থ্রী-জি’র সাতকাহন

থ্রী-জি’র সাতকাহন

teletalk-3g-

বাংলাদেশে এখন সব জায়গায় আলোচনার একটি সাধারণ বিষয়ের নাম থ্রিজি। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশে বহুল আরাধ্য থ্রিজির নিলাম অনুষ্ঠিত হলো যেখানে সিটিসেল বাদে বাকি সকল অপারেটর থ্রিজির তরঙ্গ বরাদ্দ পেয়েছে। এরপর বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া,ফেসবুকে থ্রিজি নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। মানুষ আশা করছে ইন্টারনেট নিয়ে দীর্ঘদিনের হা হুতাশের হয়ত এখন একটা সমাধান হবে। তরঙ্গ বরাদ্দ পাবার পর প্রতিটি কোম্পানিই সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে থ্রিজি সেবা শুরু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অক্টোবরের মধ্যে দেশের দুই বৃহত্তম টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রবি ও গ্রামীণফোন সীমিত পরিসরে থ্রিজি চালুর ঘোষণা এরই মধ্যে দিয়ে দিয়েছে। থ্রিজি নিয়ে বহু মানুষের মধ্যে এখনো বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। তাদের সকল বিভ্রান্তি দূর করতে আমরা আজকে দেখব থ্রিজি আসলে কি, এই সেবা চালু হলে আমাদের কি কি সুবিধা হবে এবং আসলেই আমরা সেসকল সুবিধা পাব কিনা।

 

থ্রিজি কি?

এরই মধ্যে হয়ত অনেকে গুগলে ঘাটাঘাটি করে থ্রিজি সম্পর্কে ধারণা পেয়ে গেছেন। থ্রিজি শব্দটি মূলত থার্ড জেনারেশনের সংক্ষিপ্ত রুপ। থ্রিজি টেলিকম সার্ভিস বলতে তৃতীয় প্রজন্মের তারহীন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বোঝায়। এতদিন এদেশে টুজি বা সেকেন্ড জেনারেশনের টেলিকম সার্ভিস চালু ছিল। টুজির একটা বড় সমস্যা হলো এর ধীরগতির ডাটা ট্রান্সফার। ফলে টুজি শুধুমাত্র অডিও ভয়েস কল সাপোর্ট করে। টুজির এই সীমাবদ্ধতাকে দূর করতেই নিয়ে আসা হয় থ্রিজি প্রযুক্তি। থ্রিজির গতি টুজির চেয়ে দশ থেকে বিশগুণ বেশি হবার কারণে থ্রিজি অডিও কলের পাশাপাশি ভিডিও কল,ভিডিও চ্যাট,ইন্টারনেট টিভি এবং হাই স্পিড ডাটা সার্ভিস প্রোভাইড করতে পারে। থ্রিজি কিন্তু নতুন কোন প্রযুক্তি নয়। ১৩ বছর আগে জাপানে সর্বপ্রথম থ্রিজি সার্ভিস চালু হয়। হ্যাঁ,ঠিক শুনেছেন-১৩ বছর আগে! কিন্তু বাংলাদেশে ২০০৮ সালের আগস্টে ‘আলোকিত বাংলাদেশ’ নামক এক প্রজেক্টের আওতায় এরিকশন থ্রিজির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে থ্রিজি চালু করে। এরপর দীর্ঘ তিনবছর বিটিআরসি থ্রিজির জন্য নীতিমালা,লাইসেন্সের দরদাম আর থ্রিজি চালু করতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে ব্যয় করে। এদেশে বাণিজ্যিকভাবে ২০১২ সালে অক্টোবরে রাষ্ট্রীয় টেলিকম সেবাদাতা টেলিটক থ্রিজির যাত্রা শুরু হয়। আর এই কিছুদিন আগে সকল অপারেটর থ্রিজি সেবার চালুর জন্য লাইসেন্স পেল।

