গল্প / ডেভিড ব্লাকম্যান

গল্প / ডেভিড ব্লাকম্যান

গল্প রেজানুর

সিসট্যান্ট ম্যানেজার সোয়ান বললেন, অ্যা-টি-ক, গেড ইয়োর জ্যাকেট, দ্য ট্রাক ইজ হিয়ার। আমি আতিক। আমেরিকান বস আমাকে আতিক থেকে অ্যাটিক, মাঝে মাঝে অ্যান্টিক ব’লে ডাকেন। হেসে নাম মেনে নিই।

নভেম্বর মাস প্রায় শেষ। সবকিছুই হিম। বাতাস, রোদ, রাস্তা মানুষজন সবই জড়োসড়ো। এইরকম সকালে কেবল রোদ ফুটছে। মালপত্রের বহর নিয়ে ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। পেছনের আড়াল খুলে মাল নামিয়ে সাজিয়ে রাখছে ফুটপাতে। আমি ট্রলি নিয়ে আসতে আসতে একটু গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, ডেভিড… কাম, ডেলিভারী ট্রাক ইজ হিয়ার।

ম্যানহাটানের অ্যামস্টারডাম এভিন্যুর ডুয়েন রীডে কাজ নিয়েছি নতুন। ডেভিড আমার মাসখানেক পরে জয়েন করেছে। কৃষ্ণকায়, ছিপের মতো লম্বা শরীর। বিশ বাইশ বছর বয়স। লগির মতো লম্বা পা দু’পাশে বেঁকিয়ে, পেছনে একটু হেলে হেলে হাঁটে।

আমি ট্রলি নিয়ে বের হয়েছি। পেছনে ডেভিডের ট্রলির ঘর্ ঘর্ শব্দ। থরে থরে বক্স সাজিয়ে রাখছে ট্রাকের লোকেরা। আমরা ভেতরে আনছি। আমার কাজ বেবী সেকশানে। ডেভিড ডিওডোর‌্যান্ট আইল দ্যাখে।

মালপত্র কিছুটা সাজিয়ে আধঘন্টা বিরতিতে বাইরে গেলাম। নাস্তা আর দুপুরের খাবার পাশের ফার্স্ট ফুডের দোকানে সেরে নিই। আমাকে আসতে দেখে হাসলো সেলিম। মায়ানমারের ছেলে। দেখলে বাঙালি ব’লে ভুল হয়। ফর্সা গোলগাল মুখ। নাকের নিচে একফালি গোঁফ। হাসলে সাদা সাজানো দাঁতের দ্যুতি ছড়িয়ে যায়। সেই শুভ্রতার ভেতর হুড়মুড় ক’রে ঢুকে পড়ে দু’চারটে কৃষ্ণ-গুম্ফ-রেখা। আমার দিক থেকে হাসি ফিরিয়ে টর্চের মতো মেলে ধরলো ওর সহকর্মী মারিয়ার দিকে। মারিয়া ইন্দোনেশিয়ার মেয়ে। অল্প-বয়সী নিটোল এক লাল পুতুল। দেখা হলেই দু্’এক লাইন ইন্দোনেশিয়ান বলার চেষ্টা করি। অনেক আগে বাংলাদেশে এক প্রাইভেট কম্পানিতে চাকুরি করতে এসেছিলো ইন্দোনেশিয়ার ছেলে, এডি রাশনিডি কার্তাশুয়ানডা। ওর কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলাম ‘আপা খবর?’ (কেমন আছো); ‘ছায়া বাইক বাইক (আমি ভালো আছি; ‘ছায়া ছিনতা কামু’ (আমি তোমাকে ভালোবাসি) টাইপ কিছু কথাবার্তা।

