থ্রিজি লাইসেন্স নিলামের বাঁকি আর মাত্র কয়েক দিন। বিভিন্ন সূত্র মতে জানা গেছে সবচেয়ে বেশি তরঙ্গ নেবে দেশের সব থেকে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন। কিন্তু হঠাৎ করেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত২৬ আগস্ট সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষার পর সরকারের দ্বিতীয় লক্ষ্য গ্রামীণফোন। তিনি এ সময় আরও জানান, গ্রামীণফোনের নাম ও লাইসেন্স অবৈধ। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটি থ্রিজি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে নিলাম প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদন : মিজানুর রহমান সোহেল
গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার জন্য গঠিত কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যে অধ্যাদেশে গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে হিসেবে ‘গ্রামীণ’ নামটি আর কেউ ব্যবহার করতে পারে না। সে অনুযায়ী ‘গ্রামীণফোন’ নামটিই অবৈধ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। শুধু তাই নয়, অর্থমন্ত্রীর দীর্ঘদিন ধরে বলে আসা ‘গ্রামীণফোনের লাইসেন্স অবৈধ’ পুনরাবৃত্তি করেন। গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল সোমবার রাতে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে কথা বলেন। গ্রামীণফোনের লাইসেন্সকে অবৈধ উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষার পর এবার সরকারের দ্বিতীয় লক্ষ্য গ্রামীণফোন।অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী এক মাসের মধ্যেই বাস্তবায়নের জন্য গ্রামীণ কমিশনের সুপারিশগুলো নির্বাচন করা হবে। বর্তমান সরকারের মেয়াদেই তা বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানান তিনি। গ্রামীণ কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসির প্রতিবেদনটি ‘আংশিক’ মন্তব্য করে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘তবে প্রতিবেদনটির বিষয়ে আমি সন্তুষ্ট।’ গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়ে সরকারের অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে, গ্রামীণ ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য ও এখানে যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের স্বার্থরক্ষা করা। এটি করতে গিয়ে অন্য কোথাও ছাড় দিতে হতে পারে। গ্রামীনফোন নামটির বৈধতা সম্পর্কে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘ইউনূস সাহেবের দাবি, গ্রামীণফোনের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমরা বলি, আছে। ইউনূস সাহেব তার নোবেল বক্তৃতাতেও বলেছেন, গ্রামীণফোনের মাধ্যমে নারীরা প্রযুক্তি শিখবে, তাদের ক্ষমতায়ন হবে। কিন্তু কী হয়েছে, তা তো আপনারা জানেন।’
তিনি বলেন, ‘গ্রামীণফোনের লাইসেন্স অবৈধ। লাইসেন্সটা একজন নিয়েছেন আর ব্যবহার করছেন আরেকজন। কমিশনের প্রতিবেদনেও এ কথা বলা হয়েছে। কঠোরভাবে আইন অনুসরণ করা হলে তাদের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু যেহেতু গ্রামীণফোন দেশের একটি বৃহৎ বৈদেশিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সেজন্য গ্রামীণের লাইসেন্স বাতিল করার কথা একবারও বলা হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘এছাড়া গ্রামীণফোনের অধিকাংশ শেয়ার হচ্ছে টেলিনরের। তাকে কীভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে? তাছাড়া গ্রামীণফোন তো গ্রামীণ ব্যাংককে চেনে না, তারা চেনে গ্রামীণ টেলিকমকে। তাদের সম্পর্ক হচ্ছে ড. ইউনূসের সঙ্গে। গ্রামীণফোনের আরো গভীরে গিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে কমিশন।’ ‘গ্রামীণ ব্যাংক একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান’ দাবি করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৯ সালে সরকারি অর্থায়নেই গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংক হচ্ছে স্ট্যাটিউটরি বডি। এর সব শেয়ার সরকারের। কিন্তু ইউনূস সাহেব এটিকে নিজের প্রচারণায় ব্যবহার করেছেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের নাম যেভাবে ব্যবহার করেছেন এবং ব্যাংকের পরিচালকদের জন্য নিজে যে বিধান চালু করেছেন, তা অবৈধ।
গ্রামীণফোনের কাছ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাপ্য টাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি ইউনূস সাহেব জানেন। আর এখানে টাকা লেনদেনের প্রক্রিয়াটিও গোলমেলে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কমিশন পুরো বিষয়টি এখনো বের করতে পারেনি। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ‘আন্তর্জাতিক চাপ’ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুহিত বলেন, ‘ইউনূস সাহেবই এগুলো করিয়েছেন। প্রেসার ফিল করছি এ কারণে যে একেক দিন একেক দেশের মন্ত্রী ও কংগ্রেসম্যানরা চিঠি লেখেন আর তারা সেটি প্রকাশ্যে লেখেন। তাদের এসব চিঠির জবাব দিতে গিয়ে আমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।’ উল্লেখ্য, কয়েক দিন আগে গ্রামীণ কমিশনের সদস্য আজমালুল হোসেন কিউসি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। এ বিষয়ে গত রোববার অর্থমন্ত্রী জানান, সেটি এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কিউসির দেওয়া প্রতিবেদনটি তার একান্ত মতামত, না কি কমিশনের মতামত, সে ব্যাপারে সংশয় রয়েছে। এ জন্য এটি না পড়ে কিছু বলা যাবে না। এ ব্যাপারে কমিশনের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলবেন বলে জানান অর্থমন্ত্রী। কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না বলেও জানান তিনি। গত বছরের ১৬ মে সাবেক সচিব মামুন-উর রশীদকে চেয়ারম্যান করে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের অন্য দুই সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি ও হিসাববিদ মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ।
প্রসঙ্গত, গ্রামীণফোন এখন পর্যন্ত দেশে বিনিয়োগ করেছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে এটাই কোনো একক কোম্পানির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। সরকারি কোষাগারে রাজস্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে বড় কোম্পানি গ্রামীণফোন। গত ১৫ বছরে কোম্পানিটি সরকারি কোষাগারে দিয়েছে ৩০ হাজার ৮৭৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নানা ধরনের কর ও শুল্ক দিয়েছে ১৯ হাজার ৩৭৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বিটিআরসিকে বিভিন্ন ফি হিসেবে দিয়েছে ৩ হাজার ৮১৪ কোটি ২০ লাখ টাকা, লাইসেন্স ও স্পেকট্রাম ফি হিসেবে দিয়েছে ৩ হাজার ২২ কোটি ৯০ লাখ টাকা, বিটিসিএল ও বাংলাদেশ রেলওয়েকে দিয়েছে ২ হাজার ৩০৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং গ্রামীণফোন উইথহোল্ডিং কর দিয়েছে আরও ২ হাজার ৩৫৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
প্রসঙ্গত, কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রামীণফোন থেকে সরকারের পাওনা টাকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যেমন সিম রিপ্লেসমেন্ট ইস্যুতে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) হিসেব মতে পৃথকভাবে কর বাবদ গ্রামীনফোনের কাছ থেকে ১ হাজার ৫৮০ কোটি পাওনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত এই কর তারা তো পরিশোধ করেইনি বরং তা না দেওয়ার অনেক পথ খুঁজছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি এই ইস্যুকে প্রধান করে আরও কয়েকটি ইস্যুতে থ্রিজি নিলামে অংশ না নেওয়ারও হুমকি দিয়ে আসছিল গ্রামীণফোনসহ অন্যান্য মোবাইল অপারেটররা। একই কারণে গত ২৬ আগস্ট থ্রিজি নিলামের ‘বিড আর্নেস্ট মানি’ জমা দেওয়ার শেষ দিনেও টাকা দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৯ আগস্ট।
এবার হঠাৎ করে গ্রামীণফোনকে উদ্দেশ্য করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষার পর এবার সরকারের দ্বিতীয় লক্ষ্য গ্রামীণফোন’। গ্রামীণ ব্যাংকের মতো গ্রামীণফোন টার্গেট হলে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রতিষ্ঠানটি চলে যেতে পারে বলে কিছুদিন আগে এক সেমিনারে জানিয়েছিলেন বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনিল কান্তি বোস। বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন এমন সংকটময় মুহূর্তে গ্রামীণফোন থ্রিজি লাইসেন্স নিলামে অংশ না নিলে পুরো প্রক্রিয়াটাই ভেস্তে যেতে পারে। ফলে দেশে স্বপ্নের থ্রিজি বা সরকারের রাজস্ব আদায় উভয়ই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।