3g

বাংলাদেশে টুজি সার্ভিসের সাধারণ রূপ হলো জিএসএম এবং সিডিএমএ। কিন্তু থ্রিজি সার্ভিস চালু হলে তা হবে UMTS, W-CDMA, EV-DO। তবে অধিকাংশ টেলিকম কোম্পানি থ্রিজি চালুর বদলে ৩.৫জি চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন কিন্তু HSDPA, HSPA+, Dual carrier HSDPA এগুলো থ্রিজি সার্ভিস দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে। টেলিটক এরই মধ্যে ৩.৫জি সার্ভিস গ্রাহকদের দিচ্ছে। তারা এখন ৩.৭৫জি সার্ভিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই আপগ্রেড করে গ্রাহকদের কি লাভ হবে? গ্রাহকরা সাধারণ থ্রিজির তুলনায় আরো দ্রুতগতির ইন্টারনেট ডাটা সুবিধা পাবেন। ফলে এতদিনের বিভিন্ন আক্ষেপের অবসান হবে।

 

থ্রিজির কাছে আমরা কি আশা করতে পারি?

থ্রিজি সার্ভিস চালু হলে আমরা কি কি সুবিধা পাব তা নিয়ে মানুষের কিছু ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে বিভিন্ন জায়গায় থ্রিজি সার্ভিস নিয়ে যে গুজব চলছে তার বেশিরভাগই সত্যি। থ্রিজি চালু হলে যে আমরা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা এবং ভিডিও কলিং সুবিধা পাব এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। থ্রিজির চালুর মাধ্যমে দেশে সত্যিকারের মোবাইল ব্রডব্যান্ড সেবা চালু হবে। এছাড়া বিভিন্ন ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস প্রদানের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা হবে। বিশেষ করে ইন্টারনেট রেডিও/টেলিভিশনের চল ব্যাপক বাড়বে বলে সবাই ধারণা করছে। তবে ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসগুলো মূলত অপারেটরদের নিজস্ব উদ্ভাবনী চিন্তার উপর নির্ভর করছে। এমন অনেক ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস চালু করা সম্ভব যা ব্যবহার করে এদেশে মানুষ সত্যিকার অর্থেই উপকৃত হতে পারে। তবে থ্রিজি নিয়ে আমাদের সবচেয়ে আশার জায়গাটির নাম ইন্টারনেট। থ্রিজিতে ইন্টারনেটের গতি কেমন হবে সেটাও মূলত অপারেটরদের পলিসির উপর নির্ভর করছে। যেমন-টেলিটক থ্রিজি স্পিড ও ডাটার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন প্যাকেজ বের করেছে-২৫৬কেবিপিএস থেকে শুরু করে ৪ এমবিপিএস পর্যন্ত নানা প্যাকেজ আছে টেলিটকের। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ মোবাইল অপারেটর এমন স্পিড নির্ভর প্যাকেজ বের করে না। গ্রাহক কতটুকু স্পিড পেতে পারেন তার কোন সীমা বেঁধে দেয়া থাকে না। ফলে গ্রাহক অপারেটরের নেটওয়ার্কের অবস্থা,নিজস্ব ডিভাইসের সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে সর্বোচ্চ গতিও পেতে পারেন।

গ্রামীণফোন আন্তর্জাতিক এই রীতি মেনে থ্রিজি সেবা চালু করবে বলে আভাস পাওয়া গেছে। অন্যদিকে রবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান তাদের থ্রিজি+ সার্ভিসে একজন সাধারণ গ্রাহক ৭.২ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট সেবা উপভোগ করতে পারবেন। যেহেতু সকল অপারেটরই থ্রিজি+ সেবা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সেহেতু আমরা ধারণা করতে পারি যে নূন্যতম গতি .২ এমবিপিএস থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ গতি প্রায় ১৪.৪ এমবিপিএস পর্যন্ত হতে পারে।

থ্রিজি সার্ভিসের আরেকটা আকর্ষণীয় সুবিধা হলো ভিডিও কলিং। এই সুবিধা ব্যবহার করে আপনি সহজেই ভিডিও কলিং সাপোর্টেড স্মার্টফোন থেকে ভিডিও কল করতে পারবেন। ভিডিও কলিং এর মান কেমন হবে তা অপারেটরের নেটওয়ার্ক এবং আপনার ডিভাইসের মানের উপর নির্ভর করবে। ভিডিও কলিং এর সুবিধা হলো এতে আপনার ইন্টারনেট ডাটা কখনো ব্যবহৃত হবে না ফলে ইন্টারনেট ডাটা খরচ হবার ভয় থেকে আপনি রক্ষা পেয়ে যাবেন। তবে ভিডিও কলিং করতে বেশ ভাল মানের নেটওয়ার্ক লাগবে বলে এর সার্ভিস কতটা ভাল হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আর হ্যাঁ ভিডিও কলিংয়ের সময়ে আপনার মানিব্যাগের ব্যালেন্সটার কথাও কিন্তু মাথায় রাখবেন!