আধা-ঘন্টার ব্রেক আমার। এর মধ্যে হালকা কিছু খাবারের সাথে এককাপ কফি। বাসায় ফিরে যাওয়া পর্যন্ত চলবে তাতে। কিছু একটা আনতে ভেতরের রুমে গিয়েছিলো মারিয়া। একহাতে ট্রে উঁচু ক’রে ধ’রে অন্যহাত উঠিয়ে আমার দিকে নাড়তে নাড়তে কাউন্টারের পেছনে এলো। বললো, হেই আ-তি-ক, হোয়ার হ্যাব ইউ বীন, ডিডিন্ট সী ইউ ফর অ্যা হোয়াইল? হেসে বললাম, জাস্ট টুক্ ছাম টাইম অফ, মারিয়া। অ্যা’ম ব্যাক নাও’। আমাদের কথোপকথনে মারিয়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হাসলো সেলিম। হাতের কাজ গুছিয়ে আবার আমার দিকে তাকিয়ে মারিয়া বললো, ও…খে। য়োয়াট ইউ লাইক টু হ্যাভ টু ডে?  আমি একটা করর্ন মাফিন (বাংলাদেশের ভাঁপা পিঠার মতো অনেকটা) গরম ক’রে সাইডে এক টুকরো বাটার দিতে বললাম। সাথে এককাপ কফি। সেলিম পাশ থেকে বললো, আপকো আজ মেই নয়ি তারাহকি এক কাপ কফি পিলা রা’হু’। সেলিম হিন্দি কীভাবে শিখেছে সেটা আমার কাছে বিস্ময়। বুঝতে পারি মোটামুটি, বলতেও পারি দু’এক লাইন। বললাম, কউনছা কফি?’  ‘ইছকো ক্যাহতে হে হেইজেল নাট’। বললো সেলিম।

কফির প্রতি বরাবর দুর্বলতা আছে আমার। চমৎকার লাগে এর ঘ্রাণ। নতুন স্বাদের কফি আসছে। ভেতরে অজানা কৌতুহল। সেলিম নিজে টেবিলে কফি পৌঁছে দিলো। গরম কাগজের কাপ দু’হাতের তালু দিয়ে চেপে নাকে কাছে এনে গন্ধ নিলাম। প্রাণ জুড়ানো ঘ্রাণ। স্টোর থেকে দু’মিনিট হেঁটে আসতে আসতে জমে গিয়েছিলাম একেবারে। হাত দুটো এখনও ঠান্ডা। কফির কাপের স্পর্শে আরাম বোধ হলো। মারিয়া মাফিন নিয়ে এলো একটু পর।

গল্প রেজানুর

স্টোরে ফিরে দেখি ম্যানেজার মোহামেড ক্যাশ রেজিস্টারে কাউকে কী যেন দেখিয়ে দিচ্ছেন। একটু সরে গেলে দেখলাম অনিতা দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে আসতে দেখে দু’জনেই ফিরে তাকালেন। কাস্টমার না থাকায় ম্যানেজার বললেন, ‘ব্যাক ফ্রম দ্য ব্রেক?’ ‘ইয়েস’, আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর। হালকা হাসলেন অনিতা।

ডেভিডের আইল পার হয়ে আমার আইলে যেতে হয়। যেতে যেতে দেখলাম, ডেভিড একমনে ছুরি দিয়ে বক্স কেটে কেটে মাল লাগিয়ে দিচ্ছে শেলফে। পেছন থেকে ওর কাঁধে হাত রেখে আস্তে ক’রে বললাম, ওয়ার্কিং  হার্ড ডেইভিড?  ঘাড় ফিরিয়ে মিষ্টি ক’রে হাসলো ও।

আমার বেবী সেকশনের মাঝখানে পাহাড়ের মতো সাজানো বড়ো বড়ো বক্স। বক্স কাটা ছুরি এনে এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম। কোন্ পাশ থেকে শুরু করবো ভাবছি। বেশী বড়ো বক্সগুলোয় আসে ন্যাপকিন, টয়লেট পেপার মেয়েদের বিশেষ সময়ে ব্যবহার করার প্যাড। অপেক্ষাকৃত ছোট বক্সে গুঁড়ো দুধ, দুধের বোতল, বেবী শ্যাম্পু এইসব। বড়গুলো থেকে আগে শুরু করলাম। মিনিট পনেরো পরেই জায়গাটা অনেকটা ফাঁকা হয়ে এলো। দু’এক লাইন গানে টান দিতে দিতে অভ্যস্ত হাতে শেলভে ভরছি জিনিসপত্র। ‘ইউ সিং বেরি গুড অ্যাটিক’ তাকিয়ে দেখি ওলগা হাসছে পেছনে দাঁড়িয়ে। ও কখন এসেছে টের পাই নি। মৃদু হেসে বললাম, ত্যাংস্, মে আই হেলপ ইউ উইদ এনিতিং? ওলগা বললো, ও নো নো নো, আই জাস্ট নিড এ প্যাড। ওলগা প্যাডের শেলফের দিকে এগিয়ে গেলে আমি কাজে মন দিলাম।

