেখিত মেধস মুনির আশ্রম। যেখানে কিনা মর্ত্যরে প্রথম দুর্গা পূজা করেছিলেন রাজা সুরথ ও সমাধি বৈস্য।

এই গ্রামের প্রায় অধিকাংশ অধিবাসিই কৃষিজীবী। তবে অধ্যাপক চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীও আছে। আছে ব্যবসায়ি ও চাকরিজীবী।

গুটিকয়েক সন্ত্রাসি এই সময়ে কোন গ্রামেই বা নেই? আছে এই গ্রামেও। তেমন এক সন্ত্রাসি, মনে করুন নাম তার ইবলিস। ইবলিসের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা মামলা এরই মধ্যে থানায় রজ্জু করা হয়েছে। মাঝে মধ্যে পুলিশ আসে। ঘুরে ফিরে হাঁক ডাক করে । চলে যায়। ইবলিস থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

গ্রামবাসির মনে এরই মধ্যে এই ধারণাটা শেঁকড় গেড়েছে যে, ইবলিস বোধহয় কখনোই ধরা পড়বে না। সুযোগটা নেয় ইবলিস। কারণে অকারণে তার অত্যাচারের মাত্রাটা দিনে দিনে আকারে ও প্রকারে বাড়তে থাকে।

সেই গ্রামেরই কয়েকজন মিলে একদিন পরামর্শ করে ইবলিসের কুকীর্তির বিস্তারিত উল্লেখ করে অতি গোপনে র্যাব-৭ এর দপ্তরে এক খানা দরখাস্ত দিয়ে আসে।

ইবলিসের কানে চলে যায় তার ছায়া সংবাদ। পাহাড়ের অভ্যন্তরে এক আস্তানা গড়ে তোলে সে। অধিকাংশ সময় ওখানেই থাকতে শুরু করে। মনোযোগ দেয় বাহিনী বাড়ানোর দিকে। গ্রামবাসির আতংক বাড়তে থাকে। পুলিশ আসে। ভারী হয়ে চলে যায়!

একদিন এক পুরোনো বোতল ক্রেতা এলো সন্যাসী পাহাড়ের পাদদেশের শান্ত গ্রামটাতে। ৪০/৪৫ বছর হতে পারে লোকটার বয়স। চুল দাড়িতে পক্কতা সাদা কাশ ওড়াতে শুরু করেছে! লুঙ্গিটা ময়লা। পাঞ্জাবী তালি মারা। স্পঞ্জের সেন্ডেল চোখে পড়ার মতোই বিধ্বস্থ।

বাড়ি নাকি উত্তর বঙ্গের দিকে। চাটগাঁইয়া ভাষা কিছুটা বোঝে তবে বলতে পারে না। গ্রামটাতে চার চারটে চায়ের দোকান থাকলেও কোনটাতেই ভাতের ব্যবস্থা নেই। দুপুরবেলা সে পরটা আর কলার সাথে গরুর খাঁটি দুধের চা পান করেই চালিয়ে দেয়। সন্ধ্যা নামার কিছু আগে পুরোনো বোতল ভরা বাঁশের তৈরী বড় লাইটা মাথায় নিয়ে জীর্ণ কালো রঙের মোটা কাপড়ের থলেটা কাঁধে ঝুলিয়ে প্রতিদিন পশ্চিমের উত্তর ভূর্ষি গ্রামের পাশে দিয়ে যাওয়া বৈদ্যানি রাস্তা ধরে কালাইয়ার হাটের দিকে চলে যায়।

দুষ্টু শিশুরা প্রথম দিন তো পাগল মনে করে দু চারটা মাটির ঢেলাও ছুঁড়েছিল। পরে কয়েকজন মুরুব্বীর হস্তক্ষেপে সেই আপদের বিপদ ঘটানোর আগেই পরিসমাপ্তি ঘটে। নামায আদায় করে সে  মসজিদে গিয়েই। সময়ে সময়ে তসবিহ্ মালা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়! কেউ কেউ  বলে সংসার বিবাগী; আবার কেউ কেউ বলে ফেরারী। তারপরেও বলা যায় মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সে বেশ কয়েক জন লোকের সহানুভূতি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

