বাংলাদেশের বিউটি ইন্ড্রাস্ট্রি

বাংলাদেশের বিউটি ইন্ড্রাস্ট্রি

Persona

ভিধানিকভাবে পার্লার শব্দটির সঙ্গে সৌন্দর্যসেবার কোন সম্পর্ক নেই। ইংরেজী শব্দ পার্লার মানে হচ্ছে পারিবারিক বসার ঘর, বৈঠকখানা কিম্বা সংরক্ষিত আসনের ব্যাবস্থাসহ বিলাসবহুল রেলকামরা। পার্লারের সংগে বিউটি শব্দটি যুক্ত করলেই তার মানে দাঁড়ায় সৌন্দর্যসেবার জন্য বিশেষ ঘর। বলা যায় রূপসদন। তবে এ  চিন্তাটি প্রথম কার মাথায় এসেছিলো তা জানা না গেলেও আমাদের রোজকার লাইফস্টাইলে বিউটি পার্লার এখন পারিবারিক বসার ঘরের মতোই প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ন। অথচ একটা সময় ছিলো যখন বিউটি পার্লার বলে কোন কিছুর অস্তিত্বই ছিলোনা। সাজগোজের জন্য বিশেষ কোন জায়গার প্রয়োজন হতে পারে তা কেউ ধারণাও করতে পারেনি। ছেলেরা চুল কাটতে বাইরে গেলেও শেভ করতেন ঘরে বসে। শেভ কিম্বা হেয়ারকাটও যে বৈচিত্রময় হতে পারে বা সে কাজটি করার জন্য যে নির্দিষ্ট পেশার একজন মানুষ থাকতে পারে সে ধারণা আসে অনেক পরে। ছেলেদেরই যেখানে এই অবস্থা সেখাসে চুল কাটার জন্য মেযেরা বাড়ির বাইরে বের হবেন একথাতো একেবারেই অচিন্তনীয় । মেয়েরা প্রয়োজনের খাতিরে চুলের আগা কেটে নিতেন প্রতিবেশী বা বাড়ীর অন্য কোনো নারীর সহযোগিতায়। হয়তো বড় চুলটাকে কেটে একটু ছোট করা বা চুলের ফেটে যাওয়া আগাটাকে ছেঁটে নিতেন। ব্যাস এটুকুই। এমন সময়ও ছিলো যখন মুসলমান মেয়েদের সাজ করাটাকেই গর্হিত অপরাধ মনে করা হতো। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করতেন মেয়েরা, বড়জোর চুলে জড়াতেন সুগন্ধি ফুল। এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে ধীরে ধীরে। তবে সে পরিবর্তনও এমন কিছু নয়। একটুআধটু সাজগোজ শুরু করলেও তা সীমাবদ্ধ ছিলো নিজেদের মধ্যেই। আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব আর বিয়েতে হয়তো সাজের জন্য ডেকে আনা হতো এ বিষয়ে দক্ষ এবং জনপ্রিয় কোন আত্মীয়কে। সৌন্দর্যচর্চার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো প্রাকৃতিক উপাদান। যেমন- মেহেদী, মসুরীর ডাল বাটা, দুধের সর, কাঁচা হলুদ, গোলাপজল, নিমপাতা, মুলতানি মাটি ইত্যাদি। তবে অভিজাত বা সম্ভ্রান্তবাড়ির মেয়ে-বৌদের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাতিক্রম ছিলো। তাদের এ ধরণের সেবা নিশ্চিত করতে নিয়মিতভাবেই আসতেন ‘নাপিত বৌ বা নাপতিনিরা’। প্রাকৃতিক উপাদাানের পাশাপাশি তারা ব্যাবহার করতেন বিলিতি প্রসাধনী আর সুগন্ধি। সবকিছুই করা হতো ঘরে বসে। পার্লার সংস্কৃতি তখোনো চালু হয়নি। আমাদের এ উপমহাদেশে পার্লার সংস্কিৃতির উদ্ভব ঘটান চীনারা। তারা শুরু করেছিলেন বলেই বিউটি পার্লার শব্দটির সংগে পরিচিত হতে পেরেছি আমরা।

১৯৬৩ সালে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে প্রথম বিউটি পার্লার প্রতিষ্ঠা করেন কার্মেল চ্যাং লিউ শেই। প্রথম দিকে কোন বিশেষ নামে পরিচিত না হলেও ১৯৬৫ সালে পার্লারটি আত্মপ্রকাশ করে ’মে ফেয়ার’ নামে। সাধারন ঘরের মেয়ে কিমবা গৃহিনীরা নয় প্রথম দিকে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারোর মেয়েরাই কেবল আসতেন। পরে রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের স্ত্রীরাও এখান থেকে সৌন্দর্যসেবা নিতে শুরু করেন। সেসময় হেয়ার কাট, আইব্রাও থ্রেডিং, ব্লো ড্রাই, হেয়ার ¯েপ্র, হেয়ার সেটিং, হেয়ার পার্ম এবং হালকা ধরণের মেকাপ করা হত এখানে।