একটু পর আবার আমার সংগীতের সুর-ভঙ্গ হলো। ‘হ্যাভ ইউ সীন ফারমিন অর ফ্রাংকি, অ্যাটিক?’ এসিট্যান্ট ম্যানেজার ইভলিন দুপদাপ ক’রে এসে জিজ্ঞেস করলো। ‘মে বী দে আর ইন দেয়ার ব্রেক। বললাম আমি। ‘বোথ ক্যান্ট গো টু ব্রেক এ্যাট দ্য সেইম টাইম, দে শুড নো দিস্ বাই নাউ?। আমি ভুরু কিছুটা উঠিয়ে, ঘাড়টা দু’দিক থেকে সামান্য উঁচু ক’রে হাতের তালু উল্টিয়ে নীরবে জানালাম, এ-তো তাদের কাছ  থেকেই জানতে পারবেন মিস ইভি।

ফারমিন আর ফ্রাংকি  ফিরে এলে ব্রেকে যাবার প্রস্তুতি ডেভিডের। ব্যাক রুমের দিকে যেতে দেখলাম ওকে। একটু পরে জ্যাকেট গায়ে দিয়ে, কানে ওয়াকম্যানের তার লাগিয়ে একহাতে ফ্লাইং সসারের চাকতির মতো সিডি প্লেয়ার নিয়ে দুলতে দুলতে বের হলো। চোখাচোখি হলে মুখে সেই মিষ্টি হাসি মাখিয়ে বললো, আ’ল বী রাইড ব্যাক। আমিও হেসে মাথা নাড়লাম।

মালপত্র সাজিয়ে ব্যাকরুমের ভাঙা বক্সগুলো মেশিনের মধ্যে ঢুকিয়ে তারের সুতো দিয়ে বড়ো বড়ো চারকোণা  বলের মতো জিনিস স্টোরের সামনে এনে রাখতে লাগলাম আমরা। ময়লার ট্রাক এসে নিয়ে যাবে ওগুলো। আমি ফারমিন ফ্রাংকি আর ডেভিড সবার একসাথের কাজ এটা। ফ্রাংকি আমার অন্যপাশের পেট্-ফুড (জীবজন্তুর খাবার) আইলে কাজ করে। ফারমিন দ্যাখে শ্যাম্পু আইল। আমরা ভাঙা বক্সের গোল্লা একে একে বাইরে আনছি। শেষবার যখন বাইরে গেলাম, দেখলাম কম বয়সী একটা মেয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে কয়েকবার স্টোরের ভেতরে এসে ফ্রাংকি’র সাথে কথা বলতে দেখেছি। কচি লাউয়ের মতো লাবণ্যময় মেয়ে। গোলগাল গড়ন। লালচে ফর্সা মুখমন্ডলে পুরু ঠোঁটদুটো রক্তাভ। ঘন কালো চুলের ঢেউ গড়ানো কোমর পর্যন্ত। একদিন ফ্রাংকির কাজ ছিলো না। ও খুঁজতে এসেছিলো ভুল দিনে। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে শেষে আমার কাছে এসে জানতে চেয়েছিলো, হ্যাব ইউ সীন ফ্রাংকি? বলেছিলাম, হী ইজ্ অফ টু-ডে।