দুষ্টু শিশুরা মার্বেল খেলতে খুবই পছন্দ করে। খেলতে খেলতে মাঝে মধ্যে ওরা ঝগড়া বাঁধায়। লোকটা যদি আশে পাশে থাকে তো কথাই নেই এমন সুন্দরভাবে তাদের ঝগড়াটা মিটিয়ে দেয় যে কেবল মাত্র শিশুরা নয় বড়রাও অবাক হয়ে যায়! এরপরেও যদি কেউ মুখ কালো করে থাকলো তো তাকে এমন এক গল্প শুনিয়ে দেবে যে, শেষ পর্যন্ত তাকে হাসতেই হয়!

গাছের ছায়ায় ক্লান্ত রাখালেরা যখন হাঁফিয়ে ওঠে নিস্কর্ম বসে থাকার ক্লান্তিতে তখন লোকটা যদি দৈবক্রমে ওখানে উপস্থিত হয় তাহলেই হলো,  সবাই ধরে বসে তাকে তার জীবনের কাহিনী বলতে। তিলকে তাল আর তালকে তিল বানিয়ে কত বর্ণাঢ্য সব কাহিনীই না বলে যায় সে। নেশাগ্রস্থের মতো ওরা সে কাহিনী গিলতে থাকে হা করে। হয়ত তখন রাখালদের কারো কারো গরু আশে পাশের কোন ক্ষেতে ঢুকে খেতে শুরু করে দিয়েছে।

তাও আবার সবার আগে চোখে পড়ে লোকটারই, ‘ হায় হায় রে, কার গরুতে কার খেত খায়।’ চিৎকার করে ওঠে সে। সাথে সাথেই কোন রাখাল দৌড়ে গিয়ে গরুগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে।

দিনে দিনে দুষ্টুশিশুগুলোর চঞ্চল চিত্তগুলোতে অচঞ্চল এক অকপট আসন পেতে নিতে সক্ষম হয় লোকটা। পুরোনো বোতলের পাশাপাশি সে এল্যুমিনিয়ামের ভাঙাচোরা তৈজসপত্রও কিনতে শুরু করে। গ্রামের পুরুষদের পাশাপাশি এবার সে বয়সী নারীদের মাঝেও পরিচিতি পেতে শুরু করে। ধার্মিক লোকদের কে না পছন্দ করে ? সে যে ধর্মেরই হোক না কেন।

আকাশে মেঘের ঘনঘটা। শান্তশিষ্ট সুবোধ বাতাসে পাগলা মহিষের শিঙের তাণ্ডব। গাছপালারাও মাথা ঝাঁকিয়ে কোমড় দুলিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে দেখে নিচ্ছে ঈশান কোণের দিকে ভয়ংকর কাল বৈশাখীর ঠিকানা!

শিশু মাত্রেই মঙ্গলের দূত! ওরা অন্যায়ের বিপক্ষে; চিরকাল ন্যায়ের পক্ষে। মৌমাছির পরাগায়ণের মতো ওরাই এবাড়ি ওবাড়ি সেবাড়ির যতসব আকথা কুকথার পরাগায়ণ ঘটায়। সেই পরাগায়ণ পথে কত তিল যে তাল আর কত তাল যে তিল হয়ে যায় তার কোন হিসেবই নেই। লোকটা ওদের কথা বড় আগ্রহ নিয়েই শোনে। শিশুরাও ওকে শোনাতে পারলে খুশিই হয়। অন্য কেউ যে ওদের কথা শুনতেই চায়না।

কালো মেঘের ছুটোছুটি আকাশ জুড়ে। রাখাল শিশুগণ কিছুক্ষণ পর পর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। গাছের শাখায় শাখায় আমশিশুরা বাতাসের ঝাপটায় দুলছে নাচছে লাফাচ্ছে! মাঝে মধ্যে দু চারটা বোঁটার বাঁধন ছিঁড়ে ধরিত্রীর বুকে এসে পড়ছে রাখালশিশুদের লিপ্সা নিবৃত্তি কল্পে!

