আমার দীর্ঘ পেশাগত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর সাথে অনেকবারই দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। কখনোবা অনেকটা সময় কেটেছে পারস্পারিক সান্নিধ্যে। বলাবাহুল্য দেখা-সাক্ষাৎগুলো হতো বিশেষ করে কোনো সামাজিক, সাংস্কুতিক, সাংগঠনিক বা রাজনৈতিক ছোট-বড় কোনো অনুষ্ঠান, আচার-আয়োজনে।
সেদিন যেভাবে তাঁর সাথে মিশেছি। কথা বলেছি। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলাপ-আলোচনা করেছি, আজ তেমনটির অবকাশ বা সুযোগ কোনোটাই নেই। সেদিনের তিনি আর আজকের তিনি’র মধ্যে সুবিশাল ফারাক। সেদিনের পার্লামেন্ট মেম্বার, ডেপুটি স্পীকার, স্পীকার থেকে আজ তিনি রাষ্ট্রের পতি। রাষ্ট্রপতি। দেশ ও জনগণের গতি। তবে ব্যক্তি মানুষটি যে পরিবর্তিত হননি, তাঁর পদাধিকার বলটা যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে বাড়তি কোনোই প্রভাব ফেলেনি, সেটা জেনে অন্তত: এই সুদূর পরবাসে বসে বেশ ভালো লাগছে।
অনেক অনেক দেশের রাষ্ট্রপতির সাদামাটা জীবন-যাপনের অনেক কীর্তি-কাহিনী শুনে থাকি; জেনে থাকি। কখনো আক্ষেপ করে বলে থাকি, ‘আমাদের দেশে আমরা কবে তেমন একজন মানুষকে পাবো। যিনি হবেন উদাহরণ।’ বাস্তবিক অর্থে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তেমনই একজন মানুষ, যাকে নিয়ে কোনোই সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা তাঁকে পরিমাপ করার মতো ঘটনাবলী তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বিস্তর রয়েছে। যার কিছুটা হয়তো আমরা জানি, অনেকটাই জানি না। সামনেও তাঁকে পরিমাপ করার আরো সুযোগ রয়েছে বিস্তর; কেননা তিনি খুব বেশীদিন হলো রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেননি।
অতি সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রয়োজনে সিংগাপুর সফর এবং সেখানে রাষ্ট্রীয় অর্থের কৃচ্ছ্বতা সাধন তাঁকে নতুন করে তুলে এনেছে অন্য এক আলোচনায়। যেখানে স্পষ্টত:ই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নিরহঙ্কারী সাদামাটা জীবন-যাপনের একটি চিত্র।
আমরা যারা তাঁকে অল্প-বিস্তর জানি, তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু যারা তাঁকে জানেন আরো গভীরভাবে। যাদের সংগে তাঁর সময়ক্ষেপণ আরো দীর্ঘ, মেলামেশা বিস্তর, তারা আরো ভালো বলতে পারবেন, এই সাদাসিধে মানুষটার আজন্ম জীবন-চিত্র আগে কেমন ছিলো আর আজকে কেমন।
আসলে আমি বলার প্রয়াশ পাচ্ছি, শুধুমাত্র একটি সিংগাপুরের উদাহরণকে টেনে এনে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যের পোষ্টমর্টেম করাটাও যথোপযুক্ত নয়। এখানে তাঁর বিগত রাজৈনতিক জীবনকে টেনে এনে কাঁটাছেঁড়া করারও বিস্তর সুযোগ রয়েছে। আমরা তেমনটি প্রত্যাশা করি বিজ্ঞ কোনো পোষ্টমর্টেমকারী ব্যক্তি বা মহলের কাছে।
রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তো মাত্র কয়েকদিন; কিন্তু পেছনে পড়ে আছে তাঁর বিশাল রাজনৈতিক জীবন। বিস্তর ঘটনাবহুল কর্মকান্ড। অনেক উদাহরণ, অনেক দৃষ্টান্ত।
আমাদের দেশ ও সমাজে স্বভাবদোষে দুষ্ট কিছু মানুষ আছেন যাদের ভালোটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে বড় কষ্ট হয়। পঁচা-ভেজাল গিলতে গিলতে পেটে ভালো কিছু সহ্য হয় না। বদহজম হয়ে যায়। বমি না করা পর্যন্ত তাদের যেনো শান্তি-স্বস্থি হয় না। রাষ্ট্রপতির সিঙ্গাপুরের কৃচ্ছ্বতা সাধনের ঘটনাকে সামনে এনে যারা স্বভাবদোষে বাঁকা মত-মতামত দেয়ার মানসিকতা দেখাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশে বলবো, মহামান্য রাষ্ট্রপতি খলিফা হারুণ-অর-রশিদ হবেন কিংবা হলেন কিনা সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়; আমাদের বিবেচ্য হচ্ছে, ব্যক্তি আব্দুল হামিদ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্রপতি পদটার কোনো অপব্যবহার করছেন কিনা। ক্ষমতাবলে নিজের স্বার্থে রাষ্ট্রের কাছ থেকে বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন কিনা।
আমার উপরোক্ত কথাগুলো মূলত: ঠোঁটকাটা নিন্দুকের জন্যই।
তবে যাই বলুন না কেনো, মূল কথা হচ্ছে, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা সকলেই বলবেন যে, সিঙ্গাপুরে তিনি যা করেছেন সেটা তাঁর চরিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনি বরাবরই এমন একজন রাজনৈতিক নেতা যার দ্বিতীয় কপি বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
কি করেছেন তিনি সিঙ্গাপুরে?
১. রাষ্ট্রের খরচ বাঁচাতে সিঙ্গাপুরে দৈনিক সাত হাজার ডলারের হোটেল স্যুইটের বদলে কম দামি হোটেলে ৬০০ ডলারের স্যুইটে থেকেছেন। এর ফলে আগের সফরে গ্র্যান্ড হায়াতে রাষ্ট্রপতির হোটেল স্যুইটের ভাড়া যত ছিল, এবার ২৩ সদস্যের প্রতিনিধিদলের (নিরাপত্তাকর্মীসহ) সবার হোটেল ভাড়া মিলেও তত হয়নি।
২. হোটেলের খাবারের দাম বেশি, তাই বাইরে থেকে কম দামে আনিয়েছেন বাঙালি খাবার। ৩. বিদেশে খরচ বাঁচাতে সামরিক সচিব, সচিব ও ব্যক্তিগত সচিবকে চড়িয়েছেন একই গাড়িতে।
৪. অনেক সময় তিনি প্রটোকলের বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ থাকতে চাননি। সিঙ্গাপুরে চশমা ঠিক করতে দেওয়ার পর অন্য একটি দোকানে যাওয়ার জন্য হেঁটেই রাস্তা পার হয়েছেন। এতে নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।
৫. সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্রপতি সফরে গেলে সেখানে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের বাসভবনে সাধারণত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের লোকজনও আসেন সেখানে। অনুষ্ঠান ও আতিথেয়তার জন্য খরচ হয় রাষ্ট্রের। এবার রাষ্ট্রপতি সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেন, কোনো অনুষ্ঠান নয়। শুধু চা খেতে যাবেন তিনি। বাস্তবে হয়েছেও তাই।
৬. ইয়র্ক হোটেল থেকে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল দেখা যায়। হোটেলের কক্ষ থেকে যাতে হাসপাতালটি রাষ্ট্রপতির নজরে না পড়ে সে জন্য নিরাপত্তারক্ষীরা স্যুইটের জানালাগুলো পর্দা দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে রেখেছিলেন। কারণ তাঁদের এই দুশ্চিন্তা কাজ করছিল যে সাধারণ জীবনযাপনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি কক্ষের জানালা দিয়ে হাসপাতাল দেখে হেঁটেই সেখানে চলে যেতে চাইতে পারেন। তাতে তাঁর নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
উল্লেখ্য, গত আগস্টে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্বিতীয়বার সিঙ্গাপুর সফরকালে মিতব্যয়িতার এ দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেন।
জানা যায়, রাষ্ট্রপতির এই মিতব্যয়ের ফলটাও হয়েছে দারুণ। আগেরবার ৪ থেকে ৯ মে পর্যন্ত ছয় দিনে তাঁর সিঙ্গাপুর সফরে রাষ্ট্রের খরচ হয়েছিল এক লাখ ৪৪ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার। গত ২৪ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আট দিনের সফরে ব্যয় হয়েছে এক লাখ চার হাজার ডলার।