আমাকে দেখে হাসলো মেয়েটি। বললাম, ওয়েটিং ফর ফ্রাংকি? মাথা নাড়লো। বললাম, উই আর অলমোস্ট ডান্’। ও বললো, ও খে। আমার পালা শেষে ট্রলি রাখতে ভেতরে গেলে ফ্রাংকির মুখোমুখি হলাম। বললাম, হেই ফ্রাংকি, দ্যাট গার্ল ইজ হিয়ার এগেইন। ইজ শী ইয়োর গার্ল ফ্রেন্ড, শী লুকস্ বেরি ইয়াং দো। আমার কথায় হেসে উঠলো ফ্রাংকি। আমি তাকিয়ে থাকলাম। হাসি থামলে বললো, কাম অন অ্যাটিক। অ্যালেক্স ইজ নট মাই গার্ল ফ্রেন্ড ফুল্যি, শী ইজ নট এয়িটিন ইয়েট। শী ইজ গোয়িন টু ওপেন হার লেগস্ ফর মী সুন’। আমি হা হয়ে গেলাম। ফ্রাংকি হো হো ক’রে হেসে উঠলো। ডেভিড হাসি শুনে কাছে এলো আমাদের। বললো, অ্যাটিক, উই শুড হ্যাব আওয়ার গার্ল ফ্রেন্ড টু…, হোয়াট ডু ইউ থিংক? আমার থিংকিং ক্ষমতা কমে যেতে লাগলো। না, মনে হয় বাড়লো। ওই মেয়েটা ফ্রাংকির সামনে ওর দুপা দুদিকে দিয়ে সমর্পিতা হবে। কুমড়ো ফুলের মতো নাজুক শান্ত মেয়েটি ফ্রাংকির উদ্দাম পৌরুষের নিচে পিষ্ট হবে শিগগির। শরতের সকালে উদাসীন পথিকের পায়ের তলায় মথিত ঝরা শিউলফুলের ম্রিয়মান স্নিগ্ধতার কথা মনে হতে লাগলো।

পরের দিন। বিকাল শিফটে কাজ আমার। এস্টোরিয়ার ব্রডওয়ের বাসা থেকে বের হয়েছি কেবল। বেলা একটা। কাজ শুরু দুটো থেকে। ‘এন’ ট্রেন পাল্টিয়ে অন্য ট্রেনে অ্যামসটারডাম এভিনুতে যেতে হবে। ব্রডওয়ের স্টেশন বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের পথ। দুটো স্ট্রীট পার হলে পথের পাশে কিছু পাবলিক টেলিফোন বুথ। সারি সারি তিন চারটে বুথে সাদা স্টীলের তারের ফোন মুখ গুঁজে থাকে মায়ের কোলে শিশু ঘুমিয়ে থাকার মতো। কেউ ওঠালেই বোঁ বোঁ শব্দের মৌমাছি গুঞ্জন ক’রে ওঠে। দু’একবার ইমারজেন্সি ফোন করেছি কয়েন দিয়ে। বাসার ফোনই ব্যবহার করি বেশি।

ধীরে ধীরে হাঁটছি। হাতে সময় আছে, তাই তাড়া নেই অতটা। হঠাৎ নিচু স্বরে কিছু বাংলা কথা ভেসে এলো কানে। চাপা টানা টানা মোলায়েম ভেজা ভেজা স্বর। পুরুষের কন্ঠ। তবু তাতে মেয়েলি স্বরের বিগলন। ‘তুমি সত্যি কইরা কও, আমারে ভালো বাসো না? একটা দিনও তুমার মুখ থাইকা ‘ভালোবাসি’ কতাডা শুনতে পারলাম না। আইজ কামে যাবার আগে এটটাবার কও, কও…’। হাঁটার গতি কমে এলো আমার। কারও এই ধরনের একান্ত কথায় আড়ি পাতা অন্যায়। তবু আকর্ষণ কমানো গেলো না। ফোন করার ভান করে একেবারে পাশের বুথে দাঁড়ালাম। পাশের লোক টেরও পেলো না। ওপাশের উত্তরের অপেক্ষায় প্রাণ হাঁসফাস করছে তার। আমি বুথের চেটাল মেটালে কান লাগালাম। দীর্ঘ প্রতিক্ষিত শ্বাস শুনতে পাচ্ছি। একটু পরে যান্ত্রিক মিহি আওয়াজে হি হি শব্দ শুনলাম। ওপারের রমণীটি আরও রমণীয় নাটকীয়তায় তড়পাচ্ছে বেচারাকে। ‘আইচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যখন কইবাই না, তহন চললাম আমি। রাকি। বিদায়। চুমুম মু চুমুস!’ ফন ক’রে বুথের বাইরে এলাম। দেখলাম, লোকটি একমনে বুথের সেই ধাতব ফোনটা কারও  মুখের মতো দু’হাতে উঠিয়ে এনে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছে। তার আবেগ-আদ্র চুম্বনের রস লেগে যাচ্ছে ফোনের গায়ে।