আকারে বড় কিন্তু এখনো কাঁচা একটা আম কুড়াতে গিয়ে দুই রাখালের  মাথায়  মাথায় সংঘর্ষের ফলে আহত দু’ জনেই যখন ব্যাথায় কোঁকাছিল ঠিক তখনই যাদুমন্ত্রের বলেই যেন কোত্থেকে এসে হাজির লোকটা!  দু’জনের মাথা ভালো করে মেসেজ করে দিয়ে বলতে থাকে সে, ‘ অমন ছুটোছুটির কী দরকার ছিল? সবাই যদি মিলেমিশেই খাবে তো একজন গিয়ে নিয়ে আসলেই পারতে। এখন দেখোতো দুজনের মাথায় শিং গজিয়েছে। জানো নাকি ওই কথাটা, এক আঘাতে দুষ্টু দুই; আঘাতে সুষ্টু।’

‘ ন বুঝি। খোলাসা গরি কঅন চাই।’  দুষ্টুশিশুদের সর্দার বললো।

‘ তার মানেটা হচ্ছে মাথায় যদি একবার আঘাত পাও তো ওখানে রক্ত জমে ক্ষতি হবে । সাথে সাথে একই ওজনের আর একটা আঘাত দিলে রক্ত চলাচল পুনরায় শুরু হয়ে যাবে। যার ফলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাটা থাকবে না। বুঝলে তো? ’  বললো লোকটা হাসিমাখা মুখে।

‘ ব্যাগিন ন বুঝিলেঅ কিছু কিছু বুঝজি। তোইলে ইয়া কেন্ গরন্ পরিবযে?’  প্রশ্ন করলো সর্দার।

‘ আগের মতোই দৌড়ে এসে দুজনে শিঙে শিঙে ঢুঁ মারো।’ মুখের হাসি মুছে ফেলে বললো লোকটা।

14[1]  বাকী ছয় সাতজন শিশুরাখাল একসাথে তালি দিয়ে হেসে উঠলো। লোকটার প্রচণ্ড উৎসাহে আঘাত প্রাপ্ত দুই শিশু আবারও আগের মতো দৌড়ে এসে পরষ্পরের শিঙে শিঙে ঢুঁ মারলো! সমবেত শিশুদের হাসি আর করতালিতে দুই শিশু নিজেদের ব্যথাও ভুলে গেল!

কালো মেঘ আরো ঘন হয়ে আসে। অন্ধকার নেমে আসতে আর যেন বেশি দেরী নেই। ঠিক এমনি সময়েই দুষ্টুশিশুর সর্দার বলে ঊঠলো অপ্রত্যাশিতভাবেই,‘ জানো না বন্ধু, আজিয়া যদি ঝুমঝুম্যা বিষ্টি অহ্ তোইলে ওই হারামজাদা ইবলিস্যা মুড়ার আস্তানা ছাড়ি বাড়িত আইবো।’

কয়েকদিনের মেলামেশায় লোকটা এরি মধ্যে জেনে ফেলেছে কোন শিশুটা কোন বাড়ির। যে শিশুটা কথাটা বললো সে কিন্তু ইবলিসের বাড়িরই। লোকটা আদুরে স্বরে প্রশ্ন করলো:‘ তাই? তো কথাটা তুমি জানলে কি করে?’

