রুমেল খান
তালেবান আর আল-কায়েদার কারণে যে দেশ ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত, দেশের অর্থনীতি প্রায় পঙ্গু, জানমালের নেই কোন নিরাপত্তা, নেই পর্যাপ্ত ফুটবল স্টেডিয়াম, সেই আফগানিস্তানের চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা নিঃসন্দেহে অনেক গৌরবের। জাতীয় দলের সব ফুটবলারই খেলেন বিদেশী লীগে। নিখাদ তাদের দেশপ্রেম। মাঠে নিপুণ ফুটবলশৈলী উপহার দিয়ে রূপকথা রচনা করলো তারা, যা হয়ে থাকবে ইতিহাস।
একেই বলে বিপ্লব, একেই বলে কড়ায়-গন্ডায় প্রতিশোধ। দু’বছর আগে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতের কাছে ০-৪ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল সাফ অঞ্চলের সদস্যভুক্ত নতুন দেশ আফগানিস্তান। এবারও একই আসরের ফাইনালিস্ট সেই ভারত-আফগানিস্তানই। তবে পাশার দান এবার উল্টে গেছে। ১১ সেপ্টেম্বর নেপালের কাঠমন্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে দুর্দান্ত খেলে ভারতকে ২-০ গোলে হারিয়ে (দলের পক্ষে গোল করেন মুস্তফা আজাদজয় এবং সানজার আহমাদি) সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের দশম আসরে নতুন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নাম লেখালো কাবুলিওয়ালার দেশ আফগানিস্তান। সেই সঙ্গে নিল মধুর প্রতিশোধও। পুরো টুর্নামেন্টে রেফারিদের বদন্যতা পাওয়া আর ভাগ্যের সহায়তায় ফাইনাল পর্যন্ত আসা ভারত পারেনি সপ্তমবারের মতো শিরোপা করায়ত্ত করতে। চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দল হিসেবে আফগানিস্তান ও ভারত প্রাইজমানি হিসেবে পেয়েছে যথাক্রমে ৫০ হাজার ও ২৫ হাজার ডলার।
‘বি’ গ্রুপের রানার্সআপ দল আফগানিস্তান গ্রুপ পর্বে ভুটানকে ৩-০, শ্রীলঙ্কাকে ৩-১ গোলে হারায়। গোলশূন্য ড্র করে মালদ্বীপের সঙ্গে। সেমিতে স্বাগতিক নেপালকে হারায় ১-০ গোলে। পক্ষান্তরে ‘এ’ গ্রুপের রানার্সআপ ভারত গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানকে ১-০ গোলে হারায়। বাংলাদেশের সঙ্গে রেফারির কৃপায় ১-১ গোলে ড্র করে। নেপালের কাছে ১-২ গোলে হেরেও গোল সমীকরণের মারপ্যাঁচে ভাগ্যক্রমে উঠে আসে সেমিতে। সেখানে তারা কোনক্রমে শক্তিশালী মালদ্বীপকে হারায় ১-০ গোলে। কিন্তু ফাইনালে এসে আর শেষরক্ষা করতে পারেনি। পায়নি রেফারির আনুকুল্য আর সৌভাগ্যের পরশ। খেলা শুরুর ৯ মিনিটের মধ্যেই কাঙ্খিত গোলের সন্ধান পেয়ে যায় আফগানিস্তান। সতীর্থ বেলাল আরেজুর কাছ থেকে ক্রস পাস পেয়ে সেটা ভারতের গোলপোস্টে পাঠাতে বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি আজাদজয়ের (১-০)। স্তব্ধ হয়ে যায় স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসা হাজার তিনকে ভারতীয় দর্শক। ১৭ মিনিটে গোলের সুযোগ পায় ভারত। রবিন সিং আফগান গোলরক্ষক মনসুরকে একা পেয়েও গোল করতে পারেননি।
কোথায় গোল শোধ করে খেলায় ফিরবে, তা না, বরং ৬২ মিনিটে আবারও গোল হজম করে বসে ভারত। বেলালের নেয়া শট ভারত গোলকিপার সুব্রত ক্লিয়ার করলেও শেষরক্ষা হয়নি। বল চলে যায় সানজার আহমাদির পায়ে। তিনি যে শট নেন, তা সুব্রতর মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় জালে (২-০)। উল্লাসে মেতে ওঠে আফগান দল।
আফগানিস্তান গোলের সুযোগ নষ্ট করে ১৯, ৫৮, ৮৭ মিনিটে। পক্ষান্তরে ভারত গোলের সুযোগ মিস করে ২৩, ২৭, ৩২, ৩৫, ৫৯, ৬১, ৬৩, ৭৮, ৮৯ মিনিটে। বোঝাই যাচ্ছে তারাই বেশি আক্রমণ করে খেলেছে। কিন্তু একটা গোলের জন্য বিপক্ষের গোলসীমানায় এসে মাথা কুটে মরেছে বার বার। এর বিপরীতে কাউন্টার এ্যাটাককরে সুযোগের পুরো ফায়দা লুটে নিতে পেরেছে রূপকথার মতো খেলে সাফ ফুটবলে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়া আফগানিস্তান।