গল্প রেজানুর

সাবওয়ে (পাতাল রেল) থেকে উপরে উঠেছি। অল্প হাঁটলেই অ্যামস্টারডাম এভিনুর কোণায় স্টোর। সামনে একটা নিউজ স্ট্যান্ড। ছোট্ট ছাউনির নিচে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ম্যাগাজিন। চালের কিনারে ঝুলানো কিছু ম্যাগাজিন। সামনে মেলে দেয়া নিউইয়র্ক টাইমস্ নিউইয়র্ক পোস্ট ডেইলি নিউজ বা অন্যান্য দৈনিক পত্রিকা। দুটো বাজতে এখনও মিনিট পনেরো বাকি। নিউইয়র্ক টাইমস্ কিনলাম একটা। খুব পছন্দের পত্রিকা আমার। যদিও অতি কষ্ট ক’রে ক’রে পড়তে পারি। বুঝি তার চেয়েও কম। ইংরেজি শেখার চেষ্টাটা শুধু হয়। বিএ পাশ ক’রে এসেছি এই দেশে। পাখির বুলির মতো কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত ক’রে কোনোরকমে পাশ নম্বর পেয়েছিলাম ইংরেজিতে।

পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে দেখি ডেভিড দাঁড়ানো। আমার অপেক্ষা করছে। ওর-ও ক্লোজিং শিফট আজ। কাজ শুরুর আগে সোসাল সিকিউরিটি নম্বর পাঞ্চ করতে হয়। ডেভিড পাঞ্চ ক’রে ওর সেকশনে চলে গেছে। আমি পাঞ্চ করার জন্যে চেঞ্জরুমে ঢুকলাম। দেখলাম অনিতা জ্যাকেট খুলছেন। আমাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কায়সে হো আতিক? আমি বললাম , ঠিকঠাক, আপ ছুনায়। অনিতা দিল্লির মেয়ে। বহুদিন থেকে কাজ করছেন এই কম্পানিতে। ছেলেমেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। যে যার মতো চাকুরিও নিয়েছে। জীবনের তৃতীয় অংশে এসেও নিজের আয়-রোজগার নিজেই বের ক’রে নেন অনিতা। আমাকে দেখলে মাতৃভাষা হিন্দিটা যেনো টগবগিয়ে ওঠে তাঁর মুখে। আমি ভুল হিন্দিতে জবাব দেবার কোশেশ করি।

একটু পর ক্যাশ-রেজিস্টারের আরেক মেয়ে শিফন রুমে ঢুকলো। জ্যাকেট খুলে দেয়ালে লটকানো আলনায় রাখলো। হিড় হিড় ক’রে সোয়েটার ওঠালো জিনসের প্যান্টের ওপর থেকে। সোয়েটারের সাথে সাথে নিচের ছোট্ট টী-শার্টও উঠে এলো। কোমর থেকে বেশ উঁচুতে উঠে গেলো কাপড়। অনিতা তখনও গোছগাছ করছেন। অনিতার সাথে কথার ফাকে চোখ চলে গেলো শিফনের দিকে। ওর হাত দু’টো উপরে ওঠানো। কোমর থেকে পেটের প্রায় উপর পর্যন্ত আলগা। ব্রা বেরিয়ে এলো চোখের সামনে। উর্বশী নদীর উচ্ছল ঢেউ যেনো দেখলাম এক ঝলক।  চোখ ফিরিয়ে অনিতার দিকে তাকাতেই মুচকি হেসে মুখ নিচু করলেন অনিতা। আমি নাম্বার পাঞ্চ ক’রে বেরিয়ে এলাম।