‘ হিতারঅ ঘরত্ কুয়াহ্কুয়ি গরের্যে আঁই হুন্নিযে।’ সর্দার বললো।

দু’ একটা করে বৃষ্টির ফোটা কারো হাতে কারো গালে, কারো বা কপালে এসে পড়তে লাগলো। ওরা গরুগুলোকে তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। সেই সর্দার কতদূর গিয়ে আবার ফিরে এসে লোকটার সামনে গিয়ে বলতে থাকে, ‘বন্ধু, তুঁই আজিয়া কণ্ডে থাইবা? যেন ডোইল্যা বয়ার আইয়ের তুঁইতো পান্লার আজিয়া কালাইয়ার হাট যাইত্ পাইরতানঅ।’

শিশু সর্দারের কথায় লোকটা কেমন চিন্তিত হয়ে গেল। সর্দার লোকটার বাঁ হাতটা টেনে ধরে বললো: ‘আঁরঅ বাড়িত যাইবা না? আঁর দাদীরে বুঝাই কোইলে মনে অই বাদ্দির ডেয়াত্ তোঁয়ার থঅনর একখান ব্যবস্থা গরি দিবু। যাইবা না বন্ধু আঁর লগে?’

‘ ঠিক আছে বন্ধু, তুমি যখন অত করে বলছো তো চেষ্টা একটা করেই দেখি। দাদী যদি রাজি নাইবা হলেন তো ওই মসজিদে গিয়ে এবাদত বন্দেগীতেই রাতটা না হয় গুজার করে দেবো’।  কথাটা বলে বাম কাঁধে কালো কাপড়ের থলেটা ঝুলিয়ে মাথার উপর পুরোনো বোতলভর্তি বাঁশের লাইটা বসিয়ে ডান হাতে একটা এ্যাবড়ো থেবড়ো এ্যালুমিনিয়ামের বদনা নিয়ে বলতে লাগলো লোকটা:‘ তোমার বাড়িটাই না ইবলিসের বাড়ি?’

‘হ , ত একখান কথাকি জাননা বন্ধু , আঁরার লয় হিতারার অন্ মাতবোল পর্যন্ত নাই।’ রাগত স্বরে বললো শিশু সর্দার। গরুগুলোকে বাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার পথে আর কোন কথাই বললো না সে। লোকটা তার পিছে পিছে হাঁটছে। অন্যান্য শিশুও ততক্ষণে নিজ নিজ বাড়ির পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছে।

গরুগুলোকে গোয়ালে ঢুকিয়ে দিয়ে শিশু সর্দার লোকটাকে নিয়ে নিজেদের উঠোনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে দাদীকে উদ্দেশ্য করে হাঁকতে থাকে:‘ দাদী, ও দাদী, ইন্দি এক্কানা আইওতো।’

মাটির দু’কক্ষ বিশিষ্ট দোতলা ঘর। মাঝখানের সাইদরজা দিয়ে বাইরের ডেয়ায় বের হয়ে এলেন ষাটোর্ধ বছর বয়সী এক নারী। পরনে বার্মিজ মহিলাদের মতোই থামি আর ব্লাউজ। ওপরে ওড়না জড়ানো।

লোকটাকে দেখেই দাদী চিনতে পারলেন। দুদিন আগেও সে এ বাড়িতে পুরোনো বোতলের খোঁজে এসেছিল। প্রিয় নাতির আন্তরিক সুপারিশে বাইরের ডেয়ায় রাতটা কাটাবার অনুমতি দিয়েই তিনি ভেতর বাড়িতে চলে গেলেন। লোকটাকে নিয়ে সর্দার উঠোন থেকে ডেয়ায় উঠে এলো। শিশু সর্দার সাইদরজা দিয়ে চলে গেল ভেতর বাড়িতে। লোকটা হাতের বদনাটা নামিয়ে রেখে ডেয়ার একপাশে মাথার উপর থেকে ল্ইাটা নামিয়ে রাখলো। কাঁধের থলেটা নামিয়ে না রেখেই হাত-মুখ-পা ধুতে উঠোনের এক কোণের টিউবওয়েলটার কাছে চলে গেল সে। পাক-পরিষ্কার হয়ে আবারও ডেয়ায় উঠে এলো যখন ততক্ষণে সর্দার ভিতর বাড়ি থেকে চাটাই মশারী বালিশ নিয়ে হাজির। চাটাই বিছিয়ে লোকটা তার উপরে কাঁধের কালো কাপড়ের থলেটা রাখলো। আরাম করে বসলো। সর্দার আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল বাড়ির সর্ব উত্তরের ঘরটা হচ্ছে ইবলিসদের । আর এই ঘরটা বাড়ির সর্ব দক্ষিণের। সর্দার আবারও ভেতর বাড়িতে চলে গেল। অল্পক্ষণ পরেই ভিতর বাড়ি থেকে একটা কেরোসিনের বাতি জ্বলতে জ্বলতে বাইরে বেরিয়ে এলো সর্দারের হাত ধরে।