 

এখন আসি সমস্যায়

থ্রিজি সার্ভিস নিয়ে নিশ্চয়ই আপনি আশাবাদী হতে শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু আপনার আশাতে জল ঢালতে থ্রিজির বিভিন্ন সার্ভিসের দামই যথেষ্ট হবে। আপনার দেখেছি যে থ্রিজি ভয়েস কলিং সাধারণ কলের চেয়ে অন্তত চার থেকে পাঁচগুণ বেশি হবে। অন্যদিকে ডাটা সার্ভিস বা ইন্টারনেটের দাম কিন্তু সেই তুলনায় ততবেশি হবার কথা না। বিভিন্ন এশীয় দেশ ও এদেশের টেলিটকের ডাটা প্ল্যান দেখে আমরা আন্দাজ করছি থ্রিজি সার্ভিসে ১ জিবি ডাটার মূল্য ২৫০-৩৫০ টাকার মধ্যে হবে। থ্রিজির আগমন উপলক্ষ্যে ২জি ডাটা সার্ভিসের মূল্য অপারেটররা এরই মধ্যে কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আসলেই দাম কেমন হবে তা সম্পর্কে এখনই বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।

এদেশে থ্রিজি চালুর আরেকটা সমস্যা হলো ডিভাইস। দেখা গেছে এদেশের মাত্র ১০ শতাংশ ডিভাইস থ্রিজি নেটওয়ার্কের উপযুক্ত। এসব পুরোনো ডিভাইসের মালিক যারা তারা থ্রিজি সেবা উপভোগ করতে পারবেন না। অন্যদিকে নেটওয়ার্ক জ্যাম মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ঈদের সময় আমরা আমাদের ২জি নেটওয়ার্ক থেকে যে সার্ভিস পাই সেরকম সার্ভিস যদি থ্রিজির ক্ষেত্রেও হয় তাহলে চিন্তার কারণ আছে বইকি। থ্রিজিতে যেহেতু অনেক গ্রাহক ডাটা ট্রান্সফার ও ভিডিও কলিংয়ের কাজ করবেন সেক্ষেত্রে নেটওয়ার্কের সক্ষমতা নিয়ে এখনই অপারেটরগুলোর চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত। কারণ কোন অপারেটরই ১৫ মেগাহার্জের তরঙ্গ বরাদ্দ নেয়নি এবং বিটিআরসিও এই সমস্যা নিয়ে চিন্তিত।

যারা ঢাকা বা এর আশেপাশে আছেন তারা আগামী মাস থেকেই থ্রিজি সেবা উপভোগ করতে পারলেও সারা দেশে থ্রিজি ছড়িয়ে দিতে বেশ সময় লাগবে। তবে বিটিআরসিকে ধন্যবাদ যে তারা একটা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। আগামী নয়মাসের মধ্যেই বিভাগীয় শহরগুলো থ্রিজির আওতায় নিয়ে আসার জন্য বিটিআরসি বাধ্যবাধকতা দিয়ে দিয়েছেন। থ্রিজির মাধ্যেমে বাংলাদেশ এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এই সার্ভিস চালু হলে আমাদের দীর্ঘদিনের অনেক সমস্যার সমাধান হবে – এই আশা আমরা করতেই পারি। হাই স্পিড ইন্টারনেট ও ভিডিও কলিংয়ের মতো সুবিধা নিয়ে আসার কারণে থ্রিজি আমাদের প্রত্যাশা প্রতিদিন বাড়িয়ে দিচ্ছে। কি হবে তা জানার জন্য আর কয়েকটি মাস একটু অপেক্ষা করুন। আশা করি আমরা খারাপ সার্ভিস পাব না।

 

 

 

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.