প্রতিদিনের কাজের রুটিনে দিন যেতে লাগলো। শীত শেষে গ্রীষ্মের আভাস এলো। সেই দারুন মাস এপ্রিল এখন। টি.এস. এলিয়ট যেমন বলেছেন, ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মানথ্। সাপের খোলসের মতো মানুষেরও খোলস যেন খসে পড়েছে। শীতে জড়োসড়ো মানুষগুলো নতুন নতুন পোশাকে কী সুন্দর লাগে। হাফ-প্যান্ট আর অতি ছোটো কাপড়ে ঘুরে বেড়ায় মেয়েরা। দলবেঁধে চললে মনে হয় আকাশকে আরও নীল হতে দিয়ে নিচে নেমে এসেছে মেঘগুলো।

খৃস্টানদের অন্যতম বড়ো ধর্মীয় দিন ইস্টার আসন্ন। আমার কাজ ছিলো ইস্টারে। ডেভিডকে বললাম, আর ইউ গোয়িং টু ওয়ার্ক অন ইস্টার? ডেভিড এদিক-ওদিক জোরে মাথা নেড়ে বললো, নো, ম্যান। দ্যাটস্ ইস্টার, ইস্টার’। ধর্মানুভূতি প্রবল ডেভিডের। প্রায় প্রায়ই নানারকম কথা জিজ্ঞেস করে। সেগুলো বেশিরভাগ আধ্যায় সৃষ্টিজগত আর স্রষ্টা সম্পর্কিত। এরকম বয়সে ওর এমন ভাবনায় অবাক হই আমি। একদিন বললো, অ্যাটিক, ডু ইউ নো হোয়াট গড ক্যান নট ডু?’ আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর খুঁজতে লাগলাম। মনে মনে বললাম, গড কী পারেন না। সবই তো পারেন বলেই জেনেছি। আমার ভাবনা বেশিদূর এগোতে দিলো না ডেভিড। হেসে বললো, গড ক্যান নট লাই। আমার চোখ বড়ো বড়ো হলো। ওর কথাটা ঘুরপাক খেতে লাগলো মনে। ‘গড মিথ্যা বলতে পারেন না….’।

ব্রেকের সময় ক্ষিদে লেগে গেলো বেশ। পাশের চায়নিজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে শ্রিম-ফ্রাই-রাইস (ভাজা ভাতের ভেতর ছোট ছোট চিংড়ি মাছ) অর্ডার দিলাম। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। উপর দিকে তাকিয়ে খাবারের মেনুর দিকে তাকিয়ে আছি। পেছন থেকে হঠাৎ দু’হাতের তালুর আড়াল দৃষ্টি ঢেকে দিলো আমার। আলতোভাবে চেপে রইলো চোখের ওপর। আমি আস্তে দুহাত পেছনে নিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চাইলাম তাকে। আমার ডানহাতের আঙুলগুলো দেবে গেলো কারও চোয়ালে। হাত সরিয়ে শব্দ ক’রে হেসে উঠলো মারিয়া। ওর রসিকতায় চায়নিজ মেয়েটিও হেসে ফেললো।

রেস্টুরেন্টের কোণার টেবিলটায় বসলাম আমরা। ‘ইউ আর নট ওয়ার্কিং টুডে? জিজ্ঞেস করলাম ওকে। ‘আ’ম জাস্ট ডান, ফ্রি নাউ। জবাব দিলো মারিয়া। বাইরে তাকালাম আমি। বিকেল ঢলে এসেছে। কাঁচাসোনার মতো রোদ। সেই রোদ গায়ে মেখে শোঁ শোঁ ক’রে গাড়ি চলছে অ্যামসটারডাম এভিনুতে। জানালার অদৃশ্য কাঁচের ভেতর দিয়ে দৃষ্টি মেলে দিয়েছি দূরের দালানের গায়ে। মিহি জলছাপের মতো মারিয়ার মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো কাঁচের ওপর। ও তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। বেশিক্ষণ ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখাটা অশোভন মনে হলো। মুখোমুখি সোজা হয়ে বসলাম। ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। সেই দৃষ্টি বহুবার দেখেছি ওর চোখে। সাথে সেই আলো-আঁধারময় হাসি। তবে আজ যেনো বেশি তীক্ষ্ণ ওর চোখ। কিছু একটা বলতে গেলাম। আমার আগেই মারিয়ার স্বর ফুটলো। বললো, আই নীড টু টক্ টু ইউ আতিক। আমি বললাম, ও-কে, বাট নট হিয়ার। লেটস্ গো আউটসাইড।