‘ তোমার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো বন্ধু,’ বিণীত স্বরে বললো লোকটা। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ভিতরের বাড়িতে ঢুকে গেল সর্দার। লোকটা থলের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কাপড়ে মোড়ানো কি একটা মুখের কাছে নিয়ে পাগলের মতো কী সব অদ্ভুত কথা বলে গেল। তাড়াতাড়ি জিনিসটা আবার থলের ভিতর ঢুকিয়ে রেখে চুপচাপ বসে থাকলো সে।

আঙ্গিনার দিকে একাধিক লোকের উত্তেজিত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। সতর্ক হয়ে গেল লোকটা। শেয়ালের উপস্থিতিতে বাড়ির পোষা কুকুরটার যে অবস্থা!

বৃষ্টির ফোটা আরো ঘন হয়ে পড়তে লাগলো আরো বড় আকারের। পারষ্পরিক কথাবার্তাগুলোও ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো উঠোনের দিকে। লোকটা একটা সিগারেট ধরালো কেরোসিনের বাতির আগুন থেকে। মৃদু একটা শব্দ করে কালো থলের ভিতরে কী একটা নড়েচড়ে ওঠে! লোকটা হাত ঢুকিয়ে যেন কিছু একটা করলো।

গাট্টাগোট্টা শরীরের দুই যুবক ইবলিসদের উঠোনের মাঝখানে এসে থমকে গেল! বৃষ্টি ঝরছে। মাকড়সার জালের মতো অন্ধকার! যুবকদ্বয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাড়ির সর্ব দক্ষিণ ঘরের ডেয়ার উপর উপবিষ্ট কেরোসিনের বাতির আলোয় আলতোদৃষ্ট লোকটাকে।

খবর পেয়ে ততক্ষণে ইবলিসের মা বাতি হাতে ভেতর বাড়ি থেকে বাইরের ডেয়ায় এসে দাঁড়ালেন। ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন তিনি: ‘ কি রে ওডা, উধা ঊধা ফুডত্ থিয়াই এরে বিষ্টিত্ ভির্ঝ ক্যা অ পুত্ ?’

14[1] ‘ অ মা, উইথারঅ ডেয়ার কোণাৎ বাত্তি জ্বালায় বোই রোইয়েজে হিবা কন্?’ মাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটা করলো দুই যুবকের একজন, ইবলিস।

‘ ও, ওই বেডা না? হিবাতঅ অ পুত্ পুরানা বতল কিনন্যা। বিষ্টিরলাই আজিয়া  হিতার ডেরাত্ ফিরিৎ ন পারে পাআনলার। তাড়াতাড়ি ডেয়াত্ উডি আই অ বাজি। হেঁত্তে আবার জ্বর উডি বোইবো।’  মায়ের আকুতি।

লোকটা কালো থলেতে হাত ঢুকিয়ে কী যেন হাতরালো।

‘অ মা, হিতি বতল কিনন্যা নঅ। ঠিক জাগাত জাল বোয়াইয়েরে ফুইক্যা মারি বোই রোইয়ে যে।’ কথাগুলো বলে চলে যাবার জন্য উদ্যত হতেই হাতের বাতিটা ডেয়ায় রেখে মা দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে আটকালেন। জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেলেন ডেয়ার উপরে। ইবলিস ওখানে দাঁড়িয়েও শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো লোকটার দিকে।