রেনেসাঁ, বিস্ময়কর, রূপকথা, অবিশ্বাস্য, অনবদ্য যাই বলা হোক না কেন, কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয় আফগানিস্তানের জন্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশটি সত্যিকার অর্থেই ফুটবলে বিপ্লব ঘটিয়েছে। দেশটির ফুটবল ইতিহাসেরই প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা এটা।
গত কয়েক বছর ধরেই অভাবনীয় উন্নতির স্বাক্ষর রেখে চলেছিল আফগান ফুটবল দল। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেই এবারের সাফে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব পাকাপোক্ত করেছে দেশটি। অথচ দেশটির বর্তমান ও সাম্প্রতিক অতীতে দৃষ্টি দিলে এই সাফল্য বিস্ময়করই বলতে হবে। আফগানরা প্রমাণ করেছে, শুধু কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ আর বিদেশী কোচ নিয়োগ দিলেই সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন ফুটবলের প্রতি ভালবাসা, দেশাত্ববোধ, আবেগ। তা না হলে কিছুদিন আগে তালেবান অধুষ্যিত হয়েও কিভাবে সম্ভব এই রূপকথার উত্থান! বর্তমানে তালেবানের হিংস্র থাবা থেকে মুক্তি মিললেও আচমকা বোমাবাজি, আত্মঘাতি হামলা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। সত্যিকার অর্থে তেমন কোনো বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই তর তর করে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে আফগানিস্তান ফুটবল দল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেশটির ঘরোয়া ফুটবল লীগের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১২ সালে। অথচ কি বিস্ময়কর ধারাবাহিকতাই না তারা দেখিয়ে চলেছে। দিনের পর দিন গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত আফগান জাতি প্রমাণ করেছে ফুটবলের প্রতি তাদের আবেগ-ভালাবাসা। এজন্য বিজয়ী বীরেরা বৃহস্পতিবার দেশে ফিরলে গোটা জাতি তাদের লাল-গালিচা সংবর্ধনা দেয়। দেশটির রাজধানী কাবুলে জড়ো হয়েছিল হাজারো মানুষ। এরপর কাবুল স্টেডিয়ামে ফুটবলারদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। এ সময় ভক্ত-সমর্থকদের ভালবাসায় সিক্ত হন মোহাম্মদ, মনসুর, হারুন, মুস্তাফা, মুজতাবারা।
শুধু তাই নয়, বিজয়ী ফুটবলারদের বরণ করে নেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেন, ‘আমাদের তরুণরা প্রমাণ করেছে যে আমাদের উন্নতি করে জেতার ক্ষমতা আছে।’ আন্তর্জাতিক ফুটবলে আফগানিস্তানের এটাই প্রথম সাফল্য, যা উদযাপনে ১১ সেপ্টেম্বর রাতেই দেশটির রাস্তায় নেমে আসে উল্লসিত মানুষ। তাদের হাতে হাতে উড়ছিল দেশের পতাকা। মনের আনন্দে রাজধানী কাবুলের রাস্তায় অনেকে আবার নাচতে শুরু করেন। দেশের ফুটবলারদের ইতিহাস গড়ার সাক্ষী হতে ঘরে-বাইরে, কফিশপে ও বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় টিভির সামনে ভিড় করে অসংখ মানুষ। ইতিহাস গড়া ম্যাচটি শেষে হওয়ার পরপরই কাবুলসহ অন্যান্য অঞ্চলে সমর্থকরা একে-ফোর্টি সেভেন থেকে আকাশে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। কোথাও কোথাও মেশিনগানের গুলি ছোঁড়া হয়। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে আফগান ফুটবলার ওয়াহিদুল্লাহ বলেন, ‘আমি খুব খুশি এবং গর্বিত। এ সাফল্যের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আমার পরিবার, বন্ধুরা ও গোটা জাতি সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করেছে। তাদের প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে পেরে ভীষণ ভাল লাগছে।’ গোলরক্ষক মনসুর বলেন, ‘আমিসহ গোটা দেশ গর্বিত। আমি অভিনন্দন জানাই দেশবাসীকে। তারা সবসময় আমাদের সমর্থন ও সাহস যুগিয়েছে।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈর্ষণীয় সাফল্য পেলেও আফগানিস্তানের ফুটবল চর্চটা অবশ্য নতুন নয়। ৯০ বছর আগে থেকে দেশটির ফুটবলে যাত্রা শুরু। আফগানরা ফিফার সদস্যপদ লাভ করে ১৯৪৮ সালে। দেশটির ফুটবল ফেডারেশন গঠিত হয় ফিফার সদস্যপদ পাওয়ারও ২৬ বছর আগে অর্থাৎ ১৯২২ সালে। ১৯৫৪ সালে আফগানিস্তান এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) সদস্যপদ লাভ করে। সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত এশিয়ার বিভিন্ন ফুটবল আসরে নিয়মিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত আফগানরা। কিন্তু ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের কারণে দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী এক গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। যে কারণে অন্য সবকিছুর মতোই ফুটবল চর্চাটাও হারিয়ে যায়। আর আশির দশকে একেবারেই ফুটবলে অনিয়মিত হয়ে পড়ে আফগানিস্তান। নব্বইয়ের দশকে তো গোটা দেশের ভবিষ্যতই অন্ধকারারচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কেননা এ সময় দেশটিতে তালেবান দখলদারিত্বের দামামা বেজে ওঠে। ফলে শুধু ফুটবলই নয়, সমগ্র খেলাধুলাই চলে যায় আস্তাকুঁড়ে। এ সময় খেলাধূলা করা ছিল নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার মতো! ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবানরা আফগানিস্তান পুরোপুরি দখলে নিলে সেখানে খেলাধুলা পরিণত হয় নিষিদ্ধ এক বিষয়ে। যার ফলে স্টেডিয়ামগুলো হয়ে জঙ্গী তালেবানদের আখড়া। অন্ধকারাচ্ছন্ন এ পাঁচটি বছর আফগানিস্তানে ফুটবল তো নয়ই, কোন খেলাধুলাই হয়নি! অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এ সময় নির্মল বিনোদনের স্টেডিয়ামগুলোতে মানুষের মাথা কাটা হতো! অর্থাৎ জল্লাদের কারখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল খেলার মাঠগুলো।
২০০১ সালে মার্কিন হস্তক্ষেপে তালেবান শাসনের পতন হলেও গৃহযুদ্ধের রেশ দেশটি এখনও টেনে যাচ্ছে। আজও প্রতিনিয়ত দেশটির আনাচে-কানাচে আত্মঘাতী হামলায় নিরহ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। আশা করা হচ্ছে, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় আফগানিস্তানের ফুটবলের উন্নয়নেই কেবল অবদান রাখবে না, অবদান রাখবে দেশ গঠনেও। এমনটিই আশা করছেন দেশটির জনগণ। সাফ শিরোপা যেন নিমেষেই জাতি ও গোষ্ঠীগত বিভেদে ক্ষতবিক্ষত আফগানিস্তানকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। এ বিজয় ঐক্যবদ্ধ করেছে গোটা জাতিকেই। আফগানরা তাই এখন সব দুঃখ, কষ্ট, ঝঞ্জা দূর করার আশা করতেই পারে।
এ আসরের তিন সেরা
সর্বোচ্চ গোলদাতা : আলী আশফাক (১০টি, মালদ্বীপ)
সেরা খেলোয়াড় : রবিন শ্রেষ্ঠ (নেপাল)
সেরা গোলরক্ষক : মনসুর ফাকিরইয়ার (আফগানিস্তান)
সাফ ফুটবলের রোল অব অনার
সন আয়োজক চ্যাম্পিয়ন রানার্সআপ
১৯৯৩ পাকিস্তান ভারত শ্রীলঙ্কা
১৯৯৫ শ্রীলঙ্কা শ্রীলঙ্কা ভারত
১৯৯৭ নেপাল ভারত মালদ্বীপ
১৯৯৯ ভারত ভারত বাংলাদেশ
২০০৩ বাংলাদেশ বাংলাদেশ মালদ্বীপ
২০০৫ পাকিস্তান ভারত বাংলাদেশ
২০০৮ মালদ্বীপ মালদ্বীপ ভারত
২০০৯ বাংলাদেশ ভারত মালদ্বীপ
২০১১ ভারত ভারত আফগাস্তিান
২০১৩ নেপাল আফগানিস্তান ভারত
* ২০১৫ সালে পরবর্তী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হবে ভারত
rumelboss@gmail.com