গল্প রেজানুর

রেস্টুরেন্টে ভিড় বেড়ে গেলো। আমার অর্ডার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে বাইরে গেলাম আমরা। রেস্টুরেন্টের সামনে একটা মেপল গাছের চারা বেশ বড়োসড়ো হয়ে উঠেছে। তার তলায় দুজন যুবক-যুবতী নজরে এলো আমাদের। জড়াজড়ি ক’রে আছে। এক হয়ে আছে যেনো দুটো শরীর। নিবিড় চুম্বনে বুঁদ হয়ে আছে ওরা। আমি একনজর দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। মারিয়া তখনও দেখছে ওদেরকে। আমার হাত ধ’রে টেনে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। হাত ছাড়িয়ে নেয়া রুক্ষতা হবে ভেবে ওকে ধ’রে থাকতে দিলাম। শুধু স্পর্শের আন্তরিকতা বুঝতে দিলাম না। কেমন যেনো এক নির্লিপ্ত সমর্পণ। ‘ডু ইউ লাইক হোয়াট দে আর ডুয়িং দেয়ার, আতিক’? আমার থুতনি ওর তালু দিয়ে তুলে চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলো মারিয়া। ওর ঠোঁট এগিয়ে আসছে। আমি কাঁপছি। আমার ঘাড় পেঁচিয়ে নিচে নামিয়ে আনছে মাথা। ওর ঠোঁট আমাকে ছোঁয়ার আগে মুখ সরিয়ে নিলাম। আহত হয়ে তাকালো ও আমার চোখের দিকে। সেই চোখে প’ড়ে নিলো অন্য কারো নাম। তারপরও মারিয়া মরিয়া হয়ে শক্ত ক’রে হাত চেপে ধরলো আমার। আলতো ক’রে ছাড়িয়ে নিলাম।  ফুঁপিয়ে উঠে দ্রুত হেঁটে গেলো মারিয়া। ওর চলে যাওয়া দেখার সাহস হলো না।

সপ্তাহখানেক পর কাজ ছেড়ে দিলাম। ম্যানেজার অবাক হলেন। বললেন, আই নিডেড ইউ, ইউ ওয়্যার গোয়িং টু বী অ্যান এসিসট্যান্ট ম্যানেজার, আতিক’। আমি ধন্যবাদ আর অপারগতা জানালাম। এরপর একদিন সময় ক’রে শেষ সপ্তাহের চেক নিতে গেলাম। ম্যানেজারের মুখ অন্ধকার। মুখ তুলে একটু শুধু দেখলেন আমাকে। কিছুক্ষণ পর চেক এনে হাতে দিলেন।

ফারমিন আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। ওর হাতে বড়ো একটা কার্ড। ফোল্ডিং কার্ড মেলে ধরলো আমার সামনে। সেখানে বিক্ষিপ্ত কিছু শোকবার্তা লেখা। সেগুলোর দু’একটা প’ড়ে ফারমিনের মুখের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালাম। ও আস্তে শোকার্ত স্বরে বললো, ডেভিড ইজ ডেড’। আমার মস্তিষ্ক ফাuকা হলো। কানের পাতাদুটো ভারী হয়ে উঠতে লাগলো। অতিকষ্টে শুধু বলতে পারলাম, হা-ও? ’ছামবডি কিল্ড হিম লাস্ট নাউট হোয়েন হি ওয়াজ গোয়িন হোম আফটার ওয়ার্ক। দে ওয়ান্টেড টু স্ন্যাচ হিজ ওয়াকম্যান’। বললো ফারমিন।

তাকিয়ে দেখি ফ্রাংকি হেসে হেসে খুনসুটি করছে ইভলিনের সাথে। ইভলিন গ’লে গ’লে গড়িয়ে পড়ছে ফ্রাংকির গায়ের ওপর। সোয়ান ওলগার কোমরে কাতুকুতু দিচ্ছে। ওলগা হি হি করে সাপের মতো কোমর বেঁকিয়ে দৌঁড়ে পালাচ্ছে পাশের আইলে।

সাউথ ইসটন, ম্যাসাচুসেটস্

E-mail : rezanur@comcast.net

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.