মা জড়িয়ে ধরে সন্তানকে সাইবারান্দা দিয়ে ভেতরের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। অন্য যুবকটাও সাথে আছে। নিজের আঁচল দিয়ে মা মাথা মুছিয়ে দিলেন ছেলে আর ছেলের বন্ধু দুজনেরই।

ছেলেকে আর তার বন্ধুকে খাটের উপর বসিয়ে মা রান্নাঘর থেকে এক থালা পিঠা এনে টেবিলের উপর রাখতেই ইবলিস উঠে দাঁড়িয়ে বললো:‘ অ মা, ওই বেডা বতল কিনন্যা নঅ। আজ্রাইল আস্যেযে আজ্রাইল।’ কথাটা বলেই সে দ্রুত পদক্ষেপে কক্ষ থেকে বের হয়ে ডেয়ার দিকে চলে গেল। পিঠাভর্তি থালা হাতে মা ছুটলেন সন্তানের পেছনে।

‘ অ পুত্,  অন্তত: উগ্যা পিডা ওইলেও মুখত্ দি যানা, অ পুত্.’ মায়ের আকুল আবেদন অগ্রাহ্য করে ইবলিস ততক্ষণে উঠোন পেরিয়ে আঙ্গিনার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। মায়ের বিলাপ ধ্বনি আচমকা ঢাকা পড়ে গেল র্যাবের হুঁইশেলের তীব্রতায়!

প্রতিটি ঘরের বাসিন্দারা অতি দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলো। দাদীর সাথে অন্য সদস্য সদস্যারাও বাইরে এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলো! একি, মশারীর ভেতর থেকে যে লোকটা বের হয়ে এলো সে তো পুরোনো বোতল ক্রেতা লোকটা না! এতো র্যাবের পোষাক পরিহিত অন্য এক লোক!

যে শিশুটি তাকে এনে এ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে, সেই সে শিশু সর্দার, মতিয়ুর যার নাম, অবাক বিস্ময়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো:‘ বন্ধু, তুঁই তোইলে এতদিন ভিংচাই কইরজ্য যেনা!? তুঁই তো দেইরযে র্যাবের মানুষ, পুরানা বতল কিনন্যা ন!?’

মতিয়ুরকে বুকে জড়িয়ে ধরে লোকটা বলতে থাকে,‘বন্ধু, ওটা ছিল আমার ছদ্ধবেশ। আমি আসলে একজন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সদস্য। ’

ওদিকে হ্যাণ্ডক্যাপ পরিয়ে ইবলিসকে যখন র্যাবের সদস্যরা কাদা চর্চিত রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন তার বুড়ি মায়ের পিঠার থালা হাতে আহাজারিটা অনেকের চোখে কুয়াশা সৃষ্টি করছে।

মতিয়ুর লোকটার হাতের অত্যাধুনিক ওয়াকিটকিটা হাতে নিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে তার দাদীকে লক্ষ্য করে বললো:‘অ দাদী, আঁইও একদিন তেঁইর নান গোয়েন্দা ওইয়ুম।’

সবাই হেসে ওঠার পর লোকটা দাদীকে কদমবুচি করে উঠোনের দিকে পা বাড়ালো।

‘ আজগুবি কাণ্ড! ওই গুরিন্দা বেডা ক্যান গরি গোডা গ্রামবাসির চোখত্ এতদিন ধরি ধুইল পড়া দি গেল দেখ্যনি! ত তে একখান ভালা কাম গরি গিয়ে। তারে আঁই অন্তরত্তুন দোয়া গরির,’ প্রচণ্ড বিস্ময় মাখা কণ্ঠে কথাকটি বলে গেলেন দাদী।

‘ বন্ধু, তোঁয়ার বতলভর্তি লাই!’ মতিয়ুর চিৎকার করে বললো।

‘ওটার আর প্রয়োজন নেই বন্ধু, পারলে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিও,’ কথাটা শেষ হতেই আঙ্গিনার অন্ধকারে মিশে গেল লোকটা।

-১২ আগষ্ট, ২০১৩।

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.