সত্যি বলতে কি এই মে ফেয়ারই আমায় উজ্জীবীত করেছে এই শিল্পে সম্পৃক্ত হতে। কোন আত্মীয়ের সঙ্গে এই পার্লারের গিয়ে আমি স্বপপ্ন দেখেছি এমন একটি আউট করার। যেখানে সৌন্দর্যসেবা পাবে এ দেশের মেয়েরা। সুযোগ পাবে নিজেদের পরিচর্যার।

যাহোক সে সময়ের কথা বলছিলাম, সে সময়ে ঢাকার মোহম্মদপুরে চিনু নামক একজন পুরুষ মেকআপ আর্টিস্টও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। চিনু ছিলেন পেশাদার বিউটিশিয়ান। সম্মানীর বিনিময়ে তিনি বাড়ীতে গিয়ে ব্রাইডাল মেকআপ করে দিতেন। পরে তিনি আমেরিকায় চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ী হন। মে ফেয়ার প্রতিষ্ঠিত হবার বারো বছর পর ১৯৭৭ সালে জেরিনা আজগর লিভিং ডল নামে তাঁর পার্লার শুরু করেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙালি যিনি এই শিল্পে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭০ সালে করাচী থেকে বিউটিফিকেশনের উপর কোর্স করেন তিনি। তাঁর পথ ধরে ধীরে ধীরে সৌন্দর্যসেবার প্রতি আগ্রহী হযে উঠেছেন অনেকেই। বিশেষ করে সৌন্দর্যসেবা যে নারীর পেশা হয়ে উঠতে পারে তা জেরিনা আজগরই প্রথম প্রমাণ করেছেন। জেরিনার দেখানো পথ অনুসরণ করে তারপর অনেকেই আতœপ্রকাশ করেছেন বিউটিশিয়ান হিসেবে। বিউটি পার্লার গড়ে ওঠার আগে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং এফডিসিতে বেশ কয়েকজন প্রফেশনাল মেকাপ আর্টিস্ট ছিলেন। টিভি নাটক ও সিনেমায় তারা শিল্পীদের মেকাপ করতেন। মঞ্চের শিল্পীরা মূলত নিজেরাই নিজেদের সাজ সেরে নিতেন। তবে মাঝে মাঝে পেশাদারদের সাহায্যও নেওয়া হতো। সে অর্থে বলা যায় আমাদের দেশে সৌন্দর্যচর্চায় যুগান্তকারী প্রসার ঘটেছে। কয়েক বছর আগেও যা কল্পনা করা যেতোনা।  নারীরা তাদের মৌলিক চাহিদা এবং বিভিন্ন ধরণের শখ পূরণ করার পর উদ্বৃত্ত টাকা থেকে জমিয়ে তা দিয়ে সৌন্দর্যচর্চা করতেন। তবে তাও ছিলো কেবল আইব্রাও থ্রেডিং বা হেয়ারকাটের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

বর্তমানে এখন বিউটি স্যালনের প্রত্যেকটি সার্ভিস এতো বেশী বৈজ্ঞানিক এবং স্বাস্থ্যসম্মত প্রমাণিত হয়েছে যে, নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতার অংশ হিসেবে এসব সেবাগ্রহণকে মৌলিক চাহিদার সাথেই সম্পৃক্ত করেছেন।

সময় পাল্টে যায় এভাবেই। একসময় বিউটি স্যালনকে অভিজাতদের আরাম করার এবং টাকা উড়ানোর জায়গা মনে করা হত। অথচ এখন তা দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবল মেয়েরাই নয় পার্লার ছেলেদেরকেও সৌন্দর্যসচেতন করে তুলেছে। নিজেদের পরিচর্যার ক্ষেত্রে তারা আজকাল অনেক যতœশীল। তাছাড়া বিউটি স্যালনের কোন সেবাই সেই অর্থে ব্যয়সাপেক্ষ নয়। বরং আজকের যাপিতজীবনের নানা ধরণের চাপ থেকে নিজেকে সাময়িকভাবে মুক্ত রাখার জন্য এসব সেবা বিশেষ কার্যকর। বাইরের বিশ্বে টেকনিক্যালী বিউটি স্যালন এবং হেয়ার স্যালন আলাদা হলেও বাংলাদেশে বিউটির সাথে হেয়ারের  সেবা  মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে নারী-পুরুষ উভয়েই  ফেসিয়াল, ম্যানিকিউর, পেডিকিউর, হেয়ার ট্রিটমেন্ট, হেয়ার কাট, হেয়ার স্টাইলিং, মাসাজ, মেকআপসহ যেকোন ধরণের সেবা নিতে পারেন। সেবার দিগন্ত প্রসারিত করতে সংযোজিত হয়েছে স্পা। যেখানে আরো কাস্টমাইজড ও ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস পাচ্ছেন ক্লায়েন্টরা।

বিউটি স্যালনের এই ব্যাপক প্রচার ও প্রসার আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রেও— সৃষ্টি করেছে নতুন দিগন্ত। নারীবান্ধব কর্ম পরিবেশের অভাবে আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত এবং সম্ভাবনাময় নারী নির্দিষ্ট কিছু পেশার বাইরে যেতে পারতেন না। অথচ এই পেশায় নারীরা স্বচ্ছন্দে এগিয়ে আসতে পারেন। এমনকি স্বল্পশিক্ষিত একটি মেয়েও সৌন্দর্যসেবার ট্রেনিং নিয়ে নিজের পায়ে অনায়াসেই দাঁড়াতে পারছেন। পারসোনার কথাই ধরা যাক। এর যাত্রা শুরু করে ১৯৯৮ সালে। ইতিমধ্যেই এর কর্মীসংখ্যা দাঁড়িয়েছে আড়াই হাজারের ওপর। আগামীতে আউটলেট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সংখ্যা আরো বাড়বে। বিউটি পার্লারের গন্ডি থেকে বের হয়ে পারসোনা পরিণত হয়েছে বিউটি ইন্ড্রাস্ট্রিতে। এ ধরনের ইন্ড্রাস্ট্রি ভবিষ্যতে আরো তৈরি হবে। কারণ বিশ্বায়নের এই যুগে তথ্য, প্রযুক্তি এবং আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে সৌন্দর্যচর্চা ক্রমেই বিশাল আকার ধারন করছে। বলা বাহুল্য নয় দেশীয় অর্থনীতীকে সবল করে তোলার জন্য এটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। মানুয়ের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ক্রমশই বেড়ে চলছে বিউটি পার্লারের সংখ্যা। কেবল শহরে নয়, গ্রামেও দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ শিল্প। বিয়ে বা যে কোন বিশেষ আনুষ্ঠানে সেজে উঠতে আজকাল বিউটিপার্লারের দ্বারস্থ হয় গ্রামের নারীরা। আগামীতে এ সচেতনতার মাত্রা আরো বাড়বে। ইতোমধ্যেই এ খাতের টার্নওভার কয়েকশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় দেড় লাখ নারী-পুরুষের বেকারত্ব ঘুচিয়েছে এ শিল্প পাশাপাশি সরকার লাভবান হচ্ছে রাজস্ব পেয়ে। বর্তমানে কানিজ আলমাস খান ছাড়াও ফারজানা শাকিলস বিউ স্যালন, লা বেল, উইমেন্স ওয়ার্ল্ড, রেড, বানথাইসহ অনেক নামী বিউটি পার্লার হয়েছে। বাংলাদেশে পার্লারের পাশাপাশি প্রথম স্পা সেবা প্রদান শুরু কওে পারসোন্ তখন পাঁচতারা হোটেলগুলোতেও এই সেবা ছিল না। পারসোনার তার সেবার পরিধি বাড়িয়েই চলেছে। ঢাকার অদূরে প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে বাংলাদেশের প্রথম স্পা রিসোর্ট। এছাড়া বিউটি ও লাইফস্টাইল বিষয়ক শিক্ষঅ প্রদানের জন্য অনেক আগেই পারসোনা খুলেছে আর্ন্তজাতিক মানের ইনস্টিটিউট। বর্তমানে স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ ফাউন্ডেশন (এসএমইএফ), যুব মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মেয়েদেও সৌন্দর্যসেবা শিক্ষার ব্যবস্থা কওে তাদে স্বর্ভিরতা অর্জনে সহায়তা করছে। এর ফলে তারা একদিকে যেমন আত্মনির্ভও হচ্ছে অন্যদিকে তারা মফস্সল ও গ্রামের মেয়েদেও আধুনিক ও সচেতন কওে তুলছে।

সব মিলিয়ে এ শিল্পের জন্য একটি সঠিক দিকনির্দেশনা তৈরির সঠিক সময় এখনই। সরকার যদি এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি দেয় তবে অচিরেই এ শিল্পের সম্ভাবনা পরিণত হবে সফলতায়।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, ক্যানভাস

sksaifurrahman@gmail.com

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.