১৯৭৩ সালে সুলতানা কামাল খুকু নিখিল ভারতে গ্রামীণ ক্রীড়ায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে। যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙালির মান রাখতে পারবি তো? খুকু এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন, পারব। কথা রাখতে পেরেছিলেন তিনি। ‘জয়বাংলা’ বলে লংজাম্প দিয়েছিলেন খুকু। সেবার দ্বিতীয় হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে এটাই হয়ে দাঁড়ায় রেকর্ড। পুরো ভারত থেকে আসা সেরা মেয়েদের পেছনে ফেলেন তিনি। পরে কোন এক পুরস্কার বিতরণীতে বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে খুকুকে বলেছিলেন, ‘তুই তো আমার সবচেয়ে প্রিয়।’ খুকু তখনও বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ হননি। তাই জাতির জনকের এই কথা নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে কত হাসাহাসি!
খুকুরা ছিলেন ছয় ভাই, তিন বোন। বকশীবাজারে রেলগেট পেরিয়ে হাতের বাম দিকে বুয়েট হোস্টেলের (তখন আহ্ছানউল্লাহ্ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) দিকে চলে যাওয়া পথটাতে ভাইবোনরা মিলে সকালে জগিং করতেন। বোনদের মধ্যে সবার ছোট খুকু। যেতে যেতে ফুল তুলতেন সেদিনের সেই ছোট মেয়েটি। ফুল কুড়াতে কুড়াতেই একদিন সেরা এ্যাথলেট হয়ে উঠলেন খুকু।
তিনি শুধু একজন ভাল এ্যাথলেটই ছিলেন না, ছিলেন দক্ষ সংগঠকও। মেয়েরা যেন খেলাধুলায় মন ঢেলে দেয়, সেজন্য রীতিমতো ‘কাউন্সিলিং’ও করতেন তিনি। ১৯৬৭ সালে মুসলিম গার্লস কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেছিলেন। তার এক বছর আগেই জাতীয় এ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের লংজাম্পে রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক জিতে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে লংজাম্পে নতুন রেকর্ড গড়ে চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৭০ সালে অল পাকিস্তান উইমেন্স এ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে লংজাম্পে মেয়েদের মধ্যে সেরা হন তিনি। ১৯৭৩ সালে ১০০ মিটার হার্ডলসেও প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন সদাহাস্য মেয়েটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাথলেটিক্সে প্রথম নারী ব্লু খুকু।
খুকুর বড় ভাই বাবুল ছিলেন শেখ কামালের বন্ধু। মৃত্যুর কিছুদিন আগে পঁচাত্তর সালেই হার্ডলসে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন তিনি। সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছিলেন খুকু। মাস্টার্সের ফল বের হওয়ার আগেই ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের এই তারকা।
দেশে-বিদেশে এ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকে যিনি একের পর এক নাটকের অবতারণা ঘটিয়ে দিচ্ছিলেন, ক্রীড়া সাফল্যের আলোচনার শিরোমনিতে চলে আসেন এটাই স্বাভাবিক। অথচ অতীব সখেদে বলতে হচ্ছে যে, এতগুলো উদ্ভাসিত নৈপুণ্য আর বর্ণিল বর্ণাঢ্য জীবন জুড়ে সম্ভবতঃ সেই মহিলা ক্রীড়াবিদকে সর্বশেষ বর্তমান প্রজন্মের মানুষগুলো এত দ্রুতই না ভুলে গেছে। কারোর কিছু স্মরণেও নেই। অতীত ক্রীড়া সাফল্যে তাঁর স্মৃতিমাখা সাফল্য ধীরে ধীরে ধূলি আস্তরণের নীচে চাপা পড়েছে। কিন্তু তাতে কী! দেশের অধিকাংশ ক্রীড়া জনতা তাঁকে ভুলে গেলেও ইতিহাস ঠিকই মনে রাখে। ইতিহাস কাউকে ভুলেনি। কষ্টি পাথরে চেপে রেকর্ড লিপিবদ্ধ রাখা হয়। এবং হবে এমন দূর ভবিষ্যতেও…।
ক্ষয়িষ্ণু ইতিহাসের পাতা খুলে দিলে দেখা যাবে, সত্যিই ক্ষণজন্মা এক জীবনের অপূর্ব বাস্তব কাহিনী। কালের অতীত সাক্ষী গোপালরা সাক্ষ্য দেয়Ñ একটি ক্রীড়া পরিবারে তাঁর জন্ম ও আশৈশব পরিবেশ বেড়ে ওঠা। চিন্তাভাবনা ও স্বাধীনচেতনায় যথেষ্ট উদার। এমন উদারনীতি পরিবেশের মধ্যে সেই পবিত্র ক্রীড়া সংস্কৃতিতে মূল্যায়ন আর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রকাশ করা খুব কমই পরিবারে দেখা যায়। আর দশ জনের মতো স্বাভাবিক বাউন্ডুলের ঘটনা অন্যান্য মেয়েদের ক্রীড়ায় অংশ নিতে অকুণ্ঠ সমর্থন ও উৎসাহ দেয়া হয়, এখানেও তাঁর বেলায় তাই ঘটেছে। সত্যি বলতে কী, তিনি বাবা, মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে খেলাধুলার জড়ানোর জন্য প্রচুর উৎসাহ-উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। যাদের সমর্থনের তাগিদে তাঁর পক্ষে খুব সহজে ক্রীড়াঙ্গনের পদচারণার ক্ষেত্রে পুরোপুরি বিলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বাঙালী বড়ই বিস্মৃতি কাতর জাতি। আজ কিছু ঘটলে কালকে সেটা ভুলে যায়। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বলছেÑ সেই মহিলা ক্রীড়াবিদ এমন কেউ অপরিচিত নন, বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা ক্রীড়াবিদ ‘ব্লু’ খেতাবপ্রাপ্ত। তিনিই হচ্ছেন সুলতানা কামাল। এই নামে বর্তমানে কেউ না চিনলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই চেনে। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের সহধর্মিনী ছিলেন এই সুলতানা কামাল। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের প্রত্যুষে পরিবারে সবার মতো সুলতানা কামালও কিছু বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহী সামরিক ঘাতকদের হাতে গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান। আজ তিনি নেই। যিনি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সমৃদ্ধ সম্ভারপূর্ণ এ্যাথলেটিক্স জগতে অনেক অবদান রেখে গেছেন। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো বা বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিয়ে যেতে পারতেন। তাঁর স্মরণে ধানমন্ডি এলাকায় অবস্থিত মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স তাঁর নামে উৎসর্গ করেছে ‘সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স’ অভিহিত করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে তাঁকে স্মরণ করবে আজীবন উত্তরসূরীর এদেশীয় ক্রীড়া জনতারা।
সুলতানা কামালের যত সাফল্য
ক্ষক্ষ ১৯৬৫-১৯৬৬। তৎকালীন সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান আমল। লাহোরের মাঠে প্রাদেশিক জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সাবেক পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) অংশগ্রহণ করে। এই দুই আসরের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মাঝে শেষোক্ত বছরটায় একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছিল। স্কুল পড়–য়া বয়সী এক কিশোরী অংশ নেন। সেই মেয়েটি ভিনদেশী মাঠে লং জাম্প ইভেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সবাইকে ছাপিয়ে আশ্চর্য কিছু একটা করে দেখানোর সুবাদে এই ইভেন্টে দ্বিতীয় হলেন। সঙ্গে একটা রৌপ্যপদক গলায় ঝুলে স্বদেশে ফেরেন।
ক্ষক্ষ ১৯৬৭, পূর্ব পাকিস্তান। ঢাকায় প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। সেই আসরে সেই হাসি-খুশী আর নির্মল ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী কিশোরীটি শুধু অংশগ্রহণই করলেন না, রীতিমতো মাঠ কাঁপিয়ে তিনি লং জাম্প ও হাই জাম্প ইভেন্ট হতে ২টি রৌপ্যপদক ছিনিয়ে আনলেন। সকল মহলের দৃষ্টি নজর কাড়তে সক্ষম হলেন। দারুণভাবে প্রশংসিত হয়ে উঠলেন।
ক্ষক্ষ ১৯৬৮, এবারেও পূর্ব পাকিস্তান। ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অপ্রত্যাশিতভাবে প্রথমবারের মতো একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হলো। লং জাম্প ইভেন্টে সেই তরুনী ক্রীড়াবিদ একটি স্বর্ণপদক পেলেন। যা তাঁর যোগ্যতা বলতে গেলে অবশ্যই কম চাট্টিখানি কথা নয়। একই বছরে এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার একটি নতুন জাতীয় রেকর্ডসহ ফের সেই তরুনী এ্যাথলেট স্বর্ণপদকের মুখ দেখলেন।
ক্ষক্ষ ১৯৬৯, সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান। লাহোরের মাঠে প্রথম জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দল এই প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়। ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি মহিলা প্রতিনিধি দল সেখানে অংশ নেয়। প্রতিযোগিতা শেষে দেখা গেল, সর্বমোট ৫টি পদক পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা। ১টি স্বর্ণ, ৩টি রৌপ্য ও ১টি ব্রোঞ্জপদক। এর মধ্যে ২টি পদকই ছিল সেই কৃতী এ্যাথলেটের গলায়।
ক্ষক্ষ ১৯৭৩, স্বাধীন বাংলাদেশ আমল। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় যোগ দিল। সেই আসরে চারদিকে তুমুল হৈচৈ। দেখার মতো ক্রীড়া আয়োজন। যেন প্রতিযোগীদের জীবন্ত ছবি না দেখলে দারুণ নাভিশ্বাসই ব্যাপার হয়ে উঠে। রেজাল্টে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভা-ারে জমা পড়েছে ৫টি পদক। দলীয় পারফরমেন্স সন্তোষজনক। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয়, সেই কৃতি মহিলা এ্যাথলেট একাই ৩টি স্বর্ণ ও ১টি রৌপ্যপদক তুলে সকল মহলে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেন। মহিলা বিভাগে তিনিই সবচেয়ে বেশী স্বর্ণপদক জয়ের কৃতিত্ব দেখান।
ক্ষক্ষ আবারও একই বছরের ঘটনা। দেশ স্বাধীনের পর নবীন এক বাংলাদেশ দল প্রথমবারের মতো ভারত সফরে যায়। উল্লেখ্য, রাজধানী নয়াদিল্লীর গ্রাউন্ডে নিখিল ভারত গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এমন সুদিনের ইতিহাসে এর আগে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কোন ক্রীড়াবিদের পক্ষে জীবনের সেরা সাফল্য আর কেউ বয়ে আনতে পারেনি। শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের একজন কৃতী মহিলা এ্যাথলেটই পেয়েছেন, ব্রড জাম্প ইভেন্টে দ্বিতীয় স্থান অর্জন, পাশাপাশি নতুন ভারতীয় গ্রামীণ ক্রীড়া রেকর্ড সৃষ্টি করাÑ যা তৎকালীন নতুন বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বিরল সম্মান ও গৌরব অধ্যায়। মনে রাখা ভালো যে, প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারিনী দুই ক্রীড়াবিদই নিখিল ভারত গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ব্রড জাম্পে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন।
rumelboss